রূপকথার জগত অ্যানিমেশনের নেপথ্যকথা

536
0

নব্বই দশকের pelangigame ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগেরই ছোটবেলাটা কেটেছে রূপকথা আর রাজরাজড়াদের গল্প শুনে। দূরদর্শনের সোনালী যুগ আসার পর শ্রবণের সাথে সাথে দর্শনের আনন্দ যুগিয়েছে নানা ধরনের কার্টুন। এগুলো কখনো দেখানো হয়েছে পর্বভিত্তিক আবার কখনো সিনেমা আকারে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের ধরণও বদলেছে। যার চূড়ান্ত উন্নীত রূপ হচ্ছে হালের অ্যানিমেশন মুভি বা সিরিজ।

তবে এই পথ পাড়ি দেয়াটা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। বরং বহু বছরের অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের ফলেই আজ এত চমৎকার সব অ্যানিমেশন দেখতে পাচ্ছে দুনিয়া। এর পেছনের ইতিহাসটা কজনই বা জানে? আজ সেই আড়ালে রয়ে যাওয়া গল্পটা নিয়েই নাহয় আলোচনা করা যাক।

অ্যানিমেশন শব্দটি এসেছে এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘অ্যানিমা’ থেকে। অ্যানিমা অর্থ আত্মা। অ্যানিমেশন শব্দটি ব্যবহার করা হয় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা’ এই অর্থে। কারণ এই মাধ্যমে ম্যানুয়ালি বা কম্পিউটারের সাহায্যে আঁকা স্থির ছবিগুলোকে চলমান করা হয়। প্রক্রিয়াটি কয়েকভাবে সম্পন্ন করা হয়। প্রথাগত দিক থেকে এটি পাঁচভাবে ঘটে থাকে।

১. ট্র্যাাডিশনাল অ্যানিমেশন
২. টুডি (2D) অ্যানিমেশন
৩. থ্রিডি (3D) অ্যানিমেশন
৪. মোশন গ্রাফিকস
৫. স্টপ মোশন

ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশনে ছবিগুলোকে প্রথমে চরিত্র এবং দৃশ্যাবলী আঁকিয়ে নিয়ে ধারাবাহিকতা অনুসারে পরপর সাজানো হয়। এরপর স্থির চিত্রগুলোকে থরে থরে সাজিয়ে চলমান করা হয়। টুডি (2D) অ্যানিমেশনকে ভেক্টর বেজড অ্যানিমেশনও বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও সেকেন্ডে কমপক্ষে ১২টি ফ্রেম ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে সবথেকে জনপ্রিয় হচ্ছে থ্রিডি (3D) অ্যানিমেশন। এটি মূলত কম্পিউটার নির্ভর প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে নিখুঁত এবং ডিটেইল কাজ করা যায়।

মোশন গ্রাফিকস একটি মিশ্র মিডিয়া। এটি ছবি, আর্টিকেল এবং আরও নানা বিষয়াদির মিশ্রণে নির্মিত হয়। ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিকভাবে পণ্য বিপণনে। স্টপ মোশন করা হয় প্রকৃত ছবি থেকে। নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে সেগুলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ ভিডিওর রূপ দেওয়া হয়। pertaslot

অ্যানিমেশনের বিভিন্ন চরিত্র। Image Source: nerdist.com

অ্যানিমেশনের ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসের মৃৎশিল্প থেকে যেটি বর্তমানে বিস্তার লাভ করেছে কম্পিউটার প্রযুক্তিতে। তবে প্রথাগত অ্যানিমেশনের গল্পটা শুরু হয়েছিল প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। অবশ্য অ্যানিমেশন নিয়ে এক্সপেরিমেন্টও কম হয়নি।

স্থিরচিত্রকে চলমান করে গল্পে রূপ দেওয়াটা তো আর চাট্টিখানি কথা না। তবে প্রথম সফলভাবে অ্যানিমেশন তৈরি করা হয় ১৮৩২ সালে জোসেফ প্ল্যাটোর হাত ধরে। ফ্যানাকিস্টোস্কোপ নামে একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স দিয়ে দৃষ্টিভ্রম তৈরি করা হয়। যেটাকে আয়নায় দেখলে ঘূর্ণায়মান মনে হতো।

১৮৩৪ সালে উইলিয়াম জর্জ হর্নার ব্যান্ড তৈরি করে ‘জোয়িট্রপ’ নামে একটি ঘূর্ণায়মান ড্রামের আবহ তৈরি করেন। এমিল রেনড ১৮৭৬ সালে অ্যানিমেশনের ধারাটাই বদলে দেন। হাতে আঁকা চরিত্রগুলোতে ব্যক্তিত্ব, উষ্ণতা এবং জীবন্ত অভিব্যক্তি দিয়ে অন্যরকম একটি ধারা তৈরি করা হয়।

হন্টেড হোটেলের পোস্টার। Image Source: wikimedia.commons

১৯০৬ সালে একটি সফল অ্যানিমেশন সিরিজ বাজারে আনে নিউইয়র্কের ‘পাইওনিয়ার ভিটাগ্রাফ কোম্পানি’। এরপর ব্ল্যাকটনও ‘স্টপমোশন কৌশল’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এভাবে তিনি ‘হন্টেড হোটেল’ নামক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানান।

এদিকে ফ্রান্সে এমিল কোলও ব্ল্যাকটোনের মতো অ্যানিমেশনের উন্নয়নে কাজ করছিলেন। যদিও তিনি ব্ল্যাকটোনের নিউজপেপার স্টাইল কার্টুন থেকে ভিন্নতর স্টাইলে কিছু করার চেষ্টা করছিলেন।

কমিকের জন্য রবিবারের সাময়িকীগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে অ্যানিমেশন কোম্পানিগুলোও কার্টুনিস্টদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে। ইলাস্ট্রেটররা অ্যানিমেটরে পরিণত হতে শুরু করে।

এরপর চরিত্র তৈরি, ডিটেইল যোগ করা, এক্সপ্রেশন নিয়ে কাজ সবকিছুই ধীরে ধীরে উন্নত হতে শুরু করে। জনপ্রিয় কিছু সিরিজ এবং চরিত্র তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলা যায় ওতো মেসমারের করা একটি বিড়াল চরিত্র। ‘ফেলিক্স’ নামের কালো বিড়ালটি তার বড় বড় চোখ আর অভিব্যক্তির জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ব্যাপারটা তরুণ ওয়াল্ট ডিজনির নজর এড়ায় না। মিসৌরির কানসাস সিটিতে ‘লাফ-ও-গ্রাম’ স্টুডিওতে তৈরি হয় ‘অসওয়াল্ড দ্য লাকি র‍্যাবিট’ চরিত্রটি। তবে এটি সরাসরি ফেলিক্সের অনুকরণে করা বলে তিনি এর স্বত্ব হারান। পরবর্তীতে তিনি এর কানের রূপান্তর ঘটিয়ে ‘মিকি মাউস’ চরিত্রটি তৈরি করেন।

স্টিমবোট উইলি। Image Source: Disney+

ডিজনির হাত ধরেই সর্বপ্রথম অ্যানিমেশন সবাক অবস্থা লাভ করে। ‘স্টিমবোট উইলি’ সিনেমাতে সর্বপ্রথম শব্দ যোগ করা হয়। এটি অ্যানিমেশন সিনেমাকে পরিপূর্ণ এবং জাদুকরী করে তোলে।

ওয়াল্ট ডিজনির চূড়ান্ত পদক্ষেপ ছিল ১৯৩৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘স্নোহোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডুয়ার্ফস’ মুভির হলিউড স্টাইলে মুক্তি। এমন না এটি নতুন কোনো ধারা ছিল। তবে এতে ফ্রেম টু ফ্রেম ডিটেইল কাজ দেখানো হয়। আর তাতেই হয় কেল্লাফতে!

স্নো হোয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডুয়ার্ফস (১৯৩৭)। Image Source: IMDb

আর কম্পিউটার বেজড অ্যানিমেশন সর্বপ্রথম বাজারে নিয়ে আসে ‘পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিও’। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় তাদের নির্মিত ‘টয় স্টোরি’। এই ধারাটি অ্যানিমেশনের নির্মাণ কৌশলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। সময় এবং শ্রমেরও সাশ্রয় হয় এতে। নিঁখুত এবং বিস্তারিত দৃশ্যপটের জন্য এই কৌশল দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

প্রথম কম্পিউটার বেজড অ্যানিমেশন ‘টয় স্টোরি’। Image Source: IMDb

এরপর সময়ের আবর্তনে বহু চড়াই উতরাই পার হয়ে গড়ে ওঠে অ্যানিমেশনের আলাদা ইন্ডাস্ট্রি। একসময় এটি শুধু বাচ্চাদের বিনোদন আর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও এখন সব বয়সী মানুষের কথা মাথায় রেখে অ্যানিমেশন তৈরি হয়।

দর্শক বাড়ার সাথে সাথে অ্যানিমেশনের উন্নয়ন নিয়ে কিভাবে কাজ করা যায় সেই ব্যাপারে আরও মনযোগী হয় নেপথ্যের কারিগরেরা। বর্তমানের তিনটি শীর্ষ অ্যানিমেশন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডিজনি, পিক্সার এবং ড্রিম ওয়ার্কস।

বাংলাদেশের প্রথম জনপ্রিয় এনিমেশন মন্টু মিয়ার অভিযান। Image Source: wikimedia.commons

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ইদানিং বাংলাদেশও অ্যানিমেশন তৈরিতে ঝুঁকেছে। যদিও এই সেক্টরে বাংলাদেশ নতুন নয়। মীনা কার্টুনের পর বাংলাদেশে ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এছাড়াও ‘মুরগী কেন মিউট্যান্ট’, ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘টুমোরো’ বাংলাদেশের জনপ্রিয় কয়েকটি অ্যানিমেশন। পুরোনো দিনের রূপকথাগুলোকে অ্যানিমেশন আকারে তুলে ধরতে কাজ করছে ‘মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও’।

সিনেমার একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে এটি অস্কারের মঞ্চেও অংশ নিতে পারে। নানান ক্যাটাগরিতে অস্কার জেতে। ভাবা যায়! কি সহজ সাধারণভাবে শুরু হয়ে একটা অসাধারণ বিনোদন মাধ্যম তৈরি হয়ে গেছে!

এত এত চমৎকার সব অ্যানিমেশন রয়েছে যে তালিকা করলে শেষ হবে না। নিত্যনতুন অ্যানিমেশন যোগ হচ্ছে এই তালিকায়। বাচ্চাবুড়ো সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করে প্রতিটি কাহিনী।

সত্যিই এই আশ্চর্য মাধ্যম আমাদের বিনোদনে যোগ করেছে এক অপূর্ব মাত্রা। চমকপ্রদ এক ইতিহাসের পরিণতি আমরা উপভোগ করছি এই একবিংশ শতাব্দীতে।

 

Feature Image: deviantart.com 
Reference:

01. Animation. 
02. A Guide to The History of Animation 
03. Quick History Animation.