একটু ভাবুন তো, আপনার কাছে সুখের অর্থ কী?
এলিজাবেথ গিলবার্টের বিখ্যাত অনুপ্রেরণামূলক বই ‘ইট, প্রে, লাভ’। তার কাছে সুখের মানে মানুষের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা।
“সুখের জন্য যুদ্ধ করুন, সংগ্রাম করুন, কামড়ে ধরে থাকুন, সারা পৃথিবী চষে ফেলুন সুখের খোঁজে! সুখ পেতে আপনাকে হয়তো করুণ কঠিন প্রতিযোগিতার মাঝে দিয়ে যেতে হবে। আর একবার অর্জন করা হয়ে গেলে সুখের সমুদ্রে ভেসে থাকার জন্য নিরন্তর সাঁতার কাটতে হবে আপনাকে, যদি না করেন, চুঁইয়ে পড়বে আপনার সন্তুষ্টি, শেষ হয়ে যাবে সুখ।”
নিরন্তর প্রচেষ্টার এই পদ্ধতি কারো কারো জন্য কাজ করতে পারে, তবে সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে ভিন্ন তথ্য। এই পদ্ধতি অধিকাংশের ক্ষেত্রেই উল্টো ক্ষতি ডেকে আনে। সাথে আসে চাপ, একাকিত্ব ও ব্যক্তিগত পরাজয়। এই দর্শন অনুযায়ী, সুখ হলো লাজুক কোনো বুনো পাখির মতো, ধরতে গেলে সে উড়ে যাবে।
ধরুন, আজ আপনার জন্মদিন। আশেপাশে সবাই আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু আপনার কাছে এসবকে চাপ মনে হচ্ছে। অথবা এমন উৎসবের দিন, সবকিছুকে মেকি লাগছে।
এমন অনুভূতি কিন্তু আপনার একার নয়, অনেকেই এমন ঝামেলায় ভোগেন।
আত্মউন্নয়ন নাকি আত্মপীড়ন?
আইরিস মস ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে মানুষের সুখ নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারছে সুখ খুঁজতে গিয়ে অসুখী হয়ে পড়া মানুষদের মনের অবস্থা। দিতে পারছে কিছু সমাধান, যাতে আপনি জীবনের অন্যান্য মহৎ কাজে সফল হতে পারেন।
তিনি বলেন, আমেরিকায় বিগত কয়েক দশকে মোটা মোটা যত আত্মোন্নয়ন সম্পর্কিত বই প্রকাশিত হত, সব দিয়েই তিনি অনুপ্রাণিত হতেন। বইগুলোতে সুখকে মানুষের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে উল্লেখ করা হতো। সুখ কোনো অনুভূতি নয়, বরং সুখী হওয়া একরকম দায়িত্ব বলে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো মানুষের।
তিনি আরও বলেন,
“এসব পড়ে মানুষের জীবন নিয়ে একধরনের উচ্চাশা তৈরী হতে পারে, তাদের মনে হতে পারে, আমাকে সবসময় সুখী হতে হবে, পরম সুখী! যখন সে পরম সুখী হতে চেষ্টা করে, তার জীবনের সব ছোটখাটো কমতি বড় হয়ে ধরা পড়ে তার চোখে। কেন সে সুখী হতে পারছে না, এটা ভেবে নিজের কমতিকে, তথা নিজেকে দোষ দিতে থাকে একসময় পরাজিত হয়ে যায়”
কোন বুঝতে না শিখতেই একটা বাচ্চাকে ঠেলে দেওয়া হয় পরীক্ষার প্রতিযোগিতায়। একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে সে যখন লেখাপড়া শেষ করে, তারপর চাকরির প্রতিযোগিতা, গাড়ি বাড়ির হিসাব, তুলনা। এসব ভুল প্রেমের মোহ কাটতেই জীবনের সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে, মনে পড়ে, কিছুই করা হয়নি।
সুখের সংজ্ঞা সবার কাছে আলাদা। যখন আপনি অন্যের দৃষ্টিতে নিজের সুখকে মাপতে শুরু করবেন, আপনি আগে যে অনুষ্ঠানগুলোতে খুশি হতেন, সেসব থেকে আপনার মন উঠে যাবে। জেনে রাখা ভালো, বিখ্যাত সব অবস্থানে থাকা বড় মোটিভেশনাল স্পিকারদের অনেকেও নিজ জীবনে ভুগছেন বিষণ্নতায়।
মস প্রশ্ন তৈরি করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের উপর গবেষণার প্রথম ধাপ চালান। প্রশ্নের উত্তর থেকে বেরিয়ে আসে এমন তথ্য- সুখ সম্পর্কে যে যত জটিল আবেগ নিয়ে চলছে, সে-ই তার বর্তমান জীবন নিয়ে তত অখুশি। কিন্তু এই পরীক্ষায় অনেকেই ছিলেন, যারা সুখ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে অত বইপত্র পড়েননি। ফলে তাদের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হচ্ছিল না যে, অতিসুখের চাহিদা নিশ্চিতভাবে আমাদের অসুখী করে তুলবে।
মস ভাবলেন তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে তাকে আদায় করতে হবে তথ্য। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। মস আর তার সঙ্গীরা দ্বিতীয় পরীক্ষার আয়োজন করলেন।
পরীক্ষা চললো কৃত্রিমভাবে মানুষের সুখকে কমানো যায় কিনা, এ নিয়ে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরদের অর্ধেককে একটা নকল সংবাদপত্র পড়তে দেওয়া হল, যেখানে সুখের নানা উপায় ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা বিশদ রচনা ছিল। বাকি অর্ধেকের পত্রিকায় ছিল বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা।
এরপর অংশগ্রহণকারীদের একটা সিনেমা দেখানো হয়। অলিম্পিক জেতার এক মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি দেখে তাদের অনুভূতি কী, তা জানতে চাওয়া হয়। ফলাফলে দেখা গেল, যারা সুখের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পড়ছিলেন, তারা এটা দেখে যথেষ্ট খুশি হতে পারেননি, কারণ কিছুক্ষণের জন্য তারা হয়ে উঠেছেন উচ্চাভিলাষী। তাদের কাছে সুখ আরও জটিল, এত সহজে সুখী হওয়াটা যেন মানায় না।
মনে করে দেখুন তো, কখনও কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছেন। সারাজীবন এই বিয়ে নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল আপনার। কী পরবেন, কীভাবে সাজবেন, কত আনন্দ করবেন! অথবা খুব আকাঙ্ক্ষিত কোনো ট্যুর। সেখানে গিয়ে কিংবা যাওয়ার পাঁচ মিনিট আগে আপনার সব উৎসাহ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মসের গবেষণা ব্যাখ্যা করছে আপনার জীবনের ঘটে যাওয়া এমন সব ঘটনার অনুভূতি ও কারণকে।
মস দেখিয়েছেন, সুখের আশা আপনার চরম একাকিত্বের ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তখন আপনি নিজের সুখানুভূতির জন্যে সামনের সব মানুষকে প্রশংসা করতে ভুলে যান। নিজের উপর লক্ষ রাখতে রাখতে আপনি হয়ে উঠতে পারেন আত্মকেন্দ্রিক।
শুধু মস নন, ২০১৮ সালের প্রথম দিকে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাম মাগ্লিও ও একিউং কিম খুঁজে পান, সচেতনভাবে সুখের কামনা সারাদিন আমাদের মাথার ভেতরে বাজাতে পারে, “সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে!” আগামীর সুখের চিন্তায় আপনার বর্তমান হয়ে উঠতে পারে কাঁটায় ভরা।
তারা তাদের গবেষণার একটি ধাপে অংশগ্রহণকারীদের বলেছিলেন ১০টি এমন কাজের কথা লিখতে, যা তাদের সুখ দেয়, উদাহরণস্বরূপ- তারা পরিবারের সাথে সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাটায়। তালিকা তৈরির পরিবর্তে অংশগ্রহণকারীরা এখানে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা সামনে এমন সুখের কাজ করবে, এটা না ভেবে কতক্ষণ করবে আর সেই সময়ে তারা আসলেও পরম সুখী হবে কিনা, এই নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।
মাগ্লিও বলেন,
“আমাদের সমস্যা হলো, সুখী থেকেও আমরা চিন্তিত হই, পরম সুখী আছি কিনা। যদিও বা কখনো নিশ্চিত হই, এই সুখকে টিকিয়ে রাখার চিন্তায় অসুখী হয়ে পড়ি। যে কাজগুলো আমাদের কাছে বোঝার মতো, সেই কাজগুলোই করে যাই।”
মাগ্লিও আরও বলেন, তাদের গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগা কোনো মানুষের জন্য টোটকা ওষুধ নয়। বিষণ্ণতা একটা রোগ, আর তার স্বাভাবিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
আবার তাদের গবেষণা সুখ নিয়ে ভাবতে নিষেধ করছে মানে এই নয় যে জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকতে বলছে। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যা আমাদের মানসিক শান্তি দেয়, যা আমাদের জন্য ভালোম তা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। যেমন নির্যাতনকারী জীবনসঙ্গীকে ছেড়ে আসা।
ব্যক্তিজীবনে যদি খুব বড় সিদ্ধান্ত বা দুর্যোগের সময় না থাকে, তবে সেক্ষেত্রে কাজ করবে এই গবেষণা। মাগ্লিওর মতে, সুখের সংজ্ঞায়ন ও ধারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক পরিবর্তন আনছে, ফলে সুখের নির্দিষ্ট ধরন তৈরী হয়ে যাচ্ছে আমাদের মাথায়। অন্যের সম্পাদিত ছবি, মেকি সুখের কথা দেখে তাকে নিজের চেয়ে সুখী ভাবাটা স্বাভাবিক।
আপনার যদি খেতে বসে মনে পড়ে, “অমুক আজ তমুক ফাইভ স্টারে খেয়েছে” তার অর্থ হলো, নিজের কাছেই নিজেকে আপনি ছোট করে তুলছেন। এই ছোট হওয়া থেকে বড় হওয়ার চিন্তা আসছে, তারপর নিজের ভেতর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন।
যদি কষ্ট এসেই পড়ে, তবে তাকে মেনে নেওয়ার চেয়ে তার সাথে যুদ্ধ করে ক্ষত বাড়িয়ে তোলা হয় শুধু। জীবনের চড়াই-উৎরাইকে সংগ্রাম নয়, বরং জীবনের স্বাভাবিক অংশ করে ভাবুন। মানুষের ইতিবাচক দিক বের করে তাদের প্রশংসা করুন, ভালোবাসা জানান। নিজের কাছেই ভালো লাগবে।
বর্তমান সময়ে সুখী হওয়ার গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা তথ্য অনুযায়ী সুখী হওয়া মানে থেমে যাওয়া। সুখ সুখ করে আহাজারি না করে বরং সুখের কথা ভাবাই বন্ধ করে দেওয়া। সুখ এখানে পাখির মতো নয়, বরং পৌরাণিক অদৃশ্য কোনো প্রাণীর মতো। সে আমাদের সামনেই থাকে, অথচ তাকে খুঁজতে আমরা পারলে সারা পৃথিবী চষে ফেলি!
লেখাঃ Sumya Arefin Arni | সূত্রঃ রোয়ার বাংলা