গাধা কথন

4372
0

ফাকা রাস্তায় হাঁটছি। মেজাজ কিঞ্চিত খারাপ। ভর দুপুর, খিদেও লেগেছে প্রচণ্ড। ভুল হয়েছে, আম্মার সাথে ঝগড়া করে বাসা থেকে বেরোবার আগে খেয়ে নেয়া উচিৎ ছিলো। পকেটে আছে মাত্র ১০ টাকা। বেকার মানুষ, চাকরি বাকরি নাই, যখন তখন বাসায় টাকাও চাওয়া যায় না।

পকেটে হাত দিয়ে দেখি, মোবাইলটাও রেখে এসেছি। ভালো হয়েছে, আজকে ফোন করে কারো পাওয়া লাগবে না আমাকে। এটা ভেবে একটু ভালো লাগছে। মাঝে মাঝেই ভাবি ডুব দিবো, কিন্তু হয়ে ওঠে না, আজ একটা সুযোগ এসেছে। অবশ্য আমি জানি, কিছুক্ষণ পরেই একজন আমাকে গরু খোঁজা দিবে, দিলে দিক, আমার কি?

ঝগড়া করার সময় মনে ছিল না? এখন বুঝবে ঝগড়া করার মজা। আপনারা আবার ভেবে বসবেন না আমি আমার কোন পরাণের বন্ধু বা বান্ধবীর কথা বলছি। ইনি হলেন আমার জানি দুশমন নিতু, আমার তিন মিনিটের ছোট বোন। যদিও মহারানী মানতেই চান না যে তিনি আমার থেকে পুরো ১৮০ সেকেন্ড এর ছোট। এই ব্যাপারে তার হাজার বার মানুষকে শোনানো সেই বিখ্যাত বাণীটি হলো- ‘ডাক্তার আম্মার সিজার করার সময় ভুল করে উনাকে আগে বের না করে আমাকে বের করছেন।’

আর এই কারনে তিনি আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেন, কতটা সম্মান তা আপনাদের একটা ছোট্ট উদাহরন দিলেই বুঝবেন। উনি একবার উনার বান্ধবীমহলের সামনে আমার গায়ে উনার পাঁচ ইঞ্চি সমান পেন্সিল হিল দিয়ে ঢিল মেরেছিলেন। এতটা সম্মান পাওয়ার পর আমি আজও উনার সেই বান্ধবীমহলের সামনে দাঁড়ানোর সাহস করিনি।
দেখলেন তো, মানুষের জীবনে শত্রুর ভূমিকা কতখানি? নিজের পরিচয় দেয়ার আগেই শত্রুর জন্ম ইতিহাসও শুনিয়ে দিলাম। যাই হোক, আমি নীল। নামের বাহার শুনলে মনে হয় জমিদার পুত্র, অথচ দেখেন আমার অবস্থা- ১ বছরের বেকার এই আমি পকেটে ১০ টাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি। অবশ্য আমার মহান পরিবার এবং সুশীল সমাজের দায়িত্বশীল মানুষবর্গ আমার একটা নাম রেখেই সন্তুষ্ট হননি।

এই ২৫ বছরের জীবনে বিখ্যাত আমি আসলে কতগুলো নাম অর্জন করেছি তা কখনও গুনে দেখার প্রয়োজনবোধ করিনি। মায়ের কাছে আমি গোবর গণেশ, বাবার কাছে এক কথায় গাধা, বন্ধুরা ডাকে রামছাগল, অনার্স পড়ার সময় ক্লাস এর এক ফাজিল মেয়ে ডাকতো চিল বলে, নীলের সাথে মিলিয়ে চিল, আর আমার জানি দুশমন মানে নিতুর সেই বিখ্যাত বান্ধবীগণ আমাকে দেখতে পেলেই সুর করে ছড়া কাটে-

“রামছাগল নীল
হা করে আকাশে
তাকিয়ে গুনে চিল
আর ছোট বোনের
হাতে খায় হিলের ঢিল” ।

তবে আমার নাম রাখার পেছনে সবথেকে বেশি কষ্ট যিনি করেছেন, করছেন এবং ভবিষ্যতেও করে যাবেন তিনি আর কেউ নন, আমার বোন নিতু। আর তার দেওয়া নামগুলো যদি এখন আপনাদের বলা শুরু করি তাহলে ডাকপিয়নের জন্মদিনটাই শেষ হয়ে যাবে, আমার একলার গল্প পড়তেই যদি ৩ তারিখ চলে আসে তাহলে বাকি দুটো সেরা গল্প পড়বেন কখন? আমি আবার দয়ার সাগর, অন্যদেরকে বঞ্চিত করিনা। তাই সংক্ষেপেই কয়েকটা নাম বলি। নিতুর রাখা বিখ্যাত নামগুলোর মধ্যে – হাঁদারাম, বুদ্ধুরাম, তেলাপোকা, ছাড়পোকা, বিছাপোকা, টাকি মাছ, বান্দর, ত্যাঁদড়, শাখামৃগ, গণ্ডার, জলহস্তী, কেঁচো, উইপোকা, ইন্দুর, টিকটিকি……থাক, নিজ হাতে নিজের ইজ্জতের ফালুদা করতে আর ইচ্ছে করছে না।

তবে আমি যে ওর কোন নাম দেইনি তা কিন্তু না, নিতু টিনটিনে পাতলা আর ওর মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল বলে ওকে কুদ্দুস বয়াতি বলে ডাকতাম, একদিন আমার এক বন্ধুর সামনে এই নামে ডেকেছিলাম বলে সে কি তার কান্না, কেন জানি ওই সময় ওর কান্না মাখা মুখটা দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। সেই থেকে তাকে আমি মহারানী ছাড়া অন্য নামে ডাকি না।

তবে মজার ব্যাপার কি জানেন? আজ আমার আর মহারানীর জন্মদিন। কিন্তু গত বছরের এই দিন আর আজকের এই দিনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। গতবার ঘুম থেকে উঠেই দেখি আমার টেবিল এ পাঁচশ টাকার একটা নোট। আম্মাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো তোর আব্বা দিয়ে গেছে, এই বলে আম্মাও একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছিলো। অথচ আজ সকালে উঠেই শুনি আব্বা আম্মাকে বলছেন- তোমার গাধাপুত্রকে বলবা, ২৫ বছর তো পূর্ণ হলো, আর কতদিন ৫৫ বছর বয়সী বাবার ঘাড়ে চড়ে নাঁচবে? ছোট বোনের বিয়ের বয়স যে পার হতে চললো সে খেয়াল কি আছে জনাবের?

আব্বা স্কুলে যাওয়ার পর আম্মাকে গিয়ে বললাম, মহারানীর বিয়ে দিতে কি আমি নিষেধ করেছি? ওর জ্বালায় তো আমার জীবনটা নর্দমার পঁচা পানি হয়ে গেছে, এখন বিয়ে দিলে অন্য একজনের জীবনটা খারাপ করবে,আর আমি তাহলে একটু নিস্তার পাই। এই কথা শুনেই মহারানী উনার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে কোমড়ে দুইহাত দিয়ে ঝগড়া শুরু করলেন আমার সাথে- এহঽ, আমি তোর জীবনটা খারাপ করেছি? তোর জন্য তো আমি শান্তিমতো একটু বাইরেও বেরুতে পারিনা, ছাগলের বোন, গাধার বোন, আবুলের বোন…এইসব শুনতে শুনতে আমার কান ভারী হয়ে যায়। আর শোন, তুই আমার থেকে ছোট, তুই আগে বিয়ে করবি, তোর বউকে সাইজ করে তারপর আমি বিয়ে করবো। আমি বললাম, ক্যান তুই কি দর্জি নাকি? আগে জানতাম না তো?

আর এর মাঝে আম্মা এসে বললো আমিই নাকি ঝগড়া বাধালাম সকালে উঠেই। ফলাফল সরূপ আম্মার সাথেও ছোটখাট ঝগড়া লেগে গেলো। তাই রাগ করে নাস্তা না করেই বেড়িয়ে এলাম বাড়ি থেকে। জানি মহারানী এতক্ষণে আমার সব বন্ধুদের ফোন করে আমাকে খুঁজতে শুরু করেছেন। সেজন্যই তো কারও কাছে না গিয়ে রাস্তায় হাঁটছি। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, কিন্তু রাস্তার পাশে যেসব হোটেল দেখা যাচ্ছে এসবের মধ্যে ১০ টাকা দিয়ে গুনে গুনে ৫০ টা ভাত দেবে বড়জোর। তাই ভাত খাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম। ভাবছি এক কাপ চা খাবো, ক্ষুধাটাও নষ্ট হয়ে যাবে আর দু’এক টাকা পকেটে ফেরতও আসবে।

দোকানের দিকে পা বাড়াতেই টের পেলাম কে যেন আমার শার্ট ধরে টানছে। ওরে…… মহারানী ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করেছে, এইবার কপালে খারাবি আছে। ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখি ৫-৬ বছরের এক পিচ্চি ছেলে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কিরে, কিছু বলবি? ও কিছু না বলে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা কলার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করলো। ও… কলা খাবি? পিচ্চি মাথা নাড়লো। তুই কথা বলতে পারিস না? আবার উল্টো পাশে মাথা নাড়ালো। ওকে ৪ টাকা দিয়ে একটা সাগর কলা আর ৬ টাকা দিয়ে একটা পাউরুটি কিনে দিলাম। বেচারার বোধহয় খুব ক্ষুধা লেগেছিলো, হাতে পেয়েই রাক্ষসের মতো খেতে শুরু করলো। ওর খাওয়া দেখে চোখ ভিজে আসছে। ইস আজ যদি একটা চাকরী থাকতো, পকেটে ১০ টাকার বদলে পেট মোটা একটা মানিব্যাগ থাকতো, তাহলে ওকে পেট ভরে ভাল কিছু খাওয়াতে পারতাম।

উঠে পরলাম ওখান থেকে, কেন জানি ক্ষুধাটা আর নেই। হাঁটতে হাঁটতে পার্কে ঢুকে পড়লাম। বড়সড় ছায়াদানকারী একটা গাছ খুঁজে বের করতে হবে, বিকেল পর্যন্ত ঘুমিয়ে তারপর বাড়ি ফিরবো। ঘুরে ঘুরে একটা মেহগুনি গাছ পেলাম। চোখ বন্ধ করে গাছে হেলান দিয়ে বসে আছি, সিগারেটের গন্ধে পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠলো। আশে পাশে তাকিয়ে দেখি এক ফকির আয়েশ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

– ভাইজান…ও ভাইজান…
– চোখ মেললাম, দেখি সেই বিশিষ্ট ভদ্রলোক যিনি একটু আগে সিগারেট ফুঁকছিলেন। জী বলেন…
– ২০ টা ট্যাহা দেন ভাইজান, কাইল থেইকা কিছু খাইতে পারিনাই।
– আপনি আমাকে পাঁচ টাকা দেন, ১ কাপ চা খাবো, বলেই ব্যাটার হাত চেপে ধরলাম। হাত ধরাতে সে ভড়কে গেলো।
– ইটা কি কন ভাইজান?
– আমি আরও জোরে ওর হাত চেপে ধরে বললাম, দেন না ভাই, সারাদিন কিছু খাইনি। একটু আগে তো সিগারেট টানলেন, আমি তো বিড়ি টানবারও টাকা পাইনা, দেন না একটা সিগারেট আর পাঁচটা টাকা।
– বেচারার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে, জোর করে হাত ছাড়িয়ে দৌড় মারলো। আমি পেছন থেকে চিল্লানো শুরু করলাম- ও ভাই…… পাঁচ টাকা দিয়ে যান…।

একা বসে হাসলাম অনেকক্ষণ। মহারানীটার কথা খুব মনে পড়ছে। পাগলীটাও নিশ্চয়ই না খেয়ে বসে আছে এখনও। সারাক্ষণ আমাকে জ্বালালেও আমি জানি আমাকে কতখানি ভালবাসে এই পাগলীটা। একদিন দেখি রাস্তায় দাড়িয়ে আব্বার স্কুলের দুজন জুনিয়র কলিগের সাথে ঝগড়া করছে। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম ওনারা আমাকে গাধা বলে সম্বোধন করায় মহারানী এত ক্ষেপেছে। আর একদিন রাহাতের ফোন রিসিভ করে ওর বারোটা বাজিয়েছে। আমার বন্ধু আমাকে ছাগল বলে ডাকতে পারবে না, অথচ সে যেন পুরো এনিম্যাল কিংডম এর নামে আমাকে ডাকবার আইন সংসদ থেকে পাস করিয়ে এনেছে।
.

আমার পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে যখন জেগে পড়তাম তখন পাগলীটাও না ঘুমিয়ে জেগে থাকতো, কিছু বললেই বলতো- ভাবিস না তোর জন্য জেগে আছি, আমার ঘুম আসছে না, দিনের বেলা অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। এরপর চা বানিয়ে আনতো, কখনও চিপস ভাজা, কখনও নুডলস রান্না করতো আর বলতো- এগুলো খেয়ে নে, আমার ক্ষুধা লেগেছিলো বলে করলাম, অনেক খেয়েছি, তুই খেয়ে নে নাহলে নষ্ট হবে। পাগলী কোথাকার, যতই লুকানোর চেষ্টা করিস আমি সবই বুঝি।

.

কিন্তু তোর এই অপদার্থ ভাইটা তোকে কিছুই দিতে পারেনা রে। দ্যাখ না, আজ তোর জন্মদিনে তোকে তো কিছু দিতেই পারলাম না উল্টো ঝগড়া করে তোর মনটা খারাপ করে দিয়ে এলাম। জানিস নিতু, চাকরী পেলেই তোকে সেই ঘড়িটা কিনে দেবো যেটার জন্য ছোটবেলায় বায়না করে করে জ্বর বাঁধিয়েছিলি কিন্তু আমাদের অসহায় বাবা সামান্য স্কুল এর শিক্ষকতা করে তোর এই আবদার পূরণ করতে না পেরে অসুস্থ তোর পাশে বসে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। সেদিনই আমি ঠিক করেছিলাম তোকে ওই ঘড়িটা আমি একদিন না একদিন কিনে দেবই।

সূর্যটাও আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে, আমিও উঠি। মহারানী নিতু না জানি কি দিয়ে ঢিল মারবে আজকে। বাড়ি ফিরে দেখি দরজা হা করে খোলা। ঘরে ঢুকতেই মহারানী আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো…… ওই বান্দর, কোথায় ছিলি তুই? সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে হয়রান আমি। সারাদিন কিছু খেয়েছিস? মোবাইলটা নিয়ে যাসনি কেনো? তোর মতো খারাপ ছেলে আর একটাও নেই। তুই শুধু কষ্ট দিস। যেদিন শ্বশুর বাড়ি চলে যাবো সেদিন বুঝবি। পাগলীটার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, কোথায় যাবি? তোর সাথে আমিও ফ্রি ফ্রি চলে যাবো। হঠাৎ দেখি আব্বা আম্মা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তাদের দুই ছেলেমেয়ের কীর্তি দেখছেন। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।
– এদিকে আয় গাধা।
– মাথা নিচু করে গালি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আব্বার কাছে গেলাম।
– এটা ধর (আব্বার হাতে একটা খাম)
– কি এটা?
– গাধা নিজেই দ্যাখ।
– আব্বার ধমক খেয়ে খামটা হাতে নিয়ে খুলে দেখেই আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম। আব্বা আমার চাকরীটা হয়ে গেছে। আব্বা ছোট বাচ্চার মতো কাঁদছেন, কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে না একদম, কারন আমি জানি আমাদের চারজনের চোখেই সুখের অশ্রু।।

লেখাঃ Habiba Bristy