প্রত্যেক সোমবারই জন্মদিন

4085
0

-নিজেদের জামাকাপড়ও ঠিকমতো গুছাইয়া রাখবার পারেন না আপনেরা! সবকিছু এতো অগোছালো কইরা রাখছেন! (খালা)
-আরে খালা..সময় কোথায় বলেন? সারাক্ষণই তো টিউশন,ক্লাস,এই সেই করে বাইরে থাকা লাগে..(রাফসান)
-তাও বাজান..কিছু কিছু কাজ তো নিজেরও করা লাগে.. (খালা)
-আপনি আছেন না খালা? আপনি তো দুইবেলা রান্না করে দেওয়ার পরে এগুলো প্রতিদিনই করে দিতে পারছেন.. আমাদের আর ট্যানশন কোথায়! (অনিক)
-সেইটা তো করিই..কিন্তু আপনেগো এনে কাম করা ছাড়াও আরো কতো জায়গায় কাম করা লাগে হিসাব নাই..এই যে বাসায় আইলেন, জুতাগুলা গুছাইয়া রাখতে পারেন..কিন্তু আপনেরা করলেন কি, মোজা একপাশে,জুতা একপাশে ফেইল্যা রাখছেন..খাওনের প্লেটগুলাও না ধুইয়া ফেইল্যা রাখছেন..আর ময়লা কাপড়চোপড় তো আছেই..
ছোটখাটো কামগুলা তো নিজেরাই কইরা ফেলতে পারেন..
জানি আপনেরা ব্যস্ত মানুষ..সবচেয়ে বড় কথা আপনেরা পোলাপাইন মানুষ..মাইয়া মানুষ হইলে না হয় এগুলা বুঝতেন বাজান..–কথাটা বলেই খালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন..

অনিক,রাফসান,নীল আর আয়ান এই চারজন একসাথে একটা ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকে..সবার পড়ালেখা প্রায় শেষের পথে..সারাদিনই ক্লাস,টিউশন,ঘোরাফেরা নিয়ে ব্যস্ত থাকে..ছেলেরা রান্নাবান্না না পারাটাই স্বাভাবিক..কিন্তু এই চারজন কোনোকিছুই পারেনা বা করেনা..
বলা যায় একটু অলস টাইপের কিংবা একটু বেশিই ডিপেন্ডেন্ট টাইপের..

তাদের সব কাজেরই একমাত্র ভরসা যেনো এই কাজের খালা..যদিও ওরা সকালের নাস্তটা বাইরে করে..তবে খালা প্রতিদিনই সকালবেলা এসে ঘর গুছানো থেকে শুরু করে কাপড়চোপড় পরিষ্কার করার মতো সব কাজ করে..রান্না তো আছেই..এরপর আবার সন্ধ্যার পরে এসে রাতের রান্নাটা করে দিয়ে যায়..

কিন্তু পাঁচদিন হলো কাজের খালা আসার নাম নাই..কি হলো না হলো কিছুই জানে না তারা..খালার ফোন নম্বর‍টাও রাখা হয়নি..খালার অসুস্থতা কিংবা অসুবিধা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই..তাদের মাথাব্যথাটা হলো তারা কোনোকিছুই ঠিকভাবে সামলাতে পারছে না খালার অবর্তমানে..জুতা কোথায়,মোজা কোথায়,এই প্যান্টটা কোথায়,ওই শার্টটা কোথায়,ইস্ত্রি করবে কিভাবে, রান্না করবে কিভাবে!!
এই পাঁচদিন তিনবেলাই তাদের বাইরে খেতে হয়েছে.. ডিমভাজি দিয়ে খেতে কার ভালো লাগে! কিন্তু ওরা ডিমভাজি ছাড়া আর কিছু পারেও না..
আজ এই কয়েকদিন পর খালা ফিরেছেন..চোখেমুখে কেমন যেনো ফ্যাকাশে ভাব..
নীল তো মাথা গরম করে বলেই ফেললো,
“খালা এই কয়েকদিন কোথায় ছিলেন? আপনি আসবেন না সেটা আগে বলে গেলেই পারতেন! জানেন, আপনি আসেননি বলে আমাদের কতো অসুবিধা হয়েছে? এরকম হলে আপনার আর আসার দরকার নেই..আমরা অন্য কাউকে ম্যানেজ করে নিতে পারবো..”

“আর হবে না বাজান..কিন্তু কাম ছাড়বার কথা কইয়েন না..আমার এই কামটা অনেক দরকারী..”– বলেই খালা কেমন জানি মুখ গোমড়া করে কাজে মনোযোগ দিলেন..!
রাফসান এবার নীলকে একটু থামিয়ে বললো,”আহ নীল..এতো মাথা গরম করছিস কেন! ঠান্ডা মাথায়ও জিজ্ঞেস করা যায় তো..”

-খালা,আপনার ফোন নম্বরটা দিয়েন তো..আপনার কোনো অসুবিধা হলে আমাদের জানাতে পারবেন, আবার আমাদের কোনো অসুবিধা হলে আমরাও আপনাকে জানাতে পারবো..(রাফসান)
-বাজান,আমার তো মোবাইল নাই..ফোন নম্বর কই পামু! চিন্তা কইরেন না..আমি এরপর থেইক্যা আর এরকম করুম না.. (খালা)
-আচ্ছা,খালা..আপনার ঠিক কি হয়েছিল? মানে, হঠাৎ করেই আসলেন না..কোনো অসুবিধা হয়েছিল? (আয়ান)
-আসলে হইছে কি….. বলেই খালা হুড়মুড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলেন..

অনিক এবার খালার কাছে গিয়ে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”আরে খালা কান্না করতেছেন কেন? আগে একটা জায়গায় বসেন..এরপর বলেন কি হয়েছিল..
কান্নাকাটি করিয়েন না..”
খালা এবার অস্পষ্ট সুরে ভাঙা কণ্ঠে বললেন,”বাজান, আমার পোলাডা মইরা গেছে..কয়েকদিন ধইরাই শরিলে অনেক জ্বর আছিল..ডাক্তারের কাছে নেওয়ার মতোন ট্যাকা তো আর নাই..জলপট্টি দিছি মাথায়..নাপা খাওয়াইছি..কিন্তু অসুখ কমবার নাম নাই..এরপরে ওইদিন রাতে যখন বাড়ি ফিরছি, দেখি শরিলডা এক্কেরে ঠান্ডা হইয়া গেছে..কাঁপতেছিল পোলাডা..আমি সূরা কালাম পইড়া ঘুম পাড়াইলাম..সকালবেলা দেখি আমার পোলাডা আর………….
এতোটুকু বলেই উনি শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেললেন..
ওরা চারজনই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খালার দিকে..কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না..নীল উনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”খালা এতোকিছুর পরেও আপনি আজকেই আসলেন কেন? কিভাবে সামলাচ্ছেন নিজেকে!”
খালা কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,”পেটের দায়ে বাজান.. সব পেটের দায়ে..”

সেদিন ওরা চারজন কেউই খালাকে কাজ করতে দেয়নি..নিজেরাই সব কাজ করেছে..এতোদিন খালা যখন কাজ করার সময় ওদের এই সেই বলে উপদেশ দিতো, তখন এসব তাদের কাছে প্যানপ্যানানি বলে মনে হতো.. অসহ্য লাগতো..আজ খালার জন্য খুব মায়া হচ্ছে তাদের..
অনিক আর আয়ান কিছুক্ষণ পরপর খালাকে হাসানোর চেষ্টা করছে..অন্যদিকে মোবাইলে রেসিপি দেখে দেখে রাফসান আর নীল রান্না করছে..সেদিন ওরা কেউ বাইরেই যায়নি..টিউশন, ক্লাসে একদিন না গেলে এমন আহামরি কিছু হয়ে যায় না..
আয়ান কিছুক্ষণ পর খালাকে জিজ্ঞেস করলো,”আচ্ছা খালা আপনার জন্মদিন কবে?”
–আমার আর জন্মদিন! এগুলা কি আর মনে আছে নাকি! (খালা)
–আহা খালা বলেন না..জন্মদিন আবার কেউ ভুলে যায় নাকি! (অনিক)
–তারিখ তো মনে নাই বাজান..এমনিতে সোমবার জন্মদিন এতোটুকু মনে আছে..কিন্তু কিসের জন্য? (খালা)
-না এমনিতেই জানতে ইচ্ছা হলো খালা.. (আয়ান)

এরপর দিন খালা এসে দেখলেন ঘর একদম পরিপাটি, সবকিছু একদম পরিষ্কার..অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার? আজকা দেখি আপনেরা একদম লক্ষ্মী পোলাপানের মতো হইয়া গেছেন! সব কাম কইরা রাখছেন..”
রাফসান হেসে বললো,”তো? আমরা তো লক্ষ্মী ছেলেই.. আচ্ছা খালা লক্ষ্মী তো মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়..ছেলেদের ক্ষেত্রেও কি হয়? নাকি ছেলেদের ক্ষেত্রে লক্ষ্মা হয়?”
-কি জানি বাপু! এতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার নাই..গুছানোর কাম তো আপনেরাই কইরা রাখছেন..আমি গিয়া জামাকাপড়গুলো ধুইয়া ফেলি.. (খালা)

যেই না খালা কাপড় ধোয়ার জন্য বাথরুমের দিকে গেলেন..দেখলেন নীল হাতে পায়ে ডিটারজেন্টের ফেনা লাগিয়ে প্রায় একাকার হয়ে আছে..সব কাপড়চোপড় ধুয়ে বের হচ্ছে.. খালা হেসে বললেন,”আরে নীল সাহেব যে! আপনি কাপড় ধুইতাছেন?? হায় খোদা যেই পোলাডা ঠিকমত গোসল করে কিনা সন্দেহ হয় আমার.. সেই পোলাই আজকা কাপড় ধুইতাছে!”

নীল একটু মুখ কুঁচকে বললো,”খালা,ভালো হবে না বলে দিলাম..আমি প্রতিদিনই গোসল করি..আর কাপড় ধুতে পারি না কে বললো! দেখেন সব কাপড় ধুয়ে আনলাম..”

খালা হেসে বললেন,”বাহ..আপনেরা দেখি সব কামই কইরা ফেলতেছেন নিজে নিজে..আমার করবার জন্য কি কিছু রাখছেন?” বলেই রান্নাঘরের দিকে গেলেন খালা..

রান্নাঘর থেকে আয়ান আর অনিক প্লেটে মাছ ভাজা নিয়ে বেরিয়ে এসে বললো,”ট্যান ট্যানা!! এই দেখেন খালা..নিজেরা করছি..মাছও নিজেরাই কাটছি.. আরো রান্না করছি..মাংসও হচ্ছে..”
“আরে বাজানেরা! আপনেগো কি হইছে বলেন তো! সব কাজই দেখি নিজেরা কইরা ফেলছেন..তাইলে আমি আর কি করুম!!”
রাফসান এবার ফ্রিজ থেকে একটা কেক বের করে বললো,”আপনি কেক কাটবেন..আর আমরা তালি দিবো..”
–সে কি? কেক কাটুম ক্যান? (খালা)
–কারণ আজকে সোমবার..যেহেতু আপনার জন্মদিনের তারিখ মনে নেই..সেজন্য প্রত্যেক সোমবারই আপনার জন্মদিন! (চারজনই একসাথে বলে উঠলো)

নীল এবার একটু জোরে জোরেই বললো,”আজকে সব কাজ করছি মানে কিন্তু এই না যে আপনার ছুটি খালা..প্রত্যেক সোমবার আর শুক্রবার আপনার ছুটি.. আর বাকিদিনগুলোতে আপনাকে আমাদের জন্য রান্না করতে হবে..”
খালা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,”শুধু রান্না করুম? আর কিছু করুম না?”
–না খালা..বাকি কাজগুলো আমরা নিজেদের গুলো নিজেরাই করে নিবো..আপনি রান্নার দিকটা দেখলেই হবে..প্রতিদিন তো আর রেসিপি দেখে দেখে রান্না সম্ভব না.. (অনিক)
–“আর শুনেন খালা, এখন থেকে এই মোবাইলটা আপনার..”– বলেই আয়ান একটা মোবাইল ফোন এগিয়ে দিলো খালার দিকে..
খালা তো যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেন না..অবাক হয়ে বললেন,”আমি এইডা নিতে পারুম না বাজান..এইসব আমি ক্যামনে ব্যবহার করে জানি না..আর এইসব ক্যান শুধু শুধু?”
–উফফ খালা খুব বেশি কথা বলেন আপনি.. আমরা শিখিয়ে দিবো এটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়.. (রাফসান)
খালা অঝরে কেঁদে চলেছেন..বারবার শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছছেন..তাও যেনো চোখের পানি শেষ হচ্ছে না..
ওরা চারজন এবার উনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”খালা আপনার ছেলেটা আজ নেই বলে কি হলো? আমরা আছি না? পারবেন না আমাদেরকে আপনার ছেলে বলে মেনে নিতে? পারবেন না খালা?”
খালা এবার চোখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে নিয়ে বললো,”খুব পারবো বাজান..খুব পারবো..”

ওদের সবার চোখেই অশ্রুকণা জ্বলজ্বল করছে..কেন করছে তার ব্যাখ্যা কেউই জানে না..তবে এটা যে সুখের অশ্রুকণা এটা সবারই জানা আছে..খুব ভালো করেই জানা আছে..
সবার মৌনতা ভেঙে রাফসান বলে উঠলো,”খালা আপনি কি এভাবে দাঁড়িয়েই থাকবেন, নাকি কেকটাও কাটবেন? তাড়াতাড়ি কাটুন না..”
এপাশ থেকে সবার হৈ হৈ ধ্বনি উঠলো,”হ্যাঁ হ্যাঁ খালা.. তাড়াতাড়ি করেন..ক্ষুধা লেগে গেলো তো..”

লিখাঃ Nusrat Jahan Eisha