জিগুরাত: পৃথিবীতে ঈশ্বরের নিবাস

837
0
Source www.gmwordoftheweek.com

সভ্যতা আমাদের এমন কিছু সংস্কৃতির তথ্য দেয় যার জন্ম হয়, সেটি টিকে থাকে এবং কালের পরিক্রমে ধুলিসাৎও হয়ে যায়। আঠারো শতক পর্যন্ত এসব সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার প্রয়াস হয়নি বা কোন উপায় ছিল না। তবে এর পরবর্তী সময়ে বিশ্বের নানা সভ্যতা সম্পর্কে গবেষণা হয় এবং তা থেকে উঠে আসে অকল্পনীয় সব তথ্য আর নানান বিষয়।

এমন একটি সভ্যতা হচ্ছে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতার অন্যতম এক স্থাপনা ছিল জিগুরাত। আজকের আয়োজন এই প্রাচীন স্থাপনা নিয়ে।

Mesopotamia - Wikipedia
মেসোপটেমিয়ার মানচিত্র – Source: Wikimedia.commons

জিগুরাত একটি স্থাপত্যের ধরণ যা সাধারণত চতুর্ভুজ আকৃতির হয়ে থাকে। সুমেরীয়রা জিগুরাতকে উনির (Unir) এবং আক্কাদীয় ভাষায় জিগুরাতুন বা জিগুরাত বলা হতো । উভয় শব্দের অর্থ চূড়া এবং উচ্চতর স্থান। জিগুরাতকে পিরামিডের মতো মনে হলেও এটি আসলে পিরামিডের মতো নয়। পিরামিডের আকৃতি ফাঁপা, তবে জিগুরাত মূলত পাহাড়ের মতো নিরেট।

এজন্য জিগুরাতকে কৃত্রিম পাহাড়ও বলা হয় যেটা কিনা একটি সমতল জায়গার উপর অনেকগুলো সিঁড়ির মাধ্যমে উঁচু করে মন্দিরের ভিত্তি দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে যে, এই পাহাড়সদৃশ জায়গাটি উপাসনা করার জন্য তৈরি করা হয় যাতে করে সেকালের যাজকরা ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারে।

The Ancient and Forgotten Sumer Civilization | History of Yesterday
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার চিত্রশিল্প – Source: History of Yesterday

উবাইদের অধিবাসীরা পাহাড় থেকে এসে সমতল মেসোপটেমিয়াতে নেমে সুমেরীয় জাতিকে প্রভাবিত করতো বলে ধারণা করা হয়। এতে করে ধর্মীয় স্থান হিসেবে প্রথম জিগুরাত বানানো হয়। সুমেরীয়রা এসব কাঠামোকে পাহাড় বলেই উল্লেখ করতো।

সুমেরীয় উরুক সময়কালে জিগুরাত প্রতিটি শহরেই নির্মাণ করা হতো। এই জিগুরাতগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক দেবতাকে (Patron Deity) শ্রদ্ধা জানাতো।

বলে রাখা ভালো যে, এসব মন্দিরের ভিত্তি অর্থাৎ জিগুরাতগুলো সর্বজনীন উপাসনা কেন্দ্র ছিল না। মূলত এগুলোকে ঈশ্বরের পার্থিব বাড়ি (Earthly Home of God) বলা হতো; যেখানে যাজকরা উপস্থিত থাকতো এবং সমাজকে শাসন করতো।

Ziggurat - Wikipedia
জিগুরাতের ছবি Source: wikimedia.commons

আবার এমন এক পর্যায়ও আসে যখন শাসকরা এইসব যাজকদের প্রভাব কমানোর জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। তারা জিগুরাতকে এমন এক শক্তির উৎসে পরিণত করতে চায় যাতে করে সবাই শাসকদের বিরুদ্ধে কথা না বলতে পারে।

সুমেরীয়দের এই জিগুরাত নির্মাণের পর থেকে আরো অনেকেই জিগুরাত নির্মাণ করতে থাকে। ব্যবিলনীয় এবং অ্যাসিরীয় শাসনকালেও জিগুরাত নির্মাণ হতে দেখা যায়।

উদ্দেশ্য

আগেই বলা হয়েছে যে, জিগুরাতকে দুনিয়ায় ঈশ্বরের বাড়ি হিসেবে আখ্যা দিতেই নির্মাণ করা হয়। হেরোডোটাস বলেন যে, ‘মারদুক’ নামক দেবতা পৃথিবীতে এসে একজন মহিলার সাথে রাত্রিযাপন করতো। এতে করে ঐ এলাকার মানুষদের উর্বরতা যেন বৃদ্ধি হয় তার আভাস দেওয়া হয়।

Marduk - Wikipedia
দেবতা মারদুক Source: wikimedia.commons

আবার বার্টম্যানের মতে, জিগুরাত তৈরির উদ্দেশ্য হচ্ছে নিরাপত্তা ও খাদ্য সংরক্ষণ করা। যদিও ইতিহাসবিদ সিকুলাস (Siculus) বলেন যে, এটি পর্যবেক্ষণাগারও হতে পারে। তার মতে, ব্যবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তারার অবস্থান দেখার জন্য জিগুরাতকে ব্যবহার করতেন। কেননা অতি উচ্চতার কারণে আকাশে তারা অবস্থা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যেতো।

জিগুরাতগুলো রোদে শুকানো মাটির ইট দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এর কোন অভ্যন্তরীণ চেম্বার ছিল না। এরপর কাঠামোটিকে তাপে শক্ত হওয়া ইটের সাথে অলংকৃত ও চিত্রিত করা হয়েছিল।

M. Willis Monroe - Babylonian Horoscopes
ব্যবিলনের হরোস্কোপ Source: M.Willis Monroe

জনগণের একত্রিত হওয়ার জন্য বিশাল জায়গা, সর্বোচ্চ চূড়ায় প্রশস্ত জায়গায় মন্দির, যাজকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক নানা কাজের অফিসগুলো জিগুরাতের সেই মাটির দ্বারা তৈরি ইটের প্রাচীর ঘিরে ছিল।

টাওয়ার অফ ব্যাবেল

ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখিত রাজা নেবুচাঁদনেজারের শাসনামলে এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ৪৩ বছর পরে। বলা হয়ে থাকে এটি তৈরিতে ১৭ মিলিয়নের মতো ইট পোড়ানো হয়। এই ইটগুলোর মধ্যে কিছু ইট কিউনিফর্মের শিলালিপি দিয়ে স্ট্যাম্প করা হয়েছিল।

এই জিগুরাতটি পূর্বে ইটিমিনাঙ্কি নামে পরিচিত ছিল, পরে টাওয়ার অফ ব্যাবেল নামে পরিচিত হয়। উক্ত ইটগুলোর মধ্যে যেসব ইট টিকেছিল তাদেরকে টাওয়ার অফ ব্যাবেল ব্রিক বলা হয়। ইটের এই শিলালিপিকে কার্সন হ্যানসার্ড ‘আর্ট অফ প্রিন্টিং’-এর সর্বপ্রথম পদক্ষেপ বলে তার বইয়ে উল্লেখ করেন।

Tower of Babel - Wikipedia
টাওয়ার অফ ব্যাবেল Source: Wikimedia.commons

এর উচ্চতা ১৭৭ ফিট বা ৫৪ মিটার ছিল বলে ধারণা করা হয়। অ্যালেকজান্দার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর সময় এই জিগুরাত সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। তখনকার সময়ে সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলতো এবং একটি কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিল যার মাধ্যমে তারা স্বর্গে পৌঁছাবে বলে জেনেসিসের গল্পে উল্লেখ করতে দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ সেই কাঠামোটি হচ্ছে টাওয়ার অফ ব্যাবেল।

যদিও ‘টাওয়ার অফ ব্যাবেল’ শব্দটি বাইবেলে উল্লেখ হয়নি বলে জানা যায়। এতে করে তত্ত্ববিদগণের মধ্যে ইটিমিনাঙ্কি কিভাবে টাওয়ার অফ ব্যাবেলে রুপ নিলো তা নিয়ে অনেক মতভেদ দেখা যায়।

গ্রেট জিগুরাত অফ উর

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের অন্যতম প্রাচীন সুমেরিয়ান সিটি ষ্টেট এটি। এটি জিগুরাতগুলোর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় এবং দর্শনীয় কাঠামো বলে উল্লেখ করা হয়। এটি বর্তমান ইরাকের ‘ধি’ নামক অঞ্চল থেকে দক্ষিণে অবস্থিত বিশাল কাঠামো যার দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার, প্রস্থ ৪৬ মিটার এবং উচ্চতা ৩০ মিটার।

Great Ziggurat of Ur (Illustration) - World History Encyclopedia
জিগুরাত অফ উর Source: World History Encyclopedia

মূলত অনেক উচ্চতার হওয়ার জন্য এটি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এর নির্মাণ রাজা উর নাম্মুর শাসনামলে শুরু হয়। তার মৃত্যুর পর ছেলে রাজা শুল্গি এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। এটি মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত ছিল যেটি কিনা তখনকার সময়ে প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত হতো।

‘গ্রেট জিগুরাত অফ উর’ মুন গড নান্নাকে (Moon God Nanna) উৎসর্গ করে বানানো হয়। উরের পশ্চিম পাশে একটি রান্নাঘর আছে যেখানে ঈশ্বরের জন্য রান্না করা হতো বলে ধারণা করা হয়।

Archaeological photo gallery of the Arabian Moon-God
মুন গড নান্না Source: Bible.Ca

শুল্গি প্রায় ৪৮ বছরের মতো ক্ষমতায় থাকেন। এত সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার দরুন সে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে যেখানে নানা সত্তার মানুষ অন্তর্গত হয়। বিভিন্ন ধরণের এই মানুষকে এক রাখতে সে তার কূটনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। অন্যসব ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে শুল্গি নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা করেন।

এতে করে তার নানা ভালো কর্ম প্রচার হতে থাকে এবং একসময় ‘প্যাট্রন অফ আর্ট’ হিসেবেও পরিচিতি পান। যদিও শুল্গির মৃত্যুর পর উরের পতন ঘটা শুরু হয়। বৈদেশিক আক্রমণে নানা অঞ্চলের রাজারা অঞ্চলটিতে রাজত্ব করে।

ANE TODAY - 201702 - Shulgi, King of Cleveland: Ask a Near Eastern Professional - American Society of Overseas Research (ASOR)
কিং শুল্গি Source: American Schools of Oriental Research

চোগা জানবিল জিগুরাত

বর্তমানে টিকে থাকা সবচেয়ে বড় এবং অক্ষত জিগুরাত হলো চোগা জানবিল (Chogha Zanbil) । এটি মধ্য এলামাইট সময়কালে তৈরি হয়। রাশিয়ান ফ্রেঞ্চ প্রত্নতত্ত্ববিদ রোমান গির্সম্যান প্রথম বৈজ্ঞানিক খননের মাধ্যমে এর মাটির ভেতর অক্ষত পাঁচতলাবিশিষ্ট জিগুরাত পান।

হাফট তেপেহ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জিগুরাতটি দেখতে ঝুড়ির মতো। চোগা শব্দের অর্থ পর্বত এবং জানবিল অর্থ একধরণের ঝুড়ি। মূলত আকারের উপর ভিত্তি করেই এর নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে মত দেন। জিগুরাতটির সম্পূর্ণ উচ্চতার অংশ অবশিষ্ট নেই, তবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১০৫ ও ৫৩ মিটার।

Chogha Zanbil | Meaning, History, & Facts | Britannica
চোগা জানবিল জিগুরাত Source: Encyclopedia Britanica

এছাড়াও আরো কয়েকটি জিগুরাত রয়েছে। পূর্বে এই ধরণের স্থাপত্য ও  সভ্যতার অনেক কিছুই গবেষণা করা হতো না। এখন সেই দিন আর নেই। বিশ্বের মধ্যে নানান সময়ে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এটি আলোচনা এবং আবিষ্কার শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত না।

এর সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষকে কিভাবে সতর্ক করা যায় সে বিষয়েও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে যাতে করে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষদের চাল-চলন সম্পর্কে জানতে পারে।

 

Feature Image: gmwordoftheweek.com 
References

01. The Great Ziggurat of Ur. 
02. Construction of the Etemenanki Ziggurat. 
03. Ziggurat. 
04. Chogha Zanbil.