সন্তান

4456
0

“প্লিজ তানভীর!আপনি আমার কথা চিন্তা করবেন না।আরেকটা বিয়ে করে আমাকে মা হওয়ার পূর্ণতা দান করুন। হয়তো আপনার উপর আর অধিকার খাটাতে পারবো না,কিন্তু আপনার সন্তানের মা তো হতে পারবো।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো জান্নাত (আমার স্ত্রী)। মা না হওয়ার কষ্ট হয়তো ওকে তিলেতিলে শেষ করে দিচ্ছে, তা না হলে একটা মেয়ে কখনো নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের করে দেওয়ার কথা কখনো স্বপ্নেও ভাবে না। পনেরো বছরের সংসার জীবনে আল্লাহ পাক আমাদের এই একটা সুখ থেকে দূরে রেখেছেন। বাবা না হওয়ার কষ্টটা যে খুব একটা কম না তা বুঝানো সম্ভব না। তবে জান্নাতকে কখনো বুঝতে দিইনি।কি দরকার অযথা ওর কষ্টটাকে দ্বিগুণ করার।দিব্যি তো চলছে আমাদের চড়ুই_ভাতির সংসার।শুধু একটা সন্তান না থাকার কষ্ট সব সুখকে গ্রাস করে ফেলছে।

জান্নাতের কথায় বাস্তবে ফিরলাম,
—কি ব্যাপার কিছু বলছেন না কেনো?
—(নিজেকে স্বাভাবিক রেখে)বড্ড তো বলছ বিয়ে করে ফেলেন,কিন্তু একবারও কি এটা জানতে চেয়েছে আমি কি চাই?সবসময় শুধু নিজেরটা বুঝো।
—(মুখটাকে বাচ্চাদের মতো করে)আমি আপনার সুখের জন্যই বলছি,আপনি বাবা ডাক শুনতে পাবেন।আর আমার কথা বললে,অন্তত নিঃসন্তান উপাধি থেকে মুক্তি পাবো।(জোর করে মুচকি হাসার চেষ্টা, কিন্তু হাহাকারটা ঠিকই ঠোঁট কাপিয়ে বেরিয়ে আসলো)
—(খুব জোরে জড়িয়ে ধরে) এটার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে যে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলেই বাবা ডাক শুনতে পাবো?হয়তো আল্লাহ পাক আমার তাকদীরে বাবা হওয়াটা রাখেননি।আর আমি বেশ আছি,আলহামদুলিল্লাহ!আর কখনো এই ফালতু কথা বলে মুড নষ্ট করবা না,বুঝছ?
—(নিশ্চুপ)
—এই শুনো না!আমার না বড্ড মাথা ব্যথা করছে।
—আপনি আমাকে আগে বলবেন না!এতক্ষণ ধরে মাথা ব্যাথা নিয়ে শুয়ে আছেন।(বলেই মাথা টিপা শুরু করে দিয়েছে)

আইডিয়াটা কাজে লেগেছে, কে বলবে এখন!ওর মধ্যে এই মূহুর্তে আমাকে ছাড়া অন্য কোনো টেনশন আছে!একনাগাড়ে মাথা টিপে যাচ্ছে আর দোয়া পড়ে ফু তো আছেই।আলহামদুলিল্লাহ!এমন একজনকে জীবন সাথী হিসেবে পেয়ে।

দেখতে দেখতে আরো পাঁচটা বছর চলে গেছে। এর মধ্যে কয়েকশ বার বিয়ে করার কথা বলা হয়ে গেছে উনার,পাশাপাশি ডাক্তার_কবিরাজ তো আছেই।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশের পার্কটাতে বাচ্চাগুলোকে খেলা করতে দেখি।সাথে থাকে ওদের মা_বাবা।আজও এর ব্যাতিক্রম হয়নি,কিন্তু আজ বাচ্চাগুলোকে দেখে নিজের সন্তানের কথা ভিষণ মনে পরছে,আজ হয়তো এখানে আমার আর জান্নাতের সন্তানও থাকতো।পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করলাম,বুঝালাম,আল্লাহ যা করে বান্দার ভালোর জন্যই করে।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল,পকেট থেকে বের করে দেখি জান্নাত।রিসিভ করে,

—আসসালামু আলাইকুম।
—ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাই!(অপরিচিত মহিলা কন্ঠ)
—আপনি কে?জান্নাত কোথায়?(হাজারো টেনশন উঁকি মারছে,মেয়েটা এমনি কিছুদিন ধরে অসুস্থ)
—ভাই!আমি আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।ভাবি হসপিটালে, আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন।(হসপিটালের নামটা বলেই ফোনটা কেটে গেলো)

কয়েকবার ফোন করেও পেলাম না,মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে হয়তো।ভিষণ কান্না পাচ্ছে, কি হয়েছে ওর!খারাপ কিছু নাতো?এসব ভাবতে ভাবতে রিকশা নিয়ে হসপিটালে পৌঁছালাম।আমাকে নেওয়ার জন্যে লোক দাঁড়িয়ে ছিল হসপিটালের বাহিরে,তাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সে কোনো উত্তরই দিচ্ছে না।একটা কেভিনের সামনে এসে আমাকে ভিতরে যেতে বলল।কাঁপা কাঁপা হাতে কেভিনের দরজাটা খুলে ভিতরে ডুকে দেখলাম,কাউকে সাদা চাদর দ্বারা ঢেকে রাখা হয়েছে। সাথে সাথেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো।নিজেকে তারপরও ঠিক রাখার চেষ্টা করে সামনে যেয়ে মুখের দিকের চাদরটা উঠালাম।

দেখলাম,আমার প্রিয়তমা জান্নাত খুব শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। সেখানেই বসে পড়লাম,কান্না পাচ্ছে কিন্তু চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না।ডাক্তার এসে বলল, “খুব বেশি টেনশনের কারণে উনি স্টোক করেছেন।সরি, আমাদের কিছুই করার ছিল না।”

আরো চারটা বছর কেটে গেছে, জান্নাত আমার সাথে নেই কথাটা মনে করলেই নিজেকে নিঃস্ব লাগতো,মনে হতো বেঁচে থাকাটা কঠিন আমার জন্য। কিন্তু সন্তান ছাড়া যেভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পেরেছি তেমনভাবে ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়াও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে শিখে গেছি।এখনও খেতে গেলে জান্নাতকে খাইয়ে দেওয়ার কথা মনে পরে যায়।কিন্তু ঐযে আল্লাহ পাক যা করে বান্দার ভালোর জন্যই করে।

নিজের জানা কোরআনের আয়াত ও হাদীস দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করি, নইলে যে বাঁচব না।
রাসুল (সঃ) বলেন: “আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু বান্দার অকল্যাণ চাইলে তিনি তার গুনাহের শাস্তি থেকে বিরত রেখে কিয়ামতের দিন তার যথার্থ প্রাপ্য দেন।”
আরো এসেছে,
হযরত আয়েশা (রঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) বলেন, মুমিনকে যেকোনো বিপদই স্পর্শ করুক না কেন আল্লাহ তার বিনিময়ে তার গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি (চলতি পথে) পায়ে যে কাঁটা বিদ্ধ হয় (তার বিনিময়েও গুনাহ মাফ করা হয়)’ (বুখারী ও মুসলিম

রাসুল (সঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো বিপদে পড় আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন ‘ইন্নাল্ল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন’ (আমরা আল্লাহর জন্যই আর তাঁর নিকটই ফিরে যাব।) [সূরা বাকারাঃ ১৫৬] পড়বে এবং বলবে ”হে আল্লাহ, আমাকে আমার বিপদের প্রতিদান দিন এবং আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দান করুন”। আল্লাহ তাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।”

হ্যাঁ আমি বেঁচে আছি! আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, সারাদিনের জিকির এই দোয়াটিই,
“ইন্নাল্ল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন”

ইন শা আল্লাহ, দুনিয়ার অপূর্নতাগুলো, না পাওয়াগুলো আরো উত্তম রুপে আখিরাতেই ফিরে পাবো।

দুনিয়া তো শুধু পরীক্ষাশালা। এখানে কষ্টের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই তো পরকালে পাবো সীমাহীন শান্তি।

লেখা:জান্নাত_তানিয়া