মাউন্ট রোরাইমা: হারানো পৃথিবীর সন্ধানে মেঘের ওপারে

4640
0
মাউন্ট রোরাইমার সমতল চূড়া; Image Source: pinterest

সুবৃহৎ ঘন সবুজ অরণ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়চূড়াটি। শ্বেতশুভ্র মেঘলোক ছাড়িয়ে তার বিস্তৃতি। ঘন কুয়াশার আবরণ চূড়াটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। চূড়াটির নিখাঁদ, অকৃত্রিম সৌন্দর্য যেন শ্বাস আটকে দিতে চায়। আর এর প্রাচীনত্ব রক্তে জাগিয়ে দেয় রোমাঞ্চের নেশা। চূড়াটিকে ঘিরে অহর্নিশি মেঘের এলোমেলো উড়াউড়ি যেন মনকে টেনে নিয়ে যেতে চায় কোনো অজানা কল্পলোকে, মেঘের ওপারের কোনো অচেনা রুপকথার রাজ্যে।
পাঠক, বলতে পারেন কিসের কথা বলছি?

বলছি মাউন্ট রোরাইমার কথা।  সুপ্রাচীন কোনো সভ্যতার চেয়েও প্রাচীন এই পাহাড়চূড়াটি অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে।

মেঘের ভেলায় ভাসছে মাউন্ট রোরাইমা; Image Source: pinterest

ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা আর গায়ানার সীমান্ত যেখানে মিলেছে এক মোহনায়, সেখানেই ঘন সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই পাহাড়চূড়ার অবস্থান। মাউন্ট রোরাইমার ভূতাত্ত্বিক গঠন খুবই অনন্য। এর চূড়া অন্যসব পর্বতের মতো তীক্ষ্ম আর খাড়া নয়, বরং সমতল!

মাউন্ট রোরাইমার সমতল চূড়া; Image Source: pinterest

এই ধরনের পাহাড়কে বলা হয় টেবিল-টপ মাউন্টেন। এই ধরনের পর্বতের বহুল প্রচলিত একটি নামও আছে। তা হচ্ছে টেপুই। আঞ্চলিক পেমন ইন্ডিয়ানদের দেওয়া টেপুই নামটির অর্থ ‘দেবতাদের আবাসস্থল’। আধিভৌতিক শোনাচ্ছে, তা-ই না?

সত্যিকার অর্থে মাউন্ট রোরাইমাই একমাত্র টেপুই নয়, গায়ানার উচ্চভূমিতে, বিশেষ করে ভেনিজুয়েলা এবং পশ্চিম গায়ানাতে অনেক টেপুই দেখতে পাওয়া যায়। তবে মাউন্ট রোরাইমা হচ্ছে সর্বোচ্চ টেপুই। এই অঞ্চলটি প্রকৃতপক্ষে মালভূমি। স্থানীয় আদিবাসীদের বিশ্বাস ছিল এই পাহাড়, পাহাড় ঘেরা অরণ্য, সিঙ্কহোল প্রভৃতিতে দেবতারা বাস করে, যারা অনেক গোপন জ্ঞান ধারণ করে আছে। এজন্যই তারা টেপুইয়ের নামকরণ করে ‘দেবতাদের আবাসস্থল’। মাউন্ট রোরাইমার ক্ষেত্রে এই উপকথা আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য। মেঘের উপর অবস্থান একে দেবতার ঘর হিসেবে কল্পনা করার জন্য ভালই প্রেরণা যুগিয়েছে।

পেমন ইন্ডিয়ানদের দেওয়া নাম ‘রোরাইমা’র ‘রোরাই’ শব্দটির অর্থ ‘নীল-সবুজ’ আর ‘মা’ অর্থ ‘মহান’। মাউন্ট রোরাইমা বাস্তবিকই বিশাল সবুজকে ধারণ করে আছে। সত্যিকার অর্থে এর বিস্তৃতি আদিবাসীদের কল্পনার চাইতেও বিশাল। মাউন্ট রোরাইমা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৮১০ মিটার (৯২২০ ফুট) উঁচু। এর চূড়া ৩১ বর্গ কি.মি. (১২ বর্গমাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চূড়াটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ৪০০ মিটার উচ্চতার পাথুরে পর্বতের দেয়াল।

মাউন্ট রোরাইমার খাড়া দেয়াল; Image Source: thegallivantpost.com

মাউন্ট রোরাইমা মূলত স্যান্ডস্টোনে গঠিত। মাউন্ট রোরাইমা ও অন্যান্য টেপুইগুলো গঠিত হয়েছিল প্রায় ২ বিলিয়ন বছর আগে, প্রিক্যাম্বিয়ান যুগে। এই অঞ্চলের টেপুইগুলো কোনো এক সুপ্রাচীনকালে একইসাথে ছিল। পরবর্তীতে মহাদেশগুলো একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাওয়ার সাথে সাথে টেপুইগুলোও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এবং এখানকার আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাত্যহিক বৃষ্টিপাতে টেপুইগুলো অনন্য জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। সবগুলো টেপুই-ই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তবে মাউন্ট রোরাইমা উচ্চতা ও বিশালত্বের কারণে একটু বেশিই অনন্য। এছাড়া আরো একটি কারণে এটি অনন্য। বিশ্ববিখ্যাত ঔপন্যাসিক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের কল্যাণে এটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে নিয়েছে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তার ক্লাসিক উপন্যাস ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ লেখার অণুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মাউন্ট রোরাইমা দেখেই।

‘The lost world’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: mgeveativeRamblings.com

বইটিতে বলা হয়েছে, সভ্য পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গায় এখনো অস্তিত্ব আছে ডাইনোসর, টেরোডেক্টাইলের মতো প্রাচীন ও অধুনালুপ্ত প্রাণীদের। সেই জায়গাটি অবস্থিত মেঘের উপর। সুস্পষ্টভাবেই তা মাউন্ট রোরাইমাকে নির্দেশ করে। এখানে ডাইনোসর হয়তো নেই, তবে বিচিত্র প্রজাতির এমন সব উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। সামনে সেগুলো নিয়েও কথা হবে।

মাউন্ট রোরাইমার বেশিরভাগ অংশ পড়েছে ভেনিজুয়েলায়। ভেনিজুয়েলা সরকার মাউন্ট রোরাইমাসহ বেশ কিছু প্রাকৃতিক আশ্চর্যকে নিয়ে এই অঞ্চলে গড়ে তুলেছে ক্যানাইমা ন্যাশনাল পার্ক। ৩০,০০০ হাজার বর্গ কি.মি. আয়তনের এই পার্কটিতে মাউন্ট রোরাইমা ছাড়াও রয়েছে আরেকটি অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক নিদর্শন। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জলপ্রপাত এঞ্জেল ফলস। টেপুইগুলোর চূড়ায় বৃষ্টিপাতের কারণে পুকুর, হ্রদসহ নানারকম জলাভূমি তৈরি হয়। এই জলাভূমিগুলোর জলই একসময় তীব্রবেগে বিশাল উচ্চতা থেকে মুক্তভাবে নিচে পড়তে থাকে। এই অঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ বেশ কিছু জলপ্রপাত রয়েছে। এঞ্জেল ফলস তাদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু।

এঞ্জেল ফলস

এই জলপ্রপাতের পানি ৯৭৯ মিটার উচ্চতা থেকে নিচে পতিত হয়।
এবার শুনুন মাউন্ট রোরাইমা আবিষ্কারের ঘটনাটি। মাউন্ট রোরাইমার কথা প্রথম বর্ণনা করেন ইংরেজ অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র‍্যালে। স্যার র‍্যালে তখন কিংবদন্তীর স্বর্ণনগরী ‘এল ডোরাডো’ খুঁজতে চষে বেড়াচ্ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা।

অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র‍্যালে; Image Source: Wikimedia commons

এই সময় গায়ানায় তিনি আবিষ্কার করেন মেঘের দেশের পাহাড় মাউন্ট রোরাইমা। সর্বপ্রথম মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় পা রেখেছিলেন আরেক ব্রিটিশ অভিযাত্রী স্যার এভেরার্ড ইম থুর্ন, ১৮৮৪ সালে । মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় ওঠার জন্য ভেনিজুয়েলার অংশে পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিক সিঁড়ির মতো আছে। সেই পথেই সাধারণত বেশিরভাগ অভিযাত্রী মাউন্ট রোরাইমায় আরেহন করে থাকেন। অন্য আরো কিছু পথ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ভীষণ বিপদসঙ্কুল। অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরাই কেবল পারেন এই পথগুলো পেরিয়ে মেঘের উপরে স্বপ্নলোকে পৌঁছতে।

মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায় একজন অভিযাত্রীর বিজয়োল্লাস; Image Source: Venezuela travel agency & tour operative

এখন চলুন জেনে আসি কী কী উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল মাউন্ট রোরাইমা।

মাউন্ট রোরাইমাতে আর দশটা টেপুই মালভূমির অনন্য প্রাণীগুলো তো রয়েছেই, রয়েছে এমন দুটি উদ্ভিদ যা কেবল মাউন্ট রোরাইমাতেই পাওয়া যায়। এদের পাওয়া যায় পাহাড়টির চূড়ায়। মাউন্ট রোরাইমার সমতল চূড়ায় বেশ কিছু পুকুর ও হ্রদ রয়েছে। এছাড়া বেলেপাথরের ভূমিতে স্বল্প মাটি ও মসের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা অল্প কিছু জঙ্গল। এই জঙ্গলেই দুর্লভ উদ্ভিদগুলো পাওয়া যায়। দুটি উদ্ভিদের একটি হচ্ছে মাংশাসী উদ্ভিদ হেলিয়াম্ফোরা।

মাংশাসী উদ্ভিদ; Image Source: pinterest

এর নলাকার পাতা শিকার ধরা ও মেরে ফেলার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। অন্যটি হচ্ছে Campenula গণের নীলরঙা ঘন্টাফুল।

দৃষ্টিনন্দন ঘণ্টাফুল; Image Source: travel2unlimited

পাহাড়চূড়ার বেশিরভাগ পুষ্টি উপাদান জলপ্রপাত আর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যায় বলে এখানকার উদ্ভিদগুলো পুষ্টির চাহিদা মেটাতে মাংশাসী হিসেবে অভিযোজিত হয়েছে। মাউন্ট রোরাইমা উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছেও তাই আকর্ষণীয় গন্তব্য। এখানে পাওয়া বিশেষ প্রজাতির কালো ব্যাঙ রোরাইমা বুশ টোড। দিবাচর এই ব্যাঙটিকে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়।

প্রাগৈতিহাসিক ব্ল্যাক ফ্রগ; Image Source: pinterest

মাউন্ট রোরাইমা বছরের যেকোনো সময় দেখতে যাওয়া যায়। তবে শুষ্ক মৌসুমে গেলে সুবিধা পাবেন। শুষ্ক বলতে আসলে শুষ্ক, সারাদিন ঝলমলে রোদ্দুর এমন আবহাওয়া এখানে কখনো পাওয়া যায় না। প্রতিদিনই কমবেশি বৃষ্টি হয় এখানে। অবশ্য মাউন্ট রোরাইমার মতো কোনো সুউচ্চ প্রাকৃতিক মালভূমির মাথায় চড়ে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দও তো অন্যরকমই হবে, তাই না?

তো মাউন্ট রোরাইমায় যেতে হলে প্রথমে উড়ে যেতে হবে ব্রাজিলের সীমান্তবর্তী শহর সান্তা এলেনাতে। এখান থেকে বাসে করে যেতে হবে পর্বতারোহণের জন্য উপযুক্ত স্থানে। সেটি হচ্ছে পারাই টেপুইয়ের পেমন গ্রামে। এখান থেকে হাইকিংয়ের মাধ্যমে পৌঁছানো যাবে চূড়ায়। বেশিরভাগ পর্যটক হাইকিংয়ের জন্য গাইড হিসেবে স্থানীয় কোনো পেমন ইন্ডিয়ানকে ভাড়া করে থাকেন। হাইকিংয়ের সময় খুব সাবধান থাকতে হবে, কারণ চূড়ার দিকে মেঘ ভেসে বেড়ায় বলে যেকোনো সময় দলছুট হয়ে হারিয়ে যেতে পারেন! হাংকিংয়ের সময় কোনো গাছ বা পাথর সরানো কড়াভাবে নিষিদ্ধ।

বিলিয়ন বছর ধরে টিকে থাকা জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ প্রাচীন এই মালভূমি পৃথিবী নামক গ্রহটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক নিদর্শন। প্রাগৈতিহাসিক অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে আপনি কবে যাচ্ছেন মাউন্ট রোরাইমায়?

লেখাঃ Sabrina Sumaiya – সূত্রঃ রোয়ার মিডিয়া।