সেই রাতে আর ঘুম আসছে না

4028
0

লিচু আমার অনেক প্রিয় একটি ফল হওয়া সত্বেও ফাজিল পোকার যন্ত্রণায় কোনোদিন শান্তিতে খেতে পারি না। যতই ভালো মানের লিচু এনে দিক, আমি টেনে ছুললেই পোকা সেখানে উপস্থিত! উঁকি দিয়ে বেইলি ড্যান্স মেরে বলে “হাই.. লিচু খাবা? খুব ট্যাশ!” মুহূর্তেই খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

লিচু নিয়ে মহা বিপদে পড়েছিলাম পাত্রী দেখতে গিয়ে। আমার এরেঞ্জ বিয়ের আলোচনা চলছিল। দেখাদেখি খাওয়াদাওয়া সব পর্ব শেষ, কথাবার্তার আগাচ্ছে, এমন সময় মেয়ের মামা এসে হাজির। সেই দূর দিনাজপুর থেকে এসেছেন তাই পৌঁছাতে উনার একটু লেট হয়ে গিয়েছে। সাথে করে ব্যাগ বোঝাই লিচু নিয়ে এসেছেন। তার বাড়ির গাছের লিচু, পাত্রপক্ষকে না খাওয়ালে কি চলে? কিছুক্ষণের মধ্যে লিচু টেবিলে এসে হাজির! মামা নিজেই নিজের গাছের প্রশংসা শুরু করে দিলেন, একেতো দিনাজপুরের লিচু তার মধ্যে তাদের গাছের লিচু নাকি পুরো এলাকাজুড়ে সুনাম । এসব বলে বলে.. সবার দিকে লিচু এগিয়ে দিচ্ছেন। আমাকেও বাধ্য হয়ে নিতে হলো। আসলেই লিচু গুলো দেখার মতো ছিল, যেমন তার রঙ তেমনি তার সাইজ। এত শুনাম যেহেতু, মনেমনে আশাকরলাম পোকা থাকবে না। যেইমাত্র বোটা টেনে ছুলেছি আমার সকল ধারণা ভুল প্রমাণ হয়ে গেল। দেখলাম এখানে লিচুর স্বাস্থের সাথে পোকার স্বাস্থ্য সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে! এমন লিচুও যেমন দেখিনাই এমন সাইজের লিচু পোকাও কোনোদিন দেখি নাই। আমি রেখে আরেকটা নিলাম, পাত্র হওয়াতে সবার নজর তখন আমার দিকে। এভাবে পরপর দুইটা লিচুর খোসা ছুলিয়ে রেখে দিলাম।

অনেকে আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মামা বলে উঠলেন খেয়ে দেখ বাবা, অনেক ভাল জাতের লিচু। আমি মাথা নেড়ে তৃতীয় লিচুটা হাতে নিলাম। মানসম্মানের বিষয়, মনেমনে দুয়া করলাম এটা যেন ঠিক থাকে। ছুলে দেখি পরিষ্কার! যাক, বাঁচা গেল, কামড় একটা বসিয়েছি, পুরো মুখ রসে ভরে গেল, অমায়িক স্বাদ! এমন সময় ছোট বোনের কথা মনে পড়ে গেল, আমার ছোট বোন আমার থেকে এসব বিষয়ে দুই ডিগ্রি বেশি সেনসেটিভ, সে আমাকে একদিন প্রমাণ করে দেখিয়েছিল লিচু পোকা শুধু বোটার কাছে নয় ভেতরেও অনেক সময় থাকে! কথাটা মনে পড়ায় দ্বিতীয় কামড় বসানোর আগে একটু নাড়িয়ে দেখলাম। দেখি সত্যি সত্যি সাদা পোকা বিচির ফুটো থেকে মাথা বের করে নীরবে বলছে.. টুকি!জামাইবাবু! দিনাজপুরী লিচু খাচ্ছ?” সাথে সাথে লিচু হাত থেকে পড়ে গেল। এরপর কতজনে কত ভাবে আমাকে লিচু সাধলো, আমি আর একটা লিচুও হাতে নিলাম না। বসে বসে বাকিদের লিচু খাওয়া দেখলাম। দেখি একেক জনে দুই আঙুলে চিমটি মেরে পোকা বাটিতে রেখে লিচু খেয়ে যাচ্ছে। আমার পাত্রীও এভাবে লিচু খাচ্ছিলো। কেউ আবার পুরো লিচু চোখ বন্ধ করে মুখে ভরে নিচ্ছিলো। আমার চোখ তখন বাটির দিকে, দেখছি পোকা গুলো বাটির উপর বুক ডাউন দিয়ে চক্রাকারে ঘুরে বেরাচ্ছে!

বাসায় ফিরে এসে পাত্রীর সাথে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। আমি নাকি লিচু না খেয়ে তার মামাকে ঘোর অপমান করেছি। এতো ঝগড়া সহ্য করতে না পেরে দিলাম বিয়েটা ভেঙে! অমন পোকা ছোঁয়া মেয়েকে বিয়ে না করাই ভালো। এরপর তিন মাস অনেক খোজাখুজির পর মনের মতো পাত্রী পেয়ে যাই। পাত্রীর সাথে কথাবার্তা বলে বুঝলাম মেয়ে সাংঘাতিক ভিতু প্রকৃতির। এতটাই ভিতু যে সামান্য টিকটিকি দেখেও ভয় পায়। তাই এই টপিকে আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। দেরি না করে বিয়েটা করে ফেললাম।

বিয়ের দুইদিন পর গেলাম শ্বশুর বাড়ি। শুরু হয়ে গেল তাদের জামাইআদর, খাবারের পদের অভাব নেই। শাশুড়ি আম্মা সারা বেলা পরিশ্রম করে হরেকরকমের খাবার রান্না করলেন। খেতে বসে আমার পাতে রুই মাছের মাথা তুলে দিলেন, তরকারি সবজি দিলেন, আরও আইটেম আনতে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। খাওয়ার একপর্যায়ে আমি থেমে গেলাম। গলা দিয়ে ভাত আর নামছে না, তাকিয়ে দেখি তরকারিতে ফুলকপির সাথে মোটাতাজা একটি লার্ভাপোকা সিদ্ধ হয়ে জড়িয়ে আছে। কি করবো বুঝতে না পেরে বউকে ডাকলাম। বউ পাশে এসে বসলো.. “কী হইছে?” আমি তাকে পোকাটি দেখিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম.. “আসলে আম্মাতো অনেক কষ্ট করে রান্নাবান্না করছে ব্যাস্ততার মাঝে দেখতে পায়নি, একটু ভুল করে ফেলছেন, আম্মাকে বইলো না লজ্জা পাবে, ভাতটা চেঞ্জ করে দেও” বউ অবাক হয়ে বলে.. “ওমা! এটাতো ফুলকপির ফুলপোকা এটা তোমরা খাওনা?” আমি বউয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি! কী বললা তুমি? “আরে এটাতো ফুলপোকা মসলার সাথে সিদ্ধ হয়ে গেছে, অনেক মজা” এই বলেই সে প্লেট থেকে তুলে ডাইরেক মুখে ভরে নিলো। এরপর চাবিয়ে চাবিয়ে খেতে খেতে রুমে চলে গেলো। আমি কিভাবে যে বাকি খাবারটা শেষ করেছিলাম একমাত্র আমিই ভালো জানি।

সেই রাতে আর ঘুম আসছে না। মাঝরাতে নিজের কপাল চাপড়াচ্ছি আর বলছি এটা আমি কোন ফ্যামিলির মেয়ে বিয়ে করলাম? এর থেকে লিচু ওয়ালী মেয়ে শতগুণে ভালো ছিল। তারা তো পোকা হাতে নিয়ে ফেলে দিত, এরা তো দেখছি আস্ত পোকা খাদক! নিশ্চয়ই সেই পাত্রী বিয়ে ভাঙার জন্য আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল, তাই আমার আজ এই দশা। আফসোস করতে করতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। রাতে স্বপ্নে দেখলাম সেই পাত্রীটা বউ সাজে আমার বিছানায় হেলে শুয়ে আছে! পায়ে পা তুলে এক হাতে লিচুর থোকা নাড়িয়ে চাড়িয়ে বলছে.. কী গো মশাই? কেমন লাগে এখন, হ্যা? আমার লিচুতো খাইলেন না.. খুব ট্যাশ ছিলো, হুহ!

লেখাঃ Md Shahadat Hossain