ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস: বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদ তরী

484
0
Image source: commons.wikimedia.org

কল্পনা করুন, একটা ১১০০ ফিটের জায়ান্ট মাঝ সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। জায়ান্টের ভেতরে আছে ৭ হাজার মানুষ। জায়ান্টটির ওজন প্রায় ২৩৬,৮৫৭ টন। ভয় পাওয়ার দরকার নেই। সত্যিকারের কোনো দৈত্য নয়, বলছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদ তরী অর্থাৎ সমুদ্র ভ্রমনের জাহাজের কথা। নাম ‘ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস।’

জাহাজে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নেওয়া এক ভ্রমন পিপাসু বলেছিলেন, “Jaws”-এ রয় স্কাইডারের চরিত্রটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য, আরো বড় সমুদ্রের প্রয়োজন হবে। যখন বিশ্বের বৃহত্তম ভ্রমন জাহাজ রয়্যাল ক্যারিবিয়ানের ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস-এর বিশাল বিশালতা দেখেছিলাম তখন আমি এটাই ভেবেছিলাম।

এক নজরে জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য-

তৈরির সাল: ২০২২, বয়স ১ বছর।
পতাকা: বাহামাস
প্রস্তুতকারক: আটলান্টিক শিপইয়ার্ড (সেন্ট-নাজায়ার, STX ফ্রান্স)
শ্রেণি: ওয়াসিস-প্লাস
তৈরির খরচ: ১.২ বিলিয়ন ইউরো। (১.৩৫ বিলিয়ন ডলার)
ইঞ্জিন ক্ষমতা: ৯৯.৭ মেগাওয়াট/ ১৩৩৭০০ হর্স পাওয়ার
গতি: ২২ নটস, ২৫ মাইল/ঘন্টা, ৪১ কি.মি./ ঘন্টা
দৈর্ঘ্য: ১১৮৮ ফিট/ ৩৬২ মিটার
প্রস্থ: ২১০ ফিট/৬৪ মিটার
ওজন: ২৩৬,৮৫৭ টন
লোক ধারণক্ষমতা: ৭০০০ যাত্রী+ ২৩০০ নাবিকদল
মালিকানা: রয়্যাল ক্যারেবিয়ান গ্রুপ

এর গতির (৪১ কি.মি./ঘন্টা) জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় ২০ হাজার কিলোওয়াটের ডিজেল-ইলেক্ট্রিক থ্রাস্টারসমূহকে। জাহাজে ৪টি থ্রাস্টার আছে যার প্রতিটি ৭,৫০০ হর্স পাওয়ার উৎপন্ন করতে পারে।

তৈরির ইতিহাস 

বলা হয়ে থাকে, ফলাফল যত সুন্দর হয়, সে ফলাফল নিয়ে আসার পেছনের গল্প তার চেয়ে বহুগুন পরিশ্রমের। ওয়ান্ডার অফ সিস যতটা চমৎকার, এই জাহাজকে তৈরি করার পরিশ্রম তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। একেবারে গোড়া থেকে বলতে গেলে, ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৫ শে মার্চ রয়্যাল ক্যারেবিয়ান গ্রুপ একটি মেমো স্বাক্ষর-এর মাধ্যমে। দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সের জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি ‘STX France’ যার বর্তমান নাম ‘আটলান্টিক শিপইয়ার্ড’।

Image source: cruisehive.com

কোম্পানির পঞ্চম ওয়াসিস প্লাস জাহাজের অর্ডার ছিল এটি। তৈরি সম্পন্ন করার ডেডলাইন দেওয়া হয়েছিল ২০২১ এর বসন্ত। জাহাজ তৈরির জন্য প্রথম স্টিল কর্তন করা হয় ‘সেন্ট নাজারিও’ শিপইয়ার্ড থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। তখন থেকেই শুরু হয় মূল কাজ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোভিড-১৯ এর কারণে রয়্যাল ক্যারেবিয়ান গ্রুপ ঘোষণা করে যে, নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব নয় ওয়ান্ডার ওফ দ্যা সিস। নতুন সম্ভাব্য ডেট দেওয়া হয় ২০২২ এর শুরুর দিকে। ২০২১ এর এপ্রিলে, রয়্যাল ক্যারেবিয়ান গ্রুপ তাদের উদ্বোধনের বুকিংস শুরু করে, এশিয়ার সাঙ্ঘাই ও হংকং পোর্ট থেকে। এরপর তৈরি প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কোনো বাধা দেখা দেয়নি।

২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর জাহাজটির শেষ কাজ সম্পন্ন করতে ২৯ অক্টোবর ২০২১-এ রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ‘প্রযুক্তিগত ডেলিভারির’ জন্য জাহাজটি গ্রহণ করে এবং পরের সপ্তাহে এটিকে সেন্ট-নাজায়ার থেকে মার্সেই-ফস বন্দরের একটি চ্যান্টিয়ার নেভাল ডি মার্সেই ড্রাইডে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০২২-এর জানুয়ারির ২৭ তারিখে জাহাজটিকে রয়্যাল ক্যারেবিয়ানের কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে।

প্রথম যাত্রা 

মার্চ ৪, ২০২২; সমুদ্রে ভ্রমন পিপাসুদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রভ্রমণ জাহাজের পাল ছেড়ে দেওয়া হলো। এই দিনেই প্রথম সমুদ্রযাত্রার উদ্দেশ্য রওনা হয় ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস। যাত্রাস্থল ছিল ফ্লোরিডার লউডারডেল পোর্ট, গন্তব্য ছিল ক্যারিবিয়ান।

Image Source: cruisefever.net

ক্রুজ লাইনটি বিশ্বের বৃহত্তম ক্রুজ জাহাজে সমস্ত বয়সের অবকাশ যাপনকারীদের আমন্ত্রণ জানায় যাতে বিস্ময় এবং বিস্ময়ের উদ্রেক করার জন্য ডিজাইন করা সমস্ত-নতুন অ্যাডভেঞ্চার এবং রয়্যাল ক্যারিবিয়ান পছন্দের চূড়ান্ত সংমিশ্রণ উপভোগ করা যায়। যাত্রীদের মধ্যেও ছিল উত্তেজনার বারুদ। নতুন অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে যেন আর তর সইছে না। রাজকীয় সাজে সাজিয়ে তোলা হয় জাহাজটিকে।

তারপর শুরু হয় স্বপ্নের যাত্রা। যাত্রা ছিল গোটা এক সপ্তাহের। যাত্রা পথে এটি লাবেডি, সান জুয়ান, নাসাউ এবং পারফেক্ট ডে কোকেয়ে পরিদর্শন করে – রয়্যাল ক্যারিবিয়ান অতিথিদের জন্য একটি একচেটিয়া গন্তব্য। গোটা মার্চ ও এপ্রিল ধরে এটি ক্যারিবিয়ানে ৭ দিনের ভ্রমনযাত্রা বুকিং করতে থাকে। তারপর ভূমধ্যসাগরীয় পালতোলার উদ্দেশ্য এটি স্পেনের বার্সেলোনার ও তারপর রোমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

ডেকস এন্ড কেবিনস

ওয়ান্ডার অফ দ্য সিজ ক্রুজ শিপ ডেক প্ল্যানে ২৪০০ জন স্টাফ দ্বারা পরিবেশিত ৫৭৩৪ জন যাত্রীর (সর্বোচ্চ ক্ষমতা ৬৯৮৮) জন্য মোট ২৮৭৪টি স্টেটরুম রয়েছে। নৌকাটিতে ১৭টি ডেক (১৬টি যাত্রী-অ্যাক্সেসযোগ্য, ১১টি কেবিন), ২৬টি লাউঞ্জ এবং বার, ২৪টি লিফট, ৯-ডেক-উচ্চ জিপ লাইন, ২টি রক-ক্লাইম্বিং ওয়াল, ২টি ফ্লোরাইডার, মোট ১৯টি পুল রয়েছে। (৪টি সুইমিং পুল সহ, ১টি বাচ্চাদের জন্য), ৯টি আউটডোর জ্যাকুজি (২টি ক্যান্টিলিভারড সহ ঘূর্ণি পুল হট টব)। বোঝায় যাচ্ছে অফুরন্ত মজা লুটে নিতে পারবেন ডেক ও কেবিনগুলোতে।

ডেক প্ল্যান। Image source: disneycruiselineblog.com

ডেক-০২ → টেন্ডারিং-হাসপাতাল
ডেক-০৩ → আইস রিঙ্ক-কেবিনস
ডেক-০৪ → বিনোদনের জায়গা-ক্যাসিনো বি
ডেক-০৫ → বিহার-লবি-দোকান-স্পা
ডেক-০৬ → বোর্ডওয়াক-জিমন্যাশিয়াম-কেবিনস
ডেক-০৭ → কেবিনস-হেলিডেক
ডেক-০৮ → সেন্ট্রাল পার্ক-কেবিনস
ডেক-০৯ → কেবিনস
ডেক-১০ → কেবিনস
ডেক-১১ → কেবিনস ও ওয়ান্ডারল্যান্ড
ডেক-১২ → ব্রিজ-কেবিনস
ডেক-১৪ → কিডস-কেবিনস
ডেক-১৫ → লিডো-পুল গেম-ওয়াটার স্লাইড
ডেক-১৬ →স্পোর্টস
ডেক-১৭ → সুইট ক্লাস ১
ডেক-১৮ → সুইট ক্লাস ২-ওয়াটার স্লাইড
ডেক-১৯ →টপ ডেক

জাহাজটির কেবিনসমূহের তথ্য-

  • 24 ঘন্টা রুম সার্ভিস- ফি প্রযোজ্য হতে পারে।
  • এই কেবিনের জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য বিকল্পও উপলব্ধ।
  • মেঝে থেকে ছাদে ভার্চুয়াল বারান্দা।
  • চুল শুকানোর যন্ত্র।
  • ব্যক্তিগত বাথরুম।
  • রেডিও।
  • রাজকীয় বিছানা (দুটিতে রূপান্তরযোগ্য)
  • বসার জায়গা।

খাবার-দাবার

জাহাজের কিছু ফ্রি রেস্টুরেন্ট ও খাবার-

প্রধান ডাইনিং রুম: ডেক ৩, ৪ ও ৫-এ অবস্থিত, এই তিনতলার ভেন্যু সকালের নাস্তা, রাতের খাবার এবং দুপুরের খাবার পরিবেশন করে। মেনু প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়, এবং ক্রুজাররা নির্বাচন করতে পারে যে তারা তাড়াতাড়ি, দেরীতে বা যেকোনো সময় ডিনারে বসার বিকল্প পছন্দ করবে কিনা। এখানেই সমস্ত স্ট্যান্ডার্ড ক্রুজ স্ট্যাপল — এসকারগট, চিংড়ি ককটেল, স্টেক এবং গলদা চিংড়ি-এর কিছু নির্দিষ্ট রাতে পাওয়া যাবে।

জাহাজের রেস্টুরেন্ট। Image source:eatsleepcruise.com

দ্য উইন্ডজ্যামার: ডেক ১৫তে অবস্থিত, এই নৈমিত্তিক বুফে ডাইনিং ভেন্যুটি জাহাজের পুল ডেকের চারপাশে আকর্ষণীয়ভাবে মোড়ানো এবং বোর্ডওয়াক এলাকা দ্বারা খোদাই করা সমুদ্র এবং অভ্যন্তরীণ স্থানের দৃশ্য দেখায়। একটি আকর্ষণীয় প্রবেশপথের মধ্যে রয়েছে বসার জায়গা, পার্টির জন্য পালঙ্ক এবং প্রচুর হাত ধোয়ার স্টেশন।

সকালের খাবার, মধ্যাহ্নভোজন, রাতের খাবার এবং গভীর রাতের জল খাবারের জন্য উন্মুক্ত, এখানে বিভিন্ন ধরণের খাবার হল স্থানটির সেরা বৈশিষ্ট্য, উত্তর আমেরিকার ক্লাসিক থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের আঞ্চলিক স্বাদ পাবনে এখানে। আপনি যখন মিষ্টান্নর জন্য পাগল হয়ে উঠবেন তখন পনির নির্বাচন মিস করবেন না; এটি প্রবেশদ্বারের কাছে অবস্থিত।

সোলারিয়াম বিস্ট্রো: সোলারিয়াম বিস্ট্রো ডেক ১৫ এর সামনের দিকে অবস্থিত। যদিও রয়্যাল ক্যারিবিয়ান বলে যে এটি একটি বুফে সেটিংয়ে ভূমধ্যসাগরীয়-অনুপ্রাণিত খাবারের অফার করে, এটি বাস্তবে আরও বেশি আমেরিকান, এবং ক্যাভারনস উইন্ডজ্যামার থেকে গতির একটি চমৎকার পরিবর্তন।

বোর্ডওয়াক ডগ হাউস: ডেক ৬এ অবস্থিত আউটডোর বোর্ডওয়াক এলাকায় বোর্ডওয়াক ডগ হাউসে সুস্বাদু হট ডগ পাওয়া যায়।

ক্যাফে প্রোমেনেড: ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পটগুলির মধ্যে একটি, ডেক ৫ মিডশিপের ক্যাফে প্রোমেনেড দিনে ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এবং কফি, পেস্ট্রি, স্যান্ডউইচ এবং স্ন্যাকস পরিবেশন করে৷

ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস বনাম টাইটানিক 

ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজ। যা টাইটানিকের চেয়ে প্রায় ৫ গুন বড়। টাইটানিকের ওজন ছিলো ৪৬,৩২৮ টন আর ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস এর ওজন প্রায় ২৩৬,৮৫৭ টন। ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস টাইটানিকের চেয়ে দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ আর প্রস্থে প্রায় ১২৭ শতাংশ বড়।

টাইটানিক vs ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস। Image source:www.cruisehive.com

টাইটানিক যেখানে ৩৩০০ মানুষ ধারণ করতে পারতো সেখানে ওয়ান্ডার অফ দ্যা সিস প্রায় ৯২০০ মানুষ ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। তবে টাইটানিক এবং ওয়ান্ডার অফ দ্য সিসের একই রকম গতি রয়েছে, উভয়ই ২১ থেকে ২২ নট এবং সর্বাধিক সম্ভাব্য গতি প্রায় ২৩ নট। এটি প্রায় ২৫ মাইল প্রতি ঘন্টার সমান। যদিও গতি ভ্রমণ জাহাজের জন্য মুখ্য কোনো বিষয় নয়। এছাড়াও আরো অনেক দিক দিয়ে ওয়ান্ডার অফ দ্য সিস টাইটানিকের চেয়ে এগিয়ে আছে।

 

Feature Image: wikimedia.org
References: 

01. wonder-of-the-seas-worlds-largest-cruise-ship.  
02. wonder-of-the-seas-cruise-ship-sets-sail-for-first-time. 
03. royal-caribbeans-wonder-of-the-seas-overview-things-to-do. 
04. Wonder-Of-The-Seas.