– বিয়ের শাড়ি কিনতে আসছেন নাকি মাছের বাজারে আসছেন আপনারা?
দোকানদারের কথা শুনে তনু আরো ক্ষেপে গেলো।
– কি? আস্তে কথা বলেন। একদম আস্তে কথা বলেন।
– আমি জোরে কই বললাম? পাগল নাকি?
– আপনি পাগল কাকে বললেন?
একটা হৈ চৈ লেগে গেলো তনু আর দোকানদার ইফতির মধ্যে। তনু এসেছে বিয়ের শপিং করতে। তার সাথে তার হবু বর। হবু স্ত্রীর এমন রেগে যাওয়া দেখে ভদ্রলোক একবার চোখ থেকে চশমা খুলছে আবার পড়ছে। আবার খুলছে আবার পড়ছে।
– এই মেয়ের যার সাথে বিয়ে তার তো জীবন বরবাদ।
দোকানদারের এই কথা শুনে এইবার জামাই সাহেব আরো ভয় পেয়ে গেলো। সে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে চাইলো। তনু এতটা রাগের মাথায় ছিলো যে সে সবার সামনেই মাথা গরম করে বলে উঠলো “এই আস্তে কথা বলেন”………।
মূলত এটা তনুর মুদ্রা দোষ। কেউ আস্তে কথা বললেও সে যখন রেগে যায় তখন এই কথা বারবার বলে। তনুর এই কথা শুনে জামাই এতই উত্তেজিত হয়ে গেলো যে সে সেখানে দাঁড়িয়েই বলে দিল “এই বিয়ে আর হবে না। এত বদমেজাজী মেয়ের সাথে আমি বিয়ে করবো না” এই বলে সে তনুকে রেখে চলে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি খুব বিশ্রী হয়ে উঠলো। এবার তনু স্থির হয়ে গেলো।
স্থির হওয়াটাও স্বাভাবিক। এ নিয়ে ৪ টা বিয়ে হতে নিয়েও ভেঙ্গে গেলো মেয়েটার। প্রতিবারই একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। বাবা নাই। ঘরে মা আর একটা ভাই আছে তাও আবার প্রতিবন্দী। সে ই অনেক বছর থেকে টিউশনি করে সংসারটাকে সাহায্য করে চলছে। প্রথম বিয়েটার ভাঙ্গার সময়ই তার বাবা মারা যায়।
প্রথম বিয়েটা ভেঙ্গেছিলো যৌতুকের ভেজাল নিয়ে। একেবারে বিয়ের আসরে যৌতুক দাবী করা হয় ছেলে পক্ষের। যৌতুক নিতে চাওয়ার কথা শুনে তনু বিয়ের আসর ছেড়ে নিজেই উঠে যেতে নিয়েছিলো। একসময় হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায় । তখন তনু চিৎকার করে বলতে থাকে “আস্তে কথা বলুন“। কিছুক্ষণপর তনুর বাবা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়ে মেঝেতে।
মানসিক এই ধাক্কা সে সহ্য করতে না পেরে স্ট্রোক করে মারা যায়। এর পরের দুইবারে একবার ছেলের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সে বিয়ের আগে তার প্রেমিকার সাথে পালিয়ে যায়। আর তার পরেরবার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর এলাকাএ কে যেন ছেলে পক্ষকে বলেছিলো তনুর চরিত্র ভালো না। তাই পাত্র পক্ষ সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়।
তনু দোকানের সামনে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। এইবার বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছে এটা শুনলে মা মরেই যাবে। কি করবে এইবার? সে কেন যে এইরকম চিৎকার করে উঠলো? খুব অসহায় চেহারা নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসলো। তার এমন চেহারা দেখে দোকানদারেরও খারাপ লাগলো।
তনু কান্না করতে করতে বের হলো। দোকানদারের মায়া হলো। মনে হল তার কারণে মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। ছেলেটা খুব সাহস করে তনুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তনুর চখ মুখ লাল।
– এইযে শুনেন।
তনু তার কথার উত্তর দিলো না। সে আবার ডাক দিলো।
– শুনছেন?
– কি? শুনছি। বলেন।
তনু রাগ হয়ে গেলো।
– আসলে ব্যাপারটা এমন হবে আমি ভাবি নাই। আমি সরি।
– সরি বলতে হবে না। এটা নতুন না।
তনু আর কথা না বলে একটা রিক্সা ডেকে চলে গেলো। দোকানদার তাকিয়েই রইল। তার মাথায় ধরলো না। “এটা নতুন না” কথাটার মানে কি?
তনু চলে গেলো। সে বাসায় পৌঁছানোর আগেই বাসায় খবর পৌছালো যে বিয়েটা আর হচ্ছে না। মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গেছে। আবার আরেকটাবার। সুরমা কোনভাবেই তা মেনে নিতে পারছে না। বিলাপ করে কান্না করে চলছে সে। তনু দরজার কোনায় এক ঠ্যাঙ্গে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বাবাকে খুব দরকার ছিলো। মা কে শান্তনা দিতে অথবা তার নিজেরই মনের শক্তির জন্য।
৪ মাস পর………………………।।
তনুর এক বান্ধবীর বিয়েতে গেলো তনু। খালার কাছ থেকে একটা শাড়ি ধার করে এনেছে বিয়েতে পড়ে যাওয়ার জন্য। সেই শাড়িটায় একটা বাচ্চা খেলতে খেলতে তনুর গায়ে পড়ে গিয়ে হাতের কোল্ড ড্রিংকস টা ফেলে দিয়েছে। তনু যখন খুব উত্তেজিত হয়ে যায় তখন আশে পাশে যেই থাকে তাকেই সে একটা কথা বলে “আস্তে কথা বলুন”। সেদিনও বাচ্চার মা যখন এসে বলছিলো। বাচ্চা মানুষ খেলবেই তনুকেই সতর্ক হয়ে হাটা উচিৎ ছিলো তখন সে বলে উঠলো এই কথা।
পাশ থেকেই কারো কাছে এই কথাটা খুব পরিচিত মনে হওয়ায় দৌড়ে এসে বললেন
– আরে আপনি?
তনু তাকে চেনার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না।
– আমাকে চিনেন নাই? আমি ইফতি। ওহ স্যরি আমি ঐযে শাড়ির দোকানদার।
অনেক্ষণ চুপ থেকে তনু ভ্রু কুচকে তাকালো
– তোহ? কি করবো এখন?
– না কিছু না। আসলে সেদিনের জন্য আমি খুব দুঃখিত। আপনার কি বিয়েটা ভেঙ্গেই গিয়েছে?
– হুম।
– এত ছোট একটা বিষয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো?
– ছোট কই? বড়ই তো। আপনিই তো তাকে মনে করে দিয়েছিলেন আমাকে বিয়ে করাটা কত বড় ভুল হবে।
– প্লিজ এই কথা আর বইলেন না। আমার অনেক বড় ভুল হইসে।
– বুঝলাম।
তনু চলে যাচ্ছে। ইফতি তাকিয়ে আছে। শাড়ির দাগ লেগে যাওয়া জায়গাটায় সে বারবার দেখছে। একটু চিৎকার করে কান্না করতে পারলে হয়ত মেয়েটার ভালো লাগতো।
পরদিন তনুর টিউশনি থেকে বাসায় ফেরার সাথে সাথে চোখ বড় হয়ে গেলো। দুইটা শাড়ি এসেছে তার নামে কুরিয়ারে। শাড়ির ভেতরে একটা চিরকুটও আছে। যাতে লেখা “এরপর থেকে অন্য কারো শাড়ি পরবেন না। আমার দোকান থেকে শাড়ি কিনে আস্তে আস্তে কিস্তিতে শোধ করে দিয়েন”……।।
তনু খুশি হওয়ার বদলে রাগ হয়ে গেলো। এই ছেলেটা তার বাসার ঠিকানা কিভাবে জানলো?
পাশ থেকে তনুর মা বলে উঠলো
– তুই কি প্রেম ট্রেম করস? যদি তাও করস তাও ভালো। যেই পোলার সাথে প্রেম করস তার সাথেই বিয়া কর। তাও তোর বিয়া হোক। আমার এত অশান্তি আর ভালো লাগে না।
তনুর মায়ের একটা পুরান স্বভাব। কিছু হলেও সুরমা তনুর বিয়ের কথা তুলে। হায় হুতাশ, অভাব সব একটার পর একটা তার তখনই মনে হতে থাকে। তনু এই মুহূর্তে সেসবে কান না দিয়ে সে ভাবছে ছেলেটা কিভাবে ঠিকানা পেলো?
তনু শাড়ি দুইটা যতই হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে তার রাগ ততটা কমছে। এইটা শাড়ি তো নয় যেন যাদুর ছড়ি। এতক্ষনে তনু ভুলে গিয়েছে ছেলেটা ঠিকানা কোথায় পেল? একটা শাড়ি সে নিজের শরীরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলো। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।
গতকাল যেই বান্ধবীর বিয়ে ছিলো সে ফোন করেছে।
– কি রে কি অবস্থা তোর?
– এইতো দোস্ত ভালো। তোর বিবাহিত জীবন কেমন যাচ্ছে?
– মাত্র তো এক রাত পার হলো। এখন কেমন করে বলবো বল। আর কটা দিন যাক এরপর বলব নে।
– হাহাহাহা। আচ্ছা
– আমার কথা বাদ দে। তোর কথা বল।
– আমার কি কথা বলবো?
– শাড়ি কেমন লেগেছে সেটা বল?
– শাড়ি!! মানে ঐগুলো তুই? তুই পাঠাইসিস?
– হুম আমি পাঠাইসি। তুই কি ভাবসিলি?
– না কিছু না।
তনু কেমন যেন চুপসে গেল। সে ভেবেছিলো এটা ওই ছেলেটা পাঠিয়েছে। নামটাও তো ভুলে গিয়েছে। কি যেন নামতা তার?
– হাহাহাহা কিছুনা তাইনা? শোন কাল আমরা বিকেলে ঘুরতে বের হবো। তুই ঐখান থেকে একটা শাড়ি পরে বের হইস।
– আমরা বলতে বুঝলাম না।
– আমি, তোর দুলাভাই আর যে শাড়ি পাঠিয়েছে সে।
– শাড়ি কে পাঠিয়েছে?
– হইসে ঢং করিস না। তুই ভালো করেই জানিস কে পাঠাইসে।
তনু এইবার একটু লজ্জা পেয়ে গেলো।
– কোথায় যাবি তোরা?
– তুই রেডি হয়ে থাকিস। আমি তোকে ৪ টার দিকে নিতে আসবো।
– আচ্ছা।
– আর শোন। ইফতি ভাই তোর নাম্বার চেয়েছিলো। দিবো? নাকি তুই নিজেই কাল দিবি তাকে?
– তোর পন্ডিতি করতে হবে না।
– হাহাহাহা আচ্ছা ম্যাডাম। জো আপকি মারজি। রাখি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।
তনুর খারাপ লাগছে না। অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। এ যেনো কেমন অনুভূতি। তনুর সাড়ে ২৪ বছর চলছে। এর মধ্যে তার কারো সাথে প্রেম হয় নাই। ২০ পার হয়ে গেলেই মেয়ের যখন প্রেম, বিয়ে কোনটাই হয় না তখন মেয়ের মা অনেক চিন্তায় পড়ে যায়। সুরমা তনুকে নিয়ে ঠিক তেমনই চিন্তিত।
পরদিন তনু আর কোন স্টুডেন্টের বাসায় পড়াতে গেলো না। সকাল থেকেই সে গোসল করে টিপটপ হয়ে বসে আছে। দুপুর দুইটা থেকে সে শাড়ি পরে বসে আছে ফাতেমার ফোনের অপেক্ষায় ফোন হাতে নিয়ে।
ফাতেমা ফোন করলো ৩.৫০ টার দিকে। বলল তারা বাসার বাইরে অপেক্ষা করছে।
তনু বাসা থেকে বের হয়েই দেখলো ফাতেমা আর তার জামাই গাড়ি নিয়ে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে। সেখানে আর কেউ নাই। তনুর মনটা একটু খারাপ ই লাগলো। মন খারাপ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ইফতি কতগুলো আইসক্রীম হাতে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলল
– স্যরি স্যরি দোকান পাচ্ছিলাম না। আইসক্রীম কেনার জন্য।
তনু তাকে দেখে একটু মনে হয় সস্তি পেলো। ইফতি তনুকে দেখে বলল
– শাড়িটায় আপনাকে মানিয়েছে। কেমন আছেন?
– জ্বী ভালো। আপনি?
ফাতেমা বলে উঠলো
– সব গল্প কি গাড়ির গেইট ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে করতে হবে? গাড়িতে উঠেন ভাইয়া। বিকেল হয়ে যাচ্ছে।
ইফতি গাড়িতে উঠে বসলো। সবাই যাত্রারম্ভ করলো। তারা একটা নদীর পারে বেড়াতে গেল। ফাতেমা এবং তার স্বামী ইফতি আর তনুকে পরিচয় করিয়ে দিলো। নতুন করে। ইফতি ফাতেমার সম্পর্কে দেবর হয়। ফাতেমাকে অনুরোধ করেই সে তনুর বাসায় শাড়ি পাঠিয়েছিলো। দুইজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নব বিবাহিত দম্পতি আলাদা করে ঘুরতে লাগলো। এর মাঝে তনু ইফতির ব্যাপারে। ইফতি তনুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলো। যেমন – ইফতি সেই শাড়ির দোকানের দোকানদার না। সেইটা তার মামার দোকান। মাঝে মাঝে গিয়ে সেখানে সে বসে। মূলত সে সফটওয়্যার ইঙ্গিনিয়ার। তাই কাস্টমারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সে জানেনা। এমনকি সেদিনের শাড়ির দামটা সে আসলেও বেশি বলেছিলো, ওই শাড়ির এত দাম না। তনুর ব্যাপারে ইফতি জানলো যে তার বাবা নাই। বারবার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। মা অনেক চিন্তায় আছেন এই নিয়ে। বড় ভাইটাও অসুস্থ। মা মারা যাওয়ার আগে তনুর একটা ব্যবস্থা কর দিতে চান। তাকে সুখে দেখে মরতে চান।
দুইজন একে অপরের সাথে কথা বলে অনেকটা বন্ধুপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলল। রাতে খাওয়া দাওয়া করে তনুকে বাসায় নামিয়ে ওরা চলে গেলো। কি আশ্চর্য তনু ইফতির ফোন নাম্বারটা নেয় নি। এমনকি নিজের ফোন নাম্বারটাও তো দিলো না।
সে রাতে ফোন করলো ফাতেমাকে।
– এই তোরা কখন পৌঁছাইসিস?
– এটা জানতে রাত ১ টায় ফোন দিতে হয়?
তনু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১২.৫৮ বাজে।
– স্যরি স্যরি। ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম।
– না ঠিকাছে, তোর আগে ইফতি ভাইও ফোন করেছিলো। সে ও এই আজাইরা প্রশ্ন করতে ফোন করেছিলো। ওহহহো এখন বুঝছি তোদের কাছের দুইজনের ফোন নাম্বার নাই তাই না?
– না আসলে তার নাম্বার দিয়ে কি করবো?
– হইসে ঢং করিস না। আমাকে পিয়ন বানাইসিস না? আমি ইফতি ভাইয়ের নাম্বার ম্যাসেজ করে তকে দিচ্ছি। তোরা নিজেরা কথা বল। আমাদের রোমান্সের টাইমে বিরক্ত করিস না।
তনু একটু হেসে বলল
– আচ্ছা যা করতেছিলি কর।
একটু পর তনুর মোবাইলে ইফতির নাম্বার পাঠালো ফাতেমা। ফোন দিবে নাকি দিবে না এই ভাবতে ভাবতে তনুর মোবাইলেই ফোন আসলো ইফতির।
– হ্যালো। ঘুমিয়ে পরছিলেন?
– না ঘুমাই নাই।
– ভাবী নাম্বার পাঠালো আপনার।
– আমাকেও পাঠিয়েছে।
– তাহলে ফোন দিলেন না যে?
– একটু পর দিতাম।
কথা শুরু হলো। রাত পার হয়ে ভোর হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ঘুমন্ত শহরে মনে হয় এই দুইজনের ঘরের বাতিই জ্বলছিলো। সাথে জানালা দিয়ে নতুন কোন অনুভূতির বাতাস বইছিলো।
দিন যাচ্ছিলো কথা বাড়ছিলো। মাঝে মাঝে দেখাও হচ্ছিলো।। দুইজনের সম্পর্ক এখন অনেক মধুর।
একদিন ইফতি কথার মাঝে হঠাৎ করে বলে উঠলো
– তনু আমাকে বিয়ে করবা?
তনু চুপ করে গেলো। সে যেনো নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না।
– বিয়ে?
– হুম । আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমার মায়ের পরে তোমার ভাইয়ের দুই পায়ের শক্তি আমরা দুইজনই হলাম। সমস্যা কি?
– তোমার বাসার মানুষ মেনে নিবে?
– তোমাকে না মানার মত মানসিক অসুস্থ আমার পরিবার না। বাসায় গিয়ে তোমার মা কে বলো। আমি আমার পরিবার নিয়ে এই শুক্রবার আসবো তোমাদের বাসায়।
তনু খুশিতে কান্না করে দিলো।
– তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কেন?
– আরেকদিন বলব।
তনু আজ অনেক খুশি। সে বাসায় গিয়ে তার মাকে বলল। তনুর মা গ্রাম থেকে গরুর দুধ বিক্রঈ করে যেই টাকা পান সেখান থেকে অনেকদিন যাবৎ টাকা জমিয়ে রাখছেন তনুর বিয়ের জন্য। ঐখান থেকে কিছু টাকা বের করে ঘরে বাজার করলেন তিনি। ইফতির পরিবার তনুকে খুব পছন্দ করলো। ঠিক হলো বিয়ের দিন। সুরমা বললেন “বিয়েটা যত দ্রুত হয় ততই ভালো” তার মনে হয় এবারো না মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গে যায় সেটা।
বিয়ের দিন হিসেবে মাত্র ২ দিন পরই ধরা হয়। ২ দিনেই সব কেনাকাটা করতে হবে। দুই বাড়িতে বিয়ের ধুম পরে গেলো। সুরমা আজ অনেক খুশি। অবশেষে সে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে।
তনুর কাল বিয়ে। সারা রাত একটু পর পর সে ইফতির সাথে ফোনে কথা বলছে।
– আচ্ছা ইফতি তুমি আমাকে বিয়ের আসর থেকে ছেড়ে যাবা না তো?
– তোমার মাথায় ডিস্টার্ব আছে? বিয়ের আগের দিন এসব বলছো?
– না ভয় হয়। আগের অভিজ্ঞতা তো ভালো না আমার।
– তনু সব ঠিক হবে ইন শা আল্লাহ। তুমি চিন্তা করো না। ঘুমাও এখন। কাল আমার পাশেই ঘুমাবা। আমি ঘুম পারিয়ে দিবো।
– কসম?
– কসম। মাথা হাতিয়ে তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিবো।
– তুমি কিন্তু আমাকে এখনো বলো নাই তুমি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাও?
– কাল বলব।
– না আমি বিয়ের আগে শুনবো।
– বিয়ের আগেই বলবো।
– কখন?
– কাল বিয়ের আগে বললেই তো হলো? এখন ঘুমাও।
– আচ্ছা।
তনু ঘুমিয়ে পরলো। সকাল থেকে বাড়িতে অনেক কাজ। তনুর বড় ভাই পায়ে হেটে কিছু করতে না পারলেও সবাইকে কাজের নির্দেশনা দিচ্ছেন। অল্প কিছু মানুষ নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। শুধু কাছের আত্মীয়স্বজন নিয়ে। তনুকে ফাতেমা পার্লারে নিয়ে যাচ্ছে বৌ সাজতে।
বৌ সাজার পর তনু আয়নায় তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। ইফতিকে সে এখনো একটা কথা বলে নাই। এই কতদিনে সে ইফতিকে ভালোবেসে ফেলেছে। তনু ফোন হাতে নিয়ে ইফতিকে ফোন করলো।
– হ্যালো কই তুমি?
– আমি বাসায়। একটুপর বের হবো। তুমি?
– আমি পার্লারে। বাসার দিকে যাচ্ছি।
– তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে না?
– জানিনা।
– তনু তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কেন তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তাই না?
– হুম।
– আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তনু। যেদিন প্রথম তোমাকে কাঁদতে দেখেছিলাম তখন থেকেই ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি।
– ইফতি আমিও তোমাকে কিছু বলতে চাই।
– হ্যালো। তনু শুনছো?
– হ্যাঁ আমি শুনছি । তুমি শুনতে পাচ্ছো?
নেটওয়ার্কের কারণে তনুর কথা ভেঙ্গে আসছিলো। সে পার্লারের বাইরে বের হয়ে গেল। তাও সে কথা শুনতে পাচ্ছে না। আশে পাশে অনেক আওয়াজ। তনু এবার ইফতির কথা শুনতে পাচ্ছে না।
– তনু আছো?
– আমি আছি। আচ্ছা শুনো এখানে অনেক আওয়াজ। তোমাকে একটা কথা বলব।
তনু আশ পাশের মানুষকে আজ বলছে “এইযে আস্তে কথা বলুন”
– হ্যাঁ বলো। আমি শুনছি।
– আমি তুমাকে ভালো…………………।
খুব জোরে একটা আওয়াজ হলো। তনুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না তবে আশে পাশের অনেক হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে।
– তনু। তনু এই কি হইছে ঐখানে? তনু। কই তুমি? কেউ কথা বলে না কেন?
তনু যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে ইলেক্ট্রিসিটির কাজ চলছিলো। ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়ে চারিদিকে আগুন ধরে যায়। তনু চলে গেলো। ইফতিকে ফাঁকি দিয়ে এইবার সে ই চলে গেলো।
বিয়ের বদলে বাড়িতে বিশাল বড় জানাজার আয়োজন। চারিদিকে শোক নেমে আসলো।
বেচারী তনু। তার কপালটা আসলেও যেন কেমন ছিলো। বিয়ের সাজে তাকে ইফতি দেখতেও পারলো না। গোসল শেষে তাকে এখন দাফনের জন্য উঠানো হবে। লাশের খাটিয়াতে ইফতি তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে কসম করেছিলো তনুকে ঘুম পারিয়ে দিবে। সে তার কথামত কাজ করছে। কিন্তু সে কান্নাও করছে না। কথাও বলছে না। সবাই জোরে জোরে বলে উঠলো
“আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। এত আওয়াজ ইফতির আজ ভালো লাগছে না। সে চিৎকার করে বলছে “ আস্তে কথা বলুন। তনু ঘুমায়। আস্তে কথা বলুন”………………।।
এরপর থেকে পাগলা গারদের একটা রুম থেকে প্রায়ই শোনা যেত। “আহা আস্তে কথা বলুন। আস্তে কথা বলুন”
লেখাঃ Jakia Juliet