যোগব্যায়াম: কি, কেন এবং কীভাবে?

255
0

যোগব্যায়াম বা ইয়োগা হলো একটি বিশেষ ধরনের ব্যায়াম যা মন ও শরীরকে একত্রীকরণ করে দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি একটি শাস্ত্রীয় কৌশল, যা পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। এটিতে শুধুমাত্র দৈহিক কসরতই নয়, সাথে বিভিন্ন শ্বাস ক্রিয়ার মেলবন্ধনও রয়েছে। মনকে একাগ্র এবং স্থির রেখে শরীরকে বিভিন্নভাবে মুচড়িয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে বিভিন্ন কসরত করতে হয়। দেহ মন উভয়কে সুস্থ রাখতে যোগব্যায়াম ভালো একটি অনুশীলন।

যোগব্যায়াম কি?

‘যোগ’ বা ‘ইয়োগ’ একটি বিশেষ শব্দ যা ‘সংস্কৃত’ ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ যোগদান বা আবদ্ধ করা। এটি এমন একটি জিনিস যা চীন, জাপান, তিব্বত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং এমনকি ভারতে, যেখানে এটি শুরু হয়েছিল, বিভিন্ন দেশের লোকেরা জানে এবং অনুশীলন করে। বর্তমানে সারা বিশ্বে এটি সত্যিই খুব জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ‘বিশ্ব যোগ দিবস’ নামে একটি বিশেষ দিনও দেওয়া হয়েছে, যা প্রতি বছর ২১ জুন পালিত হয়।

এই বিশেষ প্রক্রিয়া সাধনের ফলে শরীর এবং মন সুস্থ থাকে। এটি শারীরিক স্বাস্থ্য, আচার-ব্যবহার, অনুভূতি, আবেগ এবং এমনকি আত্মিক দিক উন্নয়নেও সাহায্য করে। এর অর্থ হলো আপনার শরীর এবং মন একসাথে কাজ করে তা নিশ্চিত করা। কেউ যদি প্রায়ই যোগব্যায়াম করে, তাহলে তার থেকে অনেক ভালো কিছুর আশা করা যেতে পারে।

যোগব্যায়ামের উপকারিতা

যোগব্যায়াম করার অনেকগুলি উপকারিতা রয়েছে। যেখানে কেবল ব্যায়াম করলে দেহ সুস্থ থাকে, সেখানে যোগব্যায়াম দেহের সাথে সাথে মনকেও সুস্থ করে তোলে। প্রাণায়ন বা যোগব্যায়ামের কিছু উপকারিতা:

১. মনের শান্তি 

যোগব্যায়াম শুধুমাত্র শরীরকে শক্তিশালী করে না, মনকেও শক্তিশালী করে। এটা সুস্থতা, ভালো এবং সুখী বোধ করতে সাহায্য করে। মনের শান্তি মানে শান্ত এবং স্বস্তি অনুভব করা। যোগব্যায়াম শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। চিকিৎসকরা আবিষ্কার করেছেন যে, যোগব্যায়াম শরীর এবং মনের জন্য ভালো।

মস্তিষ্ক ও মনের মেলবন্ধন। Image Source: freepik.com

২. স্ট্রেসমুক্ত জীবন 

কেউ যদি নিয়মিত যোগব্যায়াম করে তবে এটি তাকে উদ্বেগমুক্ত জীবনযাপন করতে সহায়তা করবে। আজকাল অনেক লোক মানসিক চাপে থাকে, যোগব্যায়াম তাদের চাপমুক্ত করতে পারে। স্ট্রেসের কারণে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। কিন্তু যোগব্যায়াম মানসিক চাপ  কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে ঘুম ভালো হয় শরীর ও মন থাকে সুস্থ।

৩. শরীরের ক্লান্তি

যখন কেউ যোগব্যায়াম করে, তখন শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, যেমন- প্রসারিত করা অথবা মোচড়ানো। এটি করলে ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীরে শক্তি সঞ্চার হয়। তাই, নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে শরীরে প্রচুর শক্তি থাকবে, অল্প কাজেই ক্লান্তি ভাব দূর হবে।

৪. রোগমুক্ত শরীর

যোগব্যায়াম শরীরকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করে। যা অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করতেও সাহায্য করে। যাদের হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং হাঁপানির মতো রোগ আছে তাদের জন্য যোগব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকর একটি পন্থা।

৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ

বিশ্বের ৭০ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভোগেন। কিন্তু জীবনধারায় যোগব্যায়ামকে অন্তর্ভুক্ত করে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সহজ। যোগব্যায়াম শরীরকে আরও নমনীয় করে তোলে। যোগব্যায়াম পেশী শক্তিশালী করতে এবং শরীরের অতিরিক্ত চর্বি থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করে। এটি একটি সক্রিয় এবং শক্তিশালী পাচনতন্ত্র রাখতে ভূমিকা রাখে। ফিট এবং সুস্থ থাকার জন্য যোগব্যায়াম একটি দুর্দান্ত উপায়।

৬. তারুণ্যময় জীবন 

যোগব্যায়ামের কারণে শরীরে বার্ধক্যতা বা জরাজীর্ণতা দূর হয়। এবং তরুণদের মতোই শক্তি ও সৌন্দর্য দেহে সঞ্চালিত হয়। যার ফলে শরীর থাকে সুস্থ আর মন থাকে প্রফুল্ল। যোগব্যায়ামের কারণেই কিছু মানুষের বয়সের সংখ্যা বাড়লেও মনোবলের দিক থেকে থাকে তরুণ।

যোগব্যায়াম শরীর ও মনে এমন ভারসাম্য বজায় রাখে। Image Source: freepik.com

৭. শরীর শক্তিশালী থাকবে

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে অনেক কিছু মোকাবেলা করতে হয়। কখনো কখনো কাজ, শরীর এবং মনে অত্যাধিক চাপ সৃষ্টি করে। তখন শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং মনও হয় দুর্বল। যারা যোগব্যায়ামকে জীবনের একটি নিয়মিত অংশ করে তোলে তাদের এমন সমস্যায় পড়তে হয় না। কেননা, যোগব্যায়াম তাদের শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করে।

৮. পিরিয়ড ও গর্ভাবস্থার সমস্যা নিয়ন্ত্রণ

মেয়েদের পিরিয়ডের সময় ব্যথা নিরাময় করতে সাহায্য করে, নারীদের ডিম্বাশয় ভালো থাকে। ফলে প্রজননক্ষমতা বাড়ে। গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম অনুশীলন খুবই উপকারী। তবে অনুশীলনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৯. ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ 

যোগব্যায়াম রক্তে সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস আছে এমন লোকদের জন্য এটি সত্যিই সহায়ক। যোগব্যায়াম  শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতেও সাহায্য করে।

১০. অতিরিক্ত চিন্তা থেকে মুক্তি 

যোগাসন বিচলিত–বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এতে চিন্তা করার দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বাড়ে। যা কাজে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে।

যোগব্যায়াম করার নিয়ম 

সকালের সময় সূর্যোদয়ের এক থেকে দুই ঘন্টা আগে যোগের জন্য সেরা সময়। যদি সকালে সম্ভব না হয় তবে সূর্যাস্তের সময়ও করা যেতে পারে। তবে সকালের সময়ে যোগব্যায়াম করা উত্তম।

ভোরে যোগব্যায়াম করা উত্তম।। Image Source: pixabay.com

নিয়মিত যোগব্যায়াম করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, অভিজ্ঞ একজন ট্রেইনার থাকা উত্তম, যেন ভুল না হয়। সকালে বা সন্ধ্যায় যখন সূর্য উঠছে বা অস্ত যাচ্ছে তখন যোগব্যায়াম শুরু করা উচিত। আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে এবং শুরু করার পূর্বে গোসল সেরে নিলে বেশিক্ষণ যোগব্যায়াম করা যায়। মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে যোগব্যায়ামেই একাগ্রতা আনতে হবে। ধৈর্য্য ধরে ঘণ্টাখানেক কিংবা পরিমাণমতো অনুশীলন করতে হবে। নিজের শরীরের উপর অত্যধিক চাপ না দিয়ে যতটুকু সহনীয় ততটুকুই করা উত্তম।

যোগব্যায়ামের প্রকারভেদ ও নিয়ম 

১. রাজ যোগ

রাজযোগ হিন্দু যোগদর্শনের একটি শাখা। এই শাখায় ধ্যানের মাধ্যমে মনোসংযম এবং তার মাধ্যমে শেষে মোক্ষ লাভের কথা বলা হয়। রাজযোগ প্রথম আলোচিত হয়েছে পতঞ্জলির যোগসূত্র গ্রন্থে। এই যোগের আটটি অংশ রয়েছে, এই কারণেই ঋষি পতঞ্জলি এর নাম দিয়েছিলেন অষ্টাঙ্গ যোগা। এই ৮টি অঙ্গ নিম্নরূপ:

যম (শপথ), নিয়ম (আচরণের নিয়ম বা স্ব-শৃঙ্খলা), আসন (আসন করার মাধ্যমে), প্রাণায়াম (শ্বাস নিয়ন্ত্রণ), প্রত্যয়হর (ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ), ধরনা (ঘনত্ব), ধ্যান (ধ্যান), এবং সমাধি (পরম বা চূড়ান্ত মুক্তি)।

২. কর্ম যোগ

পরবর্তী শাখা হলো কর্ম যোগা বা সেবার পথ। কেউই এই পথ থেকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কর্ম যোগের মূলনীতি হলো ‘পরের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কর্ম সম্পাদন’।

কর্মের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মোক্ষ (মুক্তি) লাভই হলো কর্ম যোগের পথ। ফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে অথবা ফলাফল কি হতে পারে তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে ন্যায্যপথ অবলম্বন হলো এই কর্মযোগ। এটি হলো একজনের কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়া, এবং সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার মতো পুরস্কার বা পরিণামের প্রতি নিরপেক্ষ থেকে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে যাওয়া।

যোগবৃক্ষ। Image Source: harmonyyoga.com

৩. ভক্তি যোগ

ভক্তি-যোগভক্তির পথ বর্ণনা করে। ভক্তিযোগ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি ইতিবাচক পদ্ধতি। ভক্তির পথ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এবং সহনশীলতা গড়ে তোলার সুযোগ দেয়।

৪. জ্ঞান যোগ

যদি ভক্তিকে মনের যোগফল হিসাবে বিবেচনা করা হয়  তবে জ্ঞানযোগ হলো বুদ্ধির যোগফল। এই পথে চলার জন্য যোগের পাঠ্য এবং পাঠ্যগুলির অধ্যয়নের মাধ্যমে বুদ্ধির বিকাশ প্রয়োজন। এই জ্ঞানযোগকে সবচেয়ে কঠিন যোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটি গুরুতর অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।

বিভিন্ন আসন  

আসন হলো একটি নিশ্চল শারীরিক ভঙ্গি যার মাধ্যমে যোগব্যায়াম শুরু হয়। এটি হতে পারে যেকোনো ধরনের অবস্থান, ঝোঁকা, দাঁড়ানো, উল্টানো, মোচড়ানো এবং ভারসাম্যপূর্ণ ভঙ্গিও যুক্ত হয়। যোগাসনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু আসন হলো-

  • শীর্ষাসন

এই আসন হচ্ছে সব আসনের রাজা। এতে মস্তিষ্ক শুদ্ধ রক্ত পায় ফলে চোখ, কান, নাক ইত্যাদি ভালোভাবে কাজ করতে পারে। পিটুইটারি ও পিনিয়াল গ্ল্যান্ডকে সুস্থ করে তুলে মস্তিষ্ককে সুস্থ করে এবং স্মৃতি, মেধা বিকশিত করে। হিস্টিরিয়া, হার্নিয়া, অণ্ডকোষ বৃদ্ধি ইত্যাদি রোগ দূর করে, স্বপ্নদোষ, নপুংসকতা, বন্ধ্যত্ব ইত্যাদি ধাতু রোগকে নির্মূল করে। মুখমণ্ডলে এক আভা এবং তেজের সৃষ্টি করে, অসময়ে চুল পড়ে যাওয়া এবং পেকে যাওয়া বন্ধ করে।

ইয়োগার বিভিন্ন ভঙ্গিমা। Image Source: iStock
  • অষ্টবক্রাসন

বাহু এবং কব্জিকে প্রচণ্ড শক্তিশালী করে। পেটের মাংসপেশিগুলোকে শক্তিশালী করে এবং চর্বি কমায়। মনোযোগ ও ভারসাম্য বাড়ায়। মহিলাদের পিরিয়ড সমস্যা দূর করে এবং মেনোপজ হওয়ার পর যেসব জটিলতা দেখা দেয় সেগুলো থেকে মুক্তি দেয়।

  • চক্রাসন

মেরুদণ্ডের হাড়কে নমনীয় করে যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে। শরীরে স্ফূর্তি, শক্তি এবং তেজ বৃদ্ধি করে, কোমর ব্যথা দূর করে। নারীদের গর্ভাশয় বিকৃতিকে দূর করে।

  • বীর ভদ্রাসন

বাঁধ, বাহু, পা, গোড়ালি এবং পিঠের মাংসপেশিগুলোকে পরিপুষ্ট করে শক্তিশালী করে তোলে, রক্ত সঞ্চালন ও শ্বসন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়। ফুসফুস তথা বুকের প্রসারণ ঘটায়, অনুলোম-বিলোম প্রাণায়াম, সব ধরনের বাতরোগ, কফরোগ ও পিত্তের রোগ দূর করে। ধাতুরোগ, শুক্রক্ষয়, সাইনাস, হাঁপানি, টনসিল ইত্যাদি রোগ দূর করে ও হৃদয়ের ধমনিতে আসা ব্লকেজ পর্যন্ত খুলে যায়।

  • উত্থিত পদ্মাসন

পেটের বাড়তি চর্বি কমায়, হাতে প্রচণ্ড শক্তি আনে, হাত ও কাঁধের পেশি পুষ্ট করে।

পদ্মাসন। Image Source: Pixbay.com
  • গোমুখাসন

যোগাসনগুলোর মধ্যে অন্যতম এ আসনটির রয়েছে অনেক উপকারিতা। গোমুখাসন চর্চায় বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা ও সরল হয়। আসনটি কুচিন্তা ও দুশ্চিন্তা দূরীকরণে অধিক কার্যকর। হাত ও পায়ের পেশী এবং স্নায়ুজাল সবল ও সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া আসনটির নিয়মিত অভ্যাস রাখলে তা অর্শ, মূত্রপ্রদাহ, বাত বা সায়টিকা হবার হাত থেকে বাঁচায়।

সতর্কতা

হাড়ের সমস্যায় আক্রান্ত এবং কোমর যন্ত্রণায় ভুক্তভোগী কারোর করা উচিত নয়। অসুস্থতা, সার্জারি ও ফ্র্যাকচারের সময় এটি অনুশীলন করা উচিত নয়। কোনো আসন শুরু করার আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসক এবং ট্রেইনারের পরামর্শ নেওয়া।

 

 

 

Feature Image: pixabay.com

References:

01. How does yoga work?
02. Yoga: What You Need To Know.
03. Yoga benefits beyond the mat.