তনুর বিয়ে

1983
0
Tonu Biye

জুম্মার নামাজ পড়ে এলাম। পাঞ্জাবী টা খুলতে খুলতে মাকে বললাম ভাত দাও। কিন্তু মা ভাত না দিয়ে একটা চকচকে ১০০০ টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দিলো।

-বাহ, চাইলাম ভাত পাইলাম টাকা! না চাইতেই দিয়ে দিলে? তাও আবার…..
-টাকাটা তোকে দেই নি।
-তো কাকে দিয়েছো?
-তোর বাবা দিয়ে গেছে। হামিদ মাস্টারের মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত আছে। দাওয়াত খেয়ে এই টাকাটা দিয়ে তোর বাবার নাম লিখিয়ে আসবি।
-এবার রীতিমত ধাক্কা খেলাম। যা শুনছি এসব সত্যি নয়তো?

তনুর সাথে পরিচয়টা ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। একদিন হামিদ স্যারের সাথে শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে এসে ঢুকলো। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে তানিয়া হামিদ তনু। ও কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করছে। ক্লাস থ্রিতে। আজকে খুব বায়না ধরলো সে আমার ক্লাস করবে তোমাদের সাথে বসে। তাই নিয়ে এলাম।
তনুর দিকে কয়েকবার তাকালাম, ওর ঠোটের নিচে ছোট্ট একটা তিল। দেখতে খুব ভালো লাগে। যেন কেউ ইচ্ছে করে কালো বলপেনে এঁকে দিয়েছে।

সকাল ৯ টা বাজে। ওলীপুর স্কুলের সামনে এখন আমরা ৬ টি স্কুলের ছাত্রছাত্রী এসে জড়ো হয়েছি। এক্ষুণি গেট খুলে দিলে সবাই প্রত্যেকের সিট খোঁজে নিতে হবে।
হামিদ স্যারের সাথে নীল রঙের জামা পড়ে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। আমি এগিয়ে গেলাম, ঠোঁটের নিচে সেই ছোট্ট তিলটা দেখে চিনতে অসুবিধা হয়নি যে এইটা হামিদ স্যারের মেয়ে তনু। মনে মনে ভাবতে লাগলাম ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় দেখেছিলাম প্রথমবার। আর আজকে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে এসে দ্বিতীয় বার দেখা। মাঝখানে কেটেছে মাত্র দুটি বছর। কিন্তু এই দুবছরে কি এমন খেলো মেয়েটা। কত্তো বড় হয়ে গেলো। আগের চাইতে আরো অনেক ফর্সা ও হয়ে গেছে। আগে শ্যামলা বলা চলতো। কিন্তু এখন দেখলে তো শ্যামলা বললে ভুল হবে। ঠিক শ্যামলা আর উজ্জ্বল রঙের মাঝামাঝি বলা যায় গায়ের রঙটা। ভাবতে লাগলাম আরো অনেক কিছু।
হামিদ স্যারের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে এলাম।

স্যার তনুর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

-মা, এই হচ্ছে রাকিব। আমার স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। ও এখনো পর্যন্ত কোন ক্লাসের কোন পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়নি। আমরা আশা করছি এবার সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে আমাদের এবং স্কুলের সোনাম বয়ে আনবে। আর রাকিব, তনুকে তো চিনই। আমার একমাত্র মেয়ে। সেও খুব ভালো ছাত্রী। আশা করছি সে ও বৃত্তিটা পাবে।

ততক্ষণে ঘন্টা বাজলো। সবাই যার যার সিট খোঁজে বের করলাম। কি আশ্চর্য, অলৌকিক ভাবে তনুর সিট কিনা পড়েছে আমার পাশেই!

যাই হোক প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষায় একে অন্যের দিকে তাকিয়েছি বহুবার। কিন্তু কোন কথা হলো না।
কিন্তু শেষ পরীক্ষার দিন পর্যন্ত মোটামুটি একটু বন্ধুত্ব টাইপের সম্পর্ক হয়ে গেলো।

মাস কয়েক পর রেজাল্ট এলো। আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। বাবা বাজার থেকে ৫ কেজি মিষ্টি কিনে আনলেন। সেখান থেকে কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে চলে গেলাম হামিদ স্যারের বাড়ি। সেখানে যাওয়ার পর তনু নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। সে ও বৃত্তি পেয়েছে।

ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম দুজন একই স্কুলে। নতুন স্কুলে প্রথম সপ্তাহ চলছে। একদিন এক স্যার এসে জিজ্ঞেস করলেন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছো কারা দাড়াও।
প্রায় ১৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আমি আর তনু ছাড়া আর কারো উঠে দাড়াবার সৌভাগ্য হয় নি। স্যার সেদিন খুশি হয়ে দুজনকে দুটি ডায়েরি গিফট দিলেন।

তারপর একসাথে আমরা মেট্রিক পাশ করেছি। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার জন্য আমি চলে যাই শহরের একটি কলেজে। আর তনু গ্রামে।

আজ সেই তনুর বিয়ে। একটিবারের জন্য শুনলাম ও না। ছুটিতে বাড়ি না আসলে হয়তো মায়ের কাছেও জানতে পারতাম না।

বেডরুমে চলে গেলাম। নিজের ব্যাগ থেকে বের করলাম স্যারের দেওয়া সেই ডায়েরিটা। পাতা উল্টে দেখলাম আর একটি পাতা বাকি আছে। বাকি সব পাতা লিখা আছে।
শেষ পাতাটায় লিখা শুরু করলাম-

“প্রিয় তনু
জাবেদ স্যার কিন্তু দুটো ডায়েরি দিয়েছিলেন। একটা তোমাকে আর একটা আমাকে। আমি আমার ডায়েরির একটা পাতাও নষ্ট করিনি। প্রতিটা পাতায় পাতায় একেকটা দিনের গল্প, একেকটা মুহুর্তের গল্প লিখে শেষ করে ফেলেছি। না গল্প নয়, শেষ হয়েছে ডায়েরির পাতা। জানো? আজ মাত্র একটি পাতাই খালি পেলাম। ৪৯৯ টা পাতায় একটা অসম্পূর্ণ প্রেমের গল্প লিখা আছে। যেখানে একটা ছেলে বারবার মেয়েটার প্রেমে পড়েছে। মেয়েটা কখনো বুঝেছে, কখনো বুঝে নি। কখনো আবার বুঝেও না বুঝে থেকেছে। কিছু মিষ্টি প্রেম, কিছু আলতু পরশ, কিছু ঘুমজাগা রাত, কিছু অভিমানের গল্পে ভরা আমার ডায়েরির ৪৯৯ টি পাতা। আজ ৫০০ তম পাতায় এসে সবকিছুর ইতি টানতে হচ্ছে আমাকে। আজ একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে খুব আমার ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায় যে তনুর বিচরণ, সে তনুর ডায়েরির কোন একটি লাইনেও কি আমার নামিটি আছে?
কি জানি হয়তো আছে। নয়তো না। আরো অনেক কিছু জানার ইচ্ছা ছিল, লিখার ছিল অনেক। কিন্তু ডায়েরি পাতা তো শেষ।
আর হ্যা গত ৯ টি বছরে যে কথাটা একবারও মুখে বলতে পারি নি। সেটি নাহয় কলমের কালিতে লিখে দিলাম।
অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
ভালো থেকো”

পাঞ্জাবিটা আবার গায়ে দিলাম। পকেটে ১০০০ টাকার নোটটি। হাতে ডায়েরিটা। দোকান থেকে গিফটের কাগজ কিনে ডায়েরিটাকে সুন্দর করে মোড়ালাম। এবার সোজা হাটা দিলাম তনুদের বাড়ির দিকে। খেতে ইচ্ছে হলো না একদম।

খাওয়ার জন্য যে অস্থায়ী জায়গাটা করা হয়েছে তার পাশেই টেবিল, তার উপর একটি বিড় থালায় পান সুপারি আর কিছু টিস্যু নিয়ে বসে আছে তনুর চাচাতো দুলাভাই।
১০০০ টাকার নোটটি দিয়ে বাবার নাম লিখালাম।
পরে আমার নামটি লিখিয়ে ডায়েরিটা দিতে যাব। এমন সময় ভিতরের মানুষটা কড়াভাবে নিষেধ করলো।
হয়তো এই ডায়েরিটা একদিন প্রিয় মানুষটার ঘর ভাঙার কারণ হবে। আর দিলাম না। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে চলে এলাম। নদীর পাড় ধরে হাটছি। সন্ধ্যা হয়ে এলো। মাথার উপর দিয়ে নানান রকম পাখিগুলো নিজেদের নীড়ের দিকে উড়ে যাচ্ছে। আমি গন্তব্যহীন। নদীর পানির উপর লাল হয়ে যাওয়া সূর্যটার ছায়া পড়েছে। হটাৎ জড়ো হাওয়ায় বাতাস বইতে লাগলো। নিজের অজান্তেই একটা একটা করে ডায়েরির পাতা ছিড়ে ছিড়ে নদীর পানিতে ছুড়তে লাগলাম। বাতাসে সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদীর ওপারের দিকে। ওপারে একটা গ্রাম। সেখানে একটি বিয়ে বাড়িতে লাল নীল আলো জ্বলছে। হয়তো সেটাই তনুর শ্বশুরবাড়ি।

লেখাঃ বাধন