অখন্ড ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত যেসব মুসলমানরা এসেছিলেন, তাদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক শ্রেণীর মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্যেশে এসে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাদের মধ্যে কতক পীর, দরবেশ, ফকির শুধুমাত্র ইসলামের বাণী প্রচারের জন্যই আসেন এবং সারা জীবন এখানেই কাটান। আরেক শ্রেণীর মুসলমান এসেছিলেন দেশজয়ের আকাঙ্খায় বিজয়ীর বেশে। তাদের বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়।
৭১২খৃস্টাব্দে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুরাজ দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে সিন্ধু প্রদেশ জয় করেন। এটা ছিল মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক বিজয়। তাঁর বিজয় সিন্ধুপ্রদেশে থেমে থাকেনি বরং তা বিস্তার লাভ করে পাঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত সামরিক অভিযান পরিচালনার কাজ বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে কয়েকবার সিন্ধু প্রদেশের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিন্ধু অভিযানের সূচনা হয়।
পঞ্চদশ হিজরীতে হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের আমলে উসমান ইবনে আবুল আবী সাকাফী বাহরাইন ও ওমানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। উসমান আপন ভাই হাকামকে বাহ্রাইনে রেখে নিজে ওমান চলে যান। সেখান থেকে তিনি একটি সেনাবাহিনী ভারত সীমান্তে প্রেরণ করেন। উক্ত অভিযানের পর পুনরায় তিনি তাঁর ভ্রাতা মুগীরাকে সেনাবাহিনীসহ দেবল (বর্তমান করাচী) অভিমুখে প্রেরন করেন। মুগীরা সিন্ধুর জলদস্যু ও তাদের সহায়ক শক্তিকে পরাজিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
হযরত আলী (রাঃ)-এর খেলাফতের সময় ৩৯ হিজরীর প্রারম্ভে হারীস ইবনে মুররা আবদী সিন্ধু সীমান্তে অভিযান পরিচালনা করে জয়ী হন। আমীর মুয়াবিয়ার শাসনামলে মুহাল্লাব ইবনে আবু সুফরা সিন্ধুর সীমান্ত আক্রমণ করেন এবং মুলতান ও কাবুলের মধ্যবর্তী স্থান বান্না ও আহওয়াজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। খলিফা ওয়ালিদের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইফসুফ ইরাকের গভর্ণর নিযুক্ত হলে তিনি সিন্ধু অভিযানের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ইবনে হারুন নসিরী, উবায়দুল্লাহ ইবনে নবহান এবং বুদায়েল ইবনে তোহফা বজলীকে পর পর প্রেরণ করেন। অবশেষে ৯৩ হিজরীতে (৭১২ খৃস্টাব্দ) মুহাম্মদ বিন কাসিম জল ও স্থল উভয় পথে অভিযান পরিচালনা করে সিন্ধু জয় করেন। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বে মুসলমানগণ এখানে স্থায়ী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি। সিন্ধুরাজের সহায়তায় জলদস্যু কর্তৃক মুসলিম বণিকগণ বার বার লুন্ঠিত হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করে লুন্ঠিত দ্রব্যাদির পুনরুদ্ধার ও বন্দি বণিকদের মুক্ত করার পর মুসলমানগণ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
বাংলায় মুসলমানদের আগমন দূর অতীতের কোন সময়ে হয়ে থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছিল তৎকালীন ভারতের সম্রাট কুতবুদ্দীন আইবেকের সময়ে, মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জীর বাংলা জয় করার মধ্য দিয়ে। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জী ১২০০ মতান্তরে ১২০৩ খৃস্টাব্দে প্রায় বিনা বাধায় প্রাপ্ত সেন রাজত্বের একাংশ রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জী কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পর থেকে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, আফগানিস্তান, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে অসংখ্য মুসলমান ধারাবাহিকভাবে আগমন করতে থাকেন। অধিকাংশই মুসলিম শাসনাধীনে সৈনিক হিসেবে এসেছিলেন। বাকি অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলাম প্রচার ও আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে আসেন। এভাবে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছিল। কিন্তু এসবের অনেক আগে এদেশে ইসলামের বীজ বপন করা হয়েছিল এবং সে বীজ অংকুরিত হয়ে পরবর্তীকালে তা যে একটি মহীরুহের আকার ধারণ করেছিল তাও এক ধ্রুব সত্য।
ইসলামের আগমনের পূর্বে আরববাসী শুধু অনগ্রসর, দান্ধিক ও রক্তপিপাসু জাতিই ছিল না, বরং তাদের মধ্যে যারা ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী, তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। মরুময় দেশে জীবন ধারণের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের উদ্দেশে তাদেরকে বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো। স্থলপথে উটের সাহায্যে ও জলপথে নৌযানের সাহায্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতো। প্রাক-ইসলামী যুগেই তারা সমুদ্রপথে আবিসিনিয়া ও সুদূর চীন দেশ পর্যন্ত তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল।
আরব-চীনের মধ্যে তাদের কয়েকটি ঘাঁটিও ছিল। এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার। হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর জন্মের বহুকাল আগে অধিকসংখ্যক আরব বণিক এদেশে (মালাবারে) আগমন করেছিলেন। তারা প্রতিনিয়ত এ পথ দিয়ে অর্থাৎ মালাবারের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এর থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক ইসলামী যুগেই মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি স্থানে আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল।
খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) আরবের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং চল্লিশ বৎসর বয়সে সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এই ইসলাম প্রচার আন্দোলন ছিল অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক। এ বিপ্লবের ঢেউ আরব বণিকদের মাধ্যমে মালাবার, চীন, সুদুর চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যন্ত এসে পৌছেছিল। মালাবারের আরববাসীগণ খুব সম্ভব হিজরী সনের শুরুতেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, সপ্তম শতক পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল আরব বণিকদের দ্বারাই।
মালাবারের পরেই মুসলিম আরব মুহাজিরদের বাণিজ্য পথের অন্যান্য ঘাঁটি চট্টগ্রাম ও সিলেটের কথা আসে। মালাবারে আরব মুহাজিরদের স্থায়ী বসবাসের পর তাদের অনেকেই চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসার সূচনা করে, এখানেও তাদের অস্থায়ী বসতি গড়ে উঠে। এটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মালাবারে যেমন প্রথম হিজরী শতকেই ইসলাম দানা বেধেঁছিল, চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার কি সমসাময়িক কালেই হয়েছিল, না তার অনেক পরে। এ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন করা সম্ভপর নয়। তবে খৃস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে আরবের মুসলমান বণিকদের চট্টগ্রামের সাথে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা প্রমাণ সাপেক্ষে নির্ভূলভাবে বলা যেতে পারে।
চট্টগ্রামে কয়েক শতাব্দী যাবত মুসলমান বসবাস করলেও তারা কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্টা লাভ করেননি। তাদের কাজ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচার। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিল্জী কর্তৃক বাংলায় মুসলমান শাসন কায়েমের অনেক পরে সোনার গাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯ খৃঃ) সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করে তা মুসলিম শাসনের অন্তর্ভূক্ত করেন।
চট্টগ্রামকে সাধারণত গণমানুষের কাছে বার আউলিয়ার দেশ বলে অভিহিত করা হয়। এই বার আউলিয়ার মধ্যে দশ জনের নাম চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলসমূহের সর্বসাধারণের মুখে মুখে শোনা যায়। যথাক্রমে- সুলতান বায়েজীদ বোস্তামী, শেখ ফরিদ, বদর শাহ, কতল পীর, শাহ মহসিন আউলিয়া, শাহ পীর, শাহ উমর, শাহ বাদল, শাহ চাঁদ, শাহ জায়েদ প্রমুখ।
আনুসাঙ্গিক তথ্যাদিবলে এ কথা অনুমিত হয় যে, এসব আউলিয়া একসঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন নি। সম্ভবত তাঁরা দুই-তিনজন এক সঙ্গে অথবা পৃথক পৃথক ভাবে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। চট্টগ্রামবাসী এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, পীর বদর শাহ, কতল পীর এবং মহসিন আউলিয়া সম্ভবত সর্বপ্রথম একসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন করেন। এ জনশ্রুতির সত্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধান করেও তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে কতকগুলি প্রমাণ সাপেক্ষে একথা বলা যায় যে, এই তিনজন দরবেশ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মুহাম্মদ শাহের সময়ে সিলেটের গৌড়রাজ্যে কয়েক ঘর মুসলমান বসবাস করতেন। গৌড়ের রাজা ছিলেন গৌড়গোবিন্দ। জনশ্রুতি আছে, রাজা গৌড়গোবিন্দের রাজ্যে শেখ বুরহান উদ্দিন নামীয় এক মুসলমান বসবাস করতেন। শেখ বুরহান উদ্দিনের পুত্রের আকিকা উপলক্ষ্যে জবাই করা গরুর হাড় বা মাংসপিন্ড কাক বা শকুন বহনকারীর মুখ থেকে অকস্মাৎ রাজবাড়ির সম্মুখে পড়ে গেলে রাজা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকীর্ণতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সত্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়ে বুরহান উদ্দিনের দু’হাত কেটে ফেলে ও তার পুত্রকে হত্যা করেন। বুরহান উদ্দিন তখন সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মুহাম্মদ শাহের কাছে গিয়ে ন্যায় বিচার চাইলে, সুলতান তাঁর ভাতিজা সিকান্দর শাহকে সৈন্যসমেত গৌড় অভিমুখে প্রেরণ করেন। সিকান্দর শাহ গৌড় রাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে থাকেন। পথিমধ্যে হযরত শাহ জালাল (রঃ)-এর সাথে দেখা হলে তাকে সবকিছু অবহিত করেন।
১৩০৩ খৃস্টাব্দে হযরত শাহ জালাল (রঃ) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইয়ামেন থেকে সিলেট অভিমুখে আগমন কালে রাজার এহেন ঔদ্বৈত্য পূর্ণ অন্যায় আচরণে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হলে, তিনি তাঁর ৩৫৯ জন (সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে) সফর সঙ্গী নিয়ে রাজা গৌড়গোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই খবর পেয়ে রাজা গৌড়গোবিন্দ শাহজালাল (রঃ)-কে বাধা প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, হযরত শাহ জালাল (রঃ) তাঁর অলৌকিক কারামত প্রয়োগ করেন। রাজা গৌড়গোবিন্দ ফকিরের কারামতের কাছে টিকতে না পেরে রাজ্য ছেড়ে আত্মগোপন করেন। শাহ জালাল (রঃ) সিলেটেই ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবেশ করেন এবং সেখানে খান্কা প্রতিষ্ঠিত করে জনসাধারণের মাঝে ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। তাঁর শিষ্যগণ সিলেটসহ পার্শবর্তী অঞ্চল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, রংপুর, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও আসাম প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। অন্যান্য ধর্মে শ্রেণীভেদ ও বৈষম্যতার শিকার হয়ে, অনেক ক্ষেত্রে ঐক্য এবং নিরাপত্তা জনিত উদারতার ফলে অনেকেই ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
উপরোল্লিখিত ধারাবাহিকতাই বলে দেয়, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের আধিপত্য ও বিস্তার বাংলায় মুসলিম শাসনের অধীনে বিভিন্ন পীর, ওলী, দরবেশদের ধারাই সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকতা লাভ করে।
লেখাঃ আহমেদ হাসান, সূত্রঃ ইসলামী বার্তা।