কোন রকমে ভীড় ঠেলে বাসে উঠেই হাঁপ ছেড়ে বাচলো আরিয়ান ।
আজকে ইন্টারভিউ । এই বাসটা মিস করলে একরকম দেরিই হয়ে যেতো । এর উপর ঢাকার রাস্তাঘাটের যা অবস্থা । তাই একটু আগে ভাগেই বের হওয়া ।
কিন্তু বাসে উঠেও ঠিক স্বস্তি পেলো না ।
অনেক লোকের ভীড় । একটু বসতে পারলে ভালো হতো । মনে হয় না সেই সুযোগ হবে ।
ঠিক সেই মূহূর্তেই কে যেন ডাক দিলো …
হ্যালো …আরিয়ান …ব্রো …এই দিকে !!
শব্দের উৎস লক্ষ্য করে তাকালো আরিয়ান । একটা ছেলে মিষ্টি হেসে তার দিকে হাত নাড়ছে ।
এই দিকে আসেন । আপনার জন্য একটা সিট রাখা আছে ।
কিছুটা অবাক হলেও ভীড় ঠেলে ছেলেটার পাশে গিয়ে বসলো সে ।
– তো …প্রস্তুতি কেমন আপনার ?
– জ্বি …মোটামুটি ভালো । তবে আপনাকে চিনলাম না ।
আরিয়ান ভাবছে হয়তো ছেলেটা তার ক্যাম্পাসেরই হবে । বাসের মধ্যে চিনতে পেরে তাকে ডেকেছে ।
– শোন …আরিয়ান… জগতে মোটামুটি বলে কোন কিছু নাই । হয় ভালো নয় খারাপ । এর মাঝামাঝি কিছু নাই । যারা মাঝামাঝি কথা বলে তারা বেশিরভাগ সময় ফাকিবাজ হয় । ফাপড়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা আর কি !!
বাসটা এগোচ্ছে !!
এর মধ্যে এরকম একটা কথা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলো সে । বিরক্তি ভাবও প্রকাশ করতে পারছে না । কারন একটু আগেই ছেলেটা তাকে বসার জায়গা করে দিয়েছে । কে এই ছেলে ?
যেন মনের কথাটা ধরতে পেরেই উত্তর দিলো ছেলেটা …
– আমি পুলক !!
নিজের পরিচয় দিলো ছেলেটা ।
আরিয়ান মনেকরতে চেষ্টা করছে এই নামে কাউকে চেনে কিনা
– আমি আরিয়ান !! এইবার …
তাকে থামিয়ে দিলেন পুলক !!
নিজেই বলতে শুরু করলেন …
– আমি জানি তুমি আরিয়ান । পুরো নাম আরিয়ান রহমান । বাবার নাম মোখলেসুর রহমান । মায়ের নাম আসমা রহমান । তুমি পড়াশুনা করেছো একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে । ৩ বছর ধরে বেকার । বাবা প্রতিদিন তোমাকে কথা শোনায় । মায়ের আদরের পুত্র তুমি । তবে আজকে সকালে না খেয়ে বের হয়েছো । আজ তোমার ইন্টারভিউ । অনেক কষ্ট করে সরকারী চাকুরীর পেছনে লেগেছো । রেজাল্ট খারাপ তোমার । ফাকিবাজ ছাত্র তুমি । তবে গত চার পাচ মাস বেশ খেটেছো । তুমি জানো ভাইভাতে না টিকলে বাসায় মুখ দেখাতে পারবে না । খুব নার্ভাস তুমি । আমি পুলক তোমার নার্ভাসনেস দূর করার জন্যই এসেছি । ভয়ের কিছু নাই !!
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই থামলেন পুলক ।
আরিয়ান এইবার আরো বেশি নার্ভাস । কে এই ছেলে ? তার ভাইভাটাই মাটি করে দেবে মনে হচ্ছে । ইশ… শালার বাসটাও এখন জ্যামে পড়েছে ।
– আপনি কে ভাই ? কি চান আমার কাছে ? গোয়েন্দা বিভাগের লোক নাকি ? ভেরিফিকেশন করতে এসেছেন ? আমি তো এক্সামই শেষ করলাম না ।
– শোন মিয়া ,গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এতোটা রসিক হয় না যে তোমার জন্য বাসে সিট ধরে অপেক্ষা করবে আর ভাইভা দিতে নিয়ে যাবে । বুঝলে ? হতে পারে আমি তোমার সাহায্যেও লাগতে পারি ।
– কি সাহায্য ? আমার কোন লবিং লাগবে না । লবিং করে চাকুরী নেয়ার মতো টাকা পয়সা আমার নেই ।যা ছিল সবই পড়াশুনার পেছনে খরচ করেছি ।
– আচ্ছা ঠিকাছে তোমার লবিং লাগবে না । দেখো আমরা কিন্তু চাইলেই তোমার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে পারি ।
– সেটা কিরকম ? … আরিয়ান জানতে চাইলো !!
– বাসটা জ্যামে পড়ে আছে । ভাইভাতে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করে । তো আমি তোমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করবো । তুমি নিজের মতো করে উত্তর দিবা । সময় কেটে যাবে । নার্ভাসনেস আর থাকবে না । আবার রিভিশনও হয়ে যাবে ।
– বলেন কি প্রশ্ন !!
– প্রথমেই ধরো বেক্সিট নিয়ে একটা ছোটখাটো বয়ান দাও । যা জানো বলে ফেলো ।
আরিয়ান গরগর করে সব বলে গেলো ।
– আচ্ছা বলো দেখি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পেছনে রাশিয়ার ভূমিকা কি ? নিজের মতো বলো ।
আরিয়ান ভেবে উত্তর দিলো । পুলক মাঝে মাঝে শুধরে দিলেন ।
– এইবার বলো দেখি আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের ভূমিকা কি হবে ? এইটা কিভাবে কাজে লাগবে ?
আরিয়ান উত্তর দিলো । তবে খুব সুন্দর হলো না । পুলক তথ্যগুলো বলে দিলেন । এবং উত্তরটাও সাজিয়ে দিলেন ।
– আচ্ছা বলো আমেরিকা চীন বানিজ্য যুদ্ধে বাংলাদেশের আদৌ কোন ফায়দা আছে ? সামনের দিনে চীন কিভাবে এই যুদ্ধে নিজেরদের অবস্থান পোক্ত করবে বলে তোমার ধারনা ?
এইটাও একটা ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন । উত্তরটা অনেকভাবেই দেয়া যায় । তবে কোনভাবে দিলে গ্রহনযোগ্য হবে সেটা বলা মুশকিল । এরপরেও উত্তরটা দিলো আরিয়ান ।
বাস চলে এসেছে গন্তব্যে । পুলক তাকে বিদায় দিলেন । আরিয়ান খেয়াল করলো ছেলেটা কেমন যেন একটা হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে ।
— —–
সালাম দিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রবেশ করলো আরিয়ান ।
তাকে বসতে দেয়া হলো । মাথাটা কেমন জানি ফাঁকা লাগছে । মনে হচ্ছে ভেতরে কিছুই নেই ।
তার সার্টিফিকেটগুলো দেখে একজন বললেন রেজাল্ট এতো কম কেন ?
আরিয়ান উত্তর দেয় না । জানে …এই ভাইভাতেও টিকবে না সে ।
নীরবতা ভেঙ্গে প্রথম প্রশ্নটা করলেন বোর্ডের একজন
-বেক্সিট সম্পর্কে কি জানেন ?
নিজের বিস্ময় চেপে রেখে গর গর করে বলে গেলো সব । সে মনে মনে যা ভাবছে সেরকম ঘটলে আজকে তার ভাইভা আটকানোর কেউ নাই ।
– আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের ভূমিকা কি হবে ?
– ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে রাশিয়ার ভূমিকা কি ?
একটার পর একটা প্রশ্ন ছুটে আসছে তার দিকে । সবই তার জানা ।
জীবনে এমন ভাইভা দেয় নি সে । একটু আগে বাসে তার পাশে বসে পুলক যেগুলো আলোচনা করেছেন তার সবই জিজ্ঞেস করছে এরা !! প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল প্রশ্নই তার জানা ।!!
বিদায় নেয়ার আগে ইন্টারভিউবোর্ডের এক কর্মকর্তা তাকে নরম দৃষ্টিতে বললেন , পড়াশুনা তো অনেক তোমার !! বেশ ভালো । বেস্ট অফ লাক !!
—
এক সপ্তাহ পর ।
নিজের ঘরে বসে আছে আরিয়ান । ভাইভার ঘটনাটা এখনো মাথা থেকে যায় নি । সেইদিনের পর পুলকের সাথেও আর দেখা হয় নি তার ।
এমন সময় মোবাইলে একটা ফোন ।
ওপাশের কন্ঠস্বরটা ঠিক পরিচিত মনে হলো না । আবার কেমন জানি পরিচিতও লাগছে ।
হ্যা পুলক কথা বলছেন । তার সাথে দেখা করতে চায় । একটা এতিম খানার ঠিকানা দিয়ে সেখানে চলে আসতে বলেছেন ।
ঠিকানাটা শুনে কেঁপে উঠলো সে । বিগত ৩ বছর ধরে এই ঠিকানাতে তার নিয়মিত যাতায়াত । কিন্তু পুলকের সাথে এসবের সম্পর্ক কি ?
আরিয়ান বের হয়ে গেলো ।
ঠিকানা মতো জায়গায় পৌঁছে দেখলো পুলক দাঁড়িয়ে আছেন ।
তাকে দেখেই বললেন , ভাইভা তো ফাটিয়ে দিলে । এখন কি করবে ?
– আপনি কে বলুন তো ? সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আরিয়ান ।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুলক বললেন , তোমার বাবা জব কোচিং করার জন্য তোমাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাই না ? সেই টাকাটা কোথায় ?
চুপ করে শুনছে আরিয়ান !! কিছু বলছে না ।
মাস্টার্সে যখন সেমিস্টার ফাইনাল দিচ্ছিলে তখনো বাবার থেকে মিথ্যে বলেও কিছু টাকা খসিয়েছো । সেগুলো কোথায় ?
বলে চললেন পুলক !!
তিন বছর আগে তুমি বাসার সামনের গলির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলে । অন্ধকার রাত । কারেন্ট চলে গেছে । গভীর রাত হওয়ায় আশে পাশে কেউ নেই ।
তোমার বাসা থেকে কিছু দূরে ডাস্টবিনের কাছে এক পাগলী পড়ে ছিল । ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল সে । আল্লাহর কোন বান্দা তাকে গিয়ে সাহায্য করে নাই ।
তুমি সেই পাগলির কাছে গেলে ।
গিয়ে বুঝলে পাগলী প্রেগন্যান্ট । কোন এক অমানুষ তার শরীরটাকে কামনা মেটানোর কাজে ব্যাবহার করেছে । লেবার পেইন নিয়ে পাগলীটা পড়ে আছে ডাস্টবিনের কাছে । দেখার কেউ নেই ।
কিছু না ভেবেই তুমি তাকে নিয়ে গেলে হাসপাতালে ।
৬ ঘন্টা অসহনীয় প্রসব যন্ত্রনা সহ্য করে সেই পাগলি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো । জন্ম দিয়ে গেলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা । যার বাপের পরিচয় কেউ জানে না । সমাজ যাকে বলে জারজ ।
বেওারিশ পাগলীটার লাশ দাফনের দায়িত্ব নিলে তুমি । সেই সাথে বাচ্চাটারও ।
তুমি তাকে একটা এতিম খানায় দিয়ে দিলে । গত ৩ বছর ধরেই তার খরচ চালিয়ে আসছো তুমি । এই কথা তুমি আর তোমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না ।
থামলেন পুলক !!
আরিয়ানের চোখ দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে ।!!
বাপের কাছে গিয়ে দ্বিতীয়বার টাকা চাইবে সেই সাহস তোমার নাই । মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তুমি ।
এর মধ্যে একটা এতিম সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছো । তাও আবার কাউকে না জানিয়ে । আল্লাহ তো সব দেখেন । তাই না ?
ওই এতিমের একটা খরচ আছে ।
এদিকে তোমার চাকুরী হয় না ।
বাবা তোমাকে খোঁচা দেয় । আত্মীয়রা বেকার বলে । কি ক্রাইসিস !!
পাগলি মারা যাওয়ার আগে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিল । এবং সেটা সাথে সাথেই কবুল হয়ে গেছে !!
আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন তার এই বান্দাকে তিনি কখনোই রিজিকের অভাবে রাখবেন না । এখন বাকিটা বুঝে নাও ।
আসলে তোমাকে লবিং করা হয় নাই ।
শুধু সঠিক মানুষটাকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে ।
এইটাই নিয়ম । স্রষ্টা কখনোই এই নিয়মের ব্যাতয় ঘটতে দেন না ।
আরিয়ান তখনো কেঁদেই চলছে । পুলক তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন , দেখো বাচ্চাটার বয়স তিন বছর হয়ে গেছে । তাকে কোরানের হাফেজ বানিও । তার অভিভাবক হয়ে যাও । আল্লাহ তোমার অভিভাবক হয়ে যাবেন ।
আর হ্যা নিজের ভালো কাজের জন্য প্রতিদান আশা করবে না । সময়ই সব কিছু ফিরিয়ে দেবে ।
—–
১৮ বছর পর …
নিজের এসি রুমে বসে আনমনে ভেবে চলেছেন আরিয়ান রহমান ।
সেদিনের পর পুলক নামের ছেলেটির সাথে আর দেখা হয় নি আরিয়ানের । ছেলেটা কিভাবে এলো ,কেন এলো , আর কোথায় মিলিয়ে গেলো তাও জানে না ।
চাকুরীটা তার হয়েছিল ।
সেই চাকুরীতে পদোন্নতি পেয়ে এখন সে একটা ব্রাঞ্চের প্রধান । দেখতে দেখতে অনেক সময় কেটে গেছে । এতিম খানার যে ছেলেটির দায়িত্ব আরিয়ান নিয়েছিল সে কোরআনের হাফেজ হয়েছে ।
আরিয়ানের চুলেও হালকা করে পাক ধরেছে । বয়েস হচ্ছে তো !! কিন্তু সেই অদ্ভুত ঘটনাটি এখনো ভুলতে পারেনি । একটা কথা কিন্তু ঠিক আল্লাহ তাকে কখনোই রিজিকের অভাবে রাখেন নি ।
কারন ভালো মানুষের কখনোই রিজিকের অভাব হয় না
Arafat Abdullah (মধ্যরাতের অশ্বারোহী)
University Of Chittagong
ONEK VALO LAGLO GOLPOTA
ধন্যবাদ। নতুন নতুন লেখার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।