ঘরকুনো বলে বাঙালির বদনাম আছে। সে সহজে তার আরামের জায়গা ছেড়ে নড়তে চায় না। ঘর হতে বেরিয়ে পৃথিবী দেখতে চায় না। বাঙালির মহান কবি রবি ঠাকুর তো বিরক্ত হয়ে বলেই দিয়েছেন,
অন্নপায়ী বঙ্গবাসী, স্তন্যপায়ী জীব।
বাঙালির এই ঘরকুনো স্বভাবের পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তা সন্ধান করা আপাতত আমাদের কাজ নয়। আমরা আজকে জানবো যে ঘরকুনো এই বাঙালিরই এক সন্তান যুক্ত হয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লবে। জামর নামে সেই বিপ্লবী কেবল বাঙালিই না, একেবারে চট্টগ্রামের ছেলে।
শেষ থেকে শুরু…
গত পাঁচশ বছরে এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা পৃথিবীর রূপ বদলে দিয়েছিল। ফরাসী বিপ্লব তার মধ্যে অন্যতম। ১৭৮৯ সালে শুরু হওয়া ফরাসী বিপ্লবের পরেই অর্থ, বাণিজ্য, শিল্পে নতুন জোয়ার এসেছিল। রুশ বিপ্লবের বহু আগে ঘটা ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব এতো বেশি ছিল যে বলা যায় পৃথিবীর আজকের এই রূপ, নিয়ম এবং অবস্থার পেছনে ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই বিপ্লবে একজন বাঙালি অংশ নিয়েছিল সে খবরটি সত্যিই আশ্চর্যজনক এবং উত্তেজক।
ফরাসী বিপ্লবের পরপর বিপ্লবীদের হাতে গ্রেফতার হন সম্রাট লুইয়ের রক্ষিতা কাউন্টেস দ্যু বারি। বিপ্লবের সময়ে বা তার আগে এবং পরে ফরাসি অভিজাতদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন তিনি যা বিপ্লবীদের জন্য বিপদের কারণ হয়েছিল। কিংবা ‘এলিট’ শ্রেণীর একজন হিসেবে দ্যু বারি ছিলেন বিপ্লবীদের শত্রু। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকে গ্রেফতার করে আদালতে আনা হলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে দাঁড়ায় তার নিজের হাতে তৈরি কৃষ্ণকায় এক ভৃত্য, যাকে নাকি বারি নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করতেন। মাদামের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়া জুবকের নামই জামর। মাদামকে যখন গিলোটিনে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মামলার নথিপত্রে সাক্ষর করে সে লিখেছিল,
লুই বেনো জামর। ভারতের বাংলায় জন্ম…।
জামরের অতীত
যদিও বাঙালি ঘরকুনো কিন্তু তার সেই ঘরকেও সে ঠিকমত নিরাপদে রাখতে পারেনি। বারবার বিদেশীদের পদানত হয়েছে বাংলা। মোগল পর্যন্ত অন্তত তারা শাসন করেছিল। কিন্তু সমুদ্র ধরে যখন ইউরোপীয়রা এলো, তারা শোষণ বেশি করতে শুরু করল। এদের মধ্যে পর্তুগিজদের অত্যাচারের তুলনা ছিল না। দস্যুতা, লুণ্ঠন তাদের নিত্যদিনের কাজ হয়ে উঠেছিল। লুণ্ঠনের বেলায় তারা মানুষ লুঠ করতে পছন্দ করত আরও বেশি। দাস ব্যবসা তখন রমরমা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন ক্ষমতা লাভ করেছে তখন পর্তুগিজরা উপকূলে নির্বিচার লুণ্ঠন করে চলছিল। তেমনই এক লুণ্ঠনের সময় তাদের হাতে ধরা পড়ে ১১ বছর বয়সী জামর।
নামটা যদিও নথিপত্র থেকে জামর বলে জানা যায়, আমরা যেহেতু এখন জানি সে চট্টগ্রামের ছেলে, ধরে নিতে পারি তার আসল নাম জমির কিংবা জামির হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। হোক বা না হোক, জামর যে ভাষা বদলের কারণে নাম হয়েছে তা বোঝা যায়। জামরের জন্ম এবং ধরা পড়া নিয়ে সময়কালের হিসেবে কিছু গড়মিল আছে। তবে মোটামুটি আন্দাজ করা যায় সে ১৭৬০ সালের দিকে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়ে এবং তখন তার বয়স ছিল ১০/১১ বছর। পর্তুগীজ এবং স্প্যনিশদের হাত বদল হয়ে এক সময় সে ফ্রান্সে পৌঁছে এবং তাকে কাউন্টেস দ্যু বারির জিম্মা করা হয়।
দাস হিসেবে ব্যবহার করা হবে এই সিদ্ধান্তের পরও জামরকে খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। ১৭৭০ সালে তাকে ব্যাপ্টাইজ করা হয়। রিচেলিউয়ের ডিউক ফ্রান্সিস এবং মাদাম বারির তত্ত্বাবধানে এই অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। মাদাম নিজেই জামোরের ‘গডমাদার’ হয়েছিলেন। এখান থেকে মনে হয় জামরের প্রতি মাদামের স্নেহ ছিল। কিন্তু আসলে সেটা স্নেহ ছিল, নাকি জামরকে খ্রিস্টান করার জন্য স্নেহ দেখিয়েছিলেন সেটা একটি প্রশ্ন।
ফ্রান্সে জামরের জীবন
ব্যাপ্টাইজ করার পর জামরের নাম হয়েছিল লুই বেনো। অনুষ্ঠানের বর্ণনায় দেখা যায় জামরকে একটি সাদা পোশাক পরানো হয়েছিল যাতে দেওয়া হয়েছিল রুপার বোতাম। অনেকে লিখেছেন জামরের প্রতি মাদামের ভালোবাসা ‘মায়ের মতো’ ছিল কিন্তু মাদাম বারির লেখা পড়লেও মনে হয় জামরের প্রতি তার স্রেফ একটা অদ্ভুত কৌতূহল ছিল। তিনি জামরকে নিয়ে খেলতে মজা পেতেন। জামরকে সাজিয়ে বা অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা দ্যু বারির একটা বিলাসিতা ছিল।
আবার এমনও হতে পারে, জামর নিজেই মাদামের সাথে কোন খারাপ আচরণ করেছিল। কারণ দাস হিসেবে নেওয়া হলেও তার তেমন কোন কাজ ছিল না। মাদামের ফাই ফরমাস খাটার বাইরে তাকে কিছু করতে হয়নি। অন্যদিকে তাকে শেখানো হয়েছিল দ্রুপদি দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি। এসব কারণে জামর নিজেও দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। কিংবা মাদাম বা এলিটদের আচরণ তার আর পছন্দ হয়নি। জামর তা লুকাতে চেষ্টাও করেননি। মাদাম তার প্রতি বিরূপ হয়েছিলেন। মাদাম বারি লিখেছেন,
প্রথমে আমি তাকে ছোট্ট পুতুলের মতোই দেখতাম। ধীরে ধীরে ছেলেটির প্রতি আমার মায়া জন্মাতে শুরু করে। এই শজারুটিও আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পড়ে সে বেয়াড়া আচরণ শুরু করে।
এখান থেকেই জামর অনেকগুলো সুত্র পাওয়া যায়। প্রথমত মাদাম আসলেই তাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন কিন্তু জামর কী আসলেও মনোযোগ পেয়েছিল? পায়নি, কেননা মাদাম তাকে আফ্রিকান বলে জানতেন। নিগ্রো বলে সম্বোধন করতেন। দ্বিতীয়ত, আমরা জানলাম যে চট্টগ্রামের ছেলে হলেও জামরের চেহারা ছিল কালো অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ। এমনকি তার চুল ছিল খাড়া খাড়া। এই কারণেই তাকে শজারু বলে সম্বোধন করেছেন কাউন্টেস বারি।
অন্যদিকে, জামরের এই দুর্বিনীত হয়ে ওঠার পেছনে একটি কারণ হতে পারে তার পড়াশোনা। অর্থাৎ সচেতনতা। দাস হিসেবে আটক হওয়ার কারণে জামরের মনে ক্ষোভ ছিল। প্রথমে তা প্রকাশ হয়নি। কিন্তু পড়াশোনা করার পর সে নিজের অধিকার, দাবী ইত্যাদি বুঝতে পারে। পাশাপাশি সেই সময়ে প্যারিসে অসন্তোষ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে জামরদের মতো মানুষেরা কেউই তার বাইরে ছিল না। অন্যদিকে জামর পড়েছিল জা জাঁক রুশোর বই। ফলে বিপ্লবের বীজ তার মধ্যে বেড়ে উঠছিল।
ফরাসী বিপ্লবে জামর
বিদ্রোহের বীজ রোপিত হলে সে নিজেই বাকিটা খুঁজে নিয়েছিল। সে সময়ে প্যারিসে দোকানে, ক্যাফেতে গোপনে পরিকল্পনা চলতো। জামর সেসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এসময় গোপনে জ্যাকবপন্থী বিপ্লবীদের সাথে তার যোগাযোগ তৈরি হয়। ফরাসী বিপ্লব শুরু হলে জামর সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তীতে কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয় এই বাঙালি।
বিপ্লবীদের হাতে সম্রাটের পতনের পর প্রাসাদ থেকে মাদাম বারিকে বের করে দেওয়া হয়।
শুরুতে যেমন বলা হয়েছে, ফরাসি অভিজাত শ্রেণির উপর তাঁর প্রভাব ছিল গভীর। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময় তিনি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন। ফলে বিপ্লবীরা তাকে গ্রেফতার করে। প্রথমবার বাধ্য হয় ছেড়ে দিতে। তথ্যপ্রমাণের অভাবে তাকে শাস্তি দেওয়া যায়নি। ৬ ডিসেম্বর ১৭৯৩ তিনি আবার গ্রেপ্তার হলে সাক্ষী হিসেবে জামরকে হাজির করা হয়। মজার ব্যপার জামর নিজেও বারির কাছে নিজের পরিচয় দেননি। মাদাম বারি তাকে যে কৃষ্ণাঙ্গ জানতেন, জামর সেই ভুল ভাঙেনি কখনও। এবার আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় দিয়েছিল,
আমি আফ্রিকার নই, চট্টগ্রামের ছেলে।
জামরের আচরণও ছিল কিছুটা রহস্যময়। নিজের পরিচয় না দেওয়া বা অন্যান্য কিছু কারণে। যেমন রয়্যাল কাফে থেকে জর্জ গ্রীভের সাথে জামরের বন্ধুত্ব ছিল। পরবর্তীতে এই গ্রীভ মাদামের বাড়িতে অভিযানের সময় তার অলঙ্কার চুরি করেছে এমন ধারণা করা হয়। এমনকি মাদামকে গ্রেফতারের পর গ্রীভ তাকে ধর্ষণও করে। এসব থেকে জামরের প্রতি অনেকের সহানুভূতি কমে যায়।
জামরের নিজের ভাগ্যও খুব একটা ভালো ছিল না। পরবর্তী জীবনে জামর বারবার মানুষের সাথে নানা ঝঞ্ঝাট তৈরি করেছে। মাদামের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার পরও মাদামকে সহযোগিতার অভিযোগে প্রথমে তার জেল হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবীরা তাকে ছাড়িয়ে নেন। এরপর জামরের জীবনযাপন ছিল নিভৃত।
১৮১৫ সালের পর সে আবার প্রকাশ্যে আসে এবং লাতিন কোয়ার্টারে থেকে একটি স্কুলে চাকরি নেয়। সেখানেই জামরের বদরাগী স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ছাত্রদের অমানবিক ভাবে পেটানো ছিল তার স্বভাব। এরকম অবস্থায় জামরের সাথে কারও সদ্ভাব তৈরি হয়নি। একদম নিঃসঙ্গ অবস্থায় ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জন্মভূমি থেকে বহু দূরে জামরের মৃত্যু হয়।
জামর বেঁচে আছে
জামরের ইতিহাস আসলে অদ্ভুত। কেননা তার কথা অনেকদিন অজানা ছিল আমাদের। কিন্তু এখন আমরা জানি জামরের প্রতিকৃতি আছে ফ্রান্সের ল্যুভরে। জামরকে নিয়ে এলখা হয়েছে উপন্যাস। মাদাম বারির লেখায় জামর তো আছেনই, ২০০৩ সালে ইভ রুজিয়ে নামের ফরাসি লেখিকা ‘লে রিভ দ্য জামর’ নামে জামরকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৭৮ সালে তাকে নিয়ে বেরিয়েছে কমিক স্ট্রিপ।
মারি ভিক্তর লোমোয়ার নামে ফরাসি শিল্পীর আঁকা জামরের প্রতিকৃতি আছে ল্যুভরে। সেখানে জামরকে দেখে কিছুতে বাঙালি মনে হয় না। ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেছেন তারা মনে করেন শিল্পী আসলে মাদাম বারির বর্ণনা থেকে প্রভাবিত। জামরের চেহারা এতোটাও আফ্রিকান নয়।
সে যা-ই হোক না কেন। ভালো-মন্দ আর জানা অজানার মধ্যেও জামর এখনও বেঁচে আছে ল্যুভরে, উপন্যাসে কিংবা কমিকে। এই বা কম কী!
Feature Image:
তথ্যসূত্র:
01. The Lost Child of Chittagong.
02. Zamor.
03. How an Indian man taken to Europe as a slave played a role in the French Revolution.