ধর্ম মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংস্কৃতি, সমাজ, এমনকি জাতি গঠনেও যুগের পর যুগ ধরে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এই পৃথিবী বিভিন্ন ধর্মের আবাসস্থল। যার প্রত্যেকটির আবার নিজস্ব বিশ্বাস, অনুশীলন, সংস্কৃতি এবং আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। এবার তাহলে অনুসারীর সংখ্যার ভিত্তিতে একনজরে দেখে নেয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫টি ধর্মবিশ্বাস কোনগুলো:
খ্রিস্টধর্ম
খ্রিস্টধর্ম হলো বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম, যার আনুমানিক ২.৪ বিলিয়ন অনুসারী রয়েছে। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশেরও বেশি। খ্রিস্টধর্ম হলো একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম, যা যিশু খ্রিস্টের জীবন এবং শিক্ষার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি। খ্রিস্টানরা যিশু খ্রিস্টকে ঈশ্বরের পুত্র এবং মানবতার ত্রাণকর্তা বলে বিশ্বাস করে। খ্রিস্টানরা আরও বিশ্বাস করে যে, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন ও মারা গিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর তৃতীয় দিনে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন। আত্মত্যাগের ফলে মানুষের অনন্ত জীবন পাওয়া সম্ভব বলেও তাদের ধর্মবিশ্বাস।
খ্রিস্টধর্ম তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত: ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্টবাদ এবং অর্থোডক্স। প্রতিটি শাখারই আলাদা আলাদা নিজস্ব বিশ্বাস এবং অনুশীলন রয়েছে। তবে তারা সকলেই খ্রিস্টধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের একটি সাধারণ ভিত্তি নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিয়েছে। খ্রিস্টধর্মের প্রসার রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে শুরু হয়।
পরবর্তীতে তা ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ী এবং উপনিবেশকারীদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১.৩ বিলিয়ন অনুসারী নিয়ে ক্যাথলিক ধর্ম হলো খ্রিস্টধর্মের বৃহত্তম শাখা। ক্যাথলিক ধর্ম সর্বত্র পোপের কর্তৃত্ব এবং ধর্মানুষ্ঠানের গুরুত্বের উপর জোর দেয়।
অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ হলো গির্জার একটি বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠী, যা ১৬ শতকে ধর্মীয় সংস্কার থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থের পৃথক ব্যাখ্যা এবং এই ধর্মে বিশ্বাসী সমস্ত লোকেদের পুরোহিতে বিশ্বাসের উপর এরা আলাদা জোর দেয়। পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা অর্থোডক্সের অনুসারী ছিল। খ্রিষ্টধর্মের এটি তৃতীয় প্রধান শাখা। এটি মূলত ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেয় এবং পিতৃপুরুষদের কর্তৃত্বের উপর জোর দেয়।
বর্তমান বিশ্বের ওপর খ্রিস্টধর্মের গভীর প্রভাব লক্ষনীয়। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত থেকে শুরু করে এরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমনকি রাজনীতিকেও প্রভাবিত করেছে। তবে খ্রিস্টধর্ম ও এর ইতিহাস জুড়ে অনেক দ্বন্দ্বের সূত্রপাতও ছিল। কারণ ধর্মটির বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা এবং প্রভাবের জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেছে।
বর্তমানে,আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশীয় অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। তাছাড়া আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়াতে খ্রিস্টধর্ম প্রধান ধর্ম হিসেবেই বিবেচিত হয়।
ইসলাম
ইসলাম হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। যার আনুমানিক ১.৮ বিলিয়ন অনুসারী অ্আছে বর্তমানে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪% এরও বেশি। ইসলাম মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনদর্শন ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করে এই ধর্মের অনুসারীদের চলার নির্দেশ দেয়।
মুসলমানরা তাঁকে আল্লাহ্র প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রসূল বলে বিশ্বাস করে। ইসলাম ধর্ম এক ঈশ্বরে বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং এই ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম আল-কুরআন। যা আসমানী কিতাব বলে স্বীকৃত মুসলমানদের কাছে। সৌদি আরবকে বলা হয় ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার। এবং কাবা শরীফ হচ্ছে মুসলমানদের কাছে সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান। কেননা, এটি হচ্ছে মহান আল্লাহ্র ঘর।
বর্তমানকালে ইসলাম দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। এরা হলো: সুন্নি এবং শিয়া। এদের মাঝে সুন্নিরা ইসলামের বৃহত্তম শাখা। যা সমস্ত মুসলমানের ৮৫% এরও বেশি। আর শিয়া হলো ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। যা সমস্ত মুসলমানের প্রায় ১০-১৫%. তবে এই দুটি শাখার মধ্যে প্রাথমিক পার্থক্য হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
যেখানে সুন্নি মুসলমানরা ইসলামের প্রথম চার খলিফার বৈধতাকে স্বীকৃতি দেয়; সেখানে শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, হযরত আলী, যিনি সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) এর চাচাতো ভাই এবং জামাতা ছিলেন; তিনি রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর পর তার খিলাফাতের একমাত্র উত্তরসূরি হয়েছেন।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ইসলাম বিশ্বের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে আসছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায়, যেখানে এটি বেশ প্রভাবশালী ধর্ম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ অভ্যন্তরীণ আরও অনেক দ্বন্দ্ব ইসলামকে কিছুটা হলেও কলুষিত করেছে। ইসলাম হলো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার প্রধান ধর্ম। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও এই ধর্মের উল্লেখযোগ্য অনুসারী রয়েছে।
হিন্দুধর্ম
হিন্দুধর্ম হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। যার আনুমানিক ১.২ বিলিয়ন অনুসারী রয়েছে। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫%। হিন্দুধর্ম একটি বৈচিত্র্যময় ধর্ম যার কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা, পাঠ্য বা কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এটি বেদ নামক প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের একটি ধারা এবং একাধিক দেবদেবীর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
হিন্দুধর্ম প্রধানত ভারত এবং নেপালে চর্চা হয় সবচাইতে বেশি। তবে মরিশাস, ফিজি এবং শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য আরও অনেক দেশেই এর উল্লেখযোগ্য অনুসারী রয়েছে। হিন্দুধর্মের অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে, যার প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা নিজস্ব বিশ্বাস এবং অনুশীলন রয়েছে।
আদিকাল থেকেই হিন্দুধর্ম ভারতীয় সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে আসছে। সেইসাথে ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত এবং দর্শনকে প্রভাবিত করেছে। তবে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চলমান উত্তেজনাসহ হিন্দুধর্ম অনেক দ্বন্দ্বেরও সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
বৌদ্ধধর্ম
বৌদ্ধধর্ম হলো বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম। সমগ্র বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের আনুমানিক প্রায় ১.৫ কোটি অনুসারী রয়েছে। যা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৫%। বৌদ্ধধর্ম সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবন দর্শন ও শিক্ষার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত; যিনি গৌতম বুদ্ধ নামেও পরিচিত।
ঐতিহাসিকদের মতে, গৌতম বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে জন্ম নেন। বৌদ্ধধর্মে বিখ্যাত চারটি নোবেল ট্রুথ রয়েছে, যা প্রাচীন আটফোল্ড পাথের চারপাশে কেন্দ্রীভূত। এটিকে আলোকিতকরণ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির প্রতীকী কাঠামো প্রদানকারী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান এবং শ্রীলঙ্কার মতো এশিয়ার আরও অনেক দেশে এই ধর্মের উল্লেখযোগ্য অনুসারী রয়েছে। তাছাড়া, অনান্য মহাদেশ ও অঞ্চলের তুলনায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এশিয়ার অঞ্চলগুলোতেই বসবাস করে থাকে সবচাইতে বেশি মূলত আবহাওয়া ও নিবিড় ধর্ম চর্চার পরিবেশকেই পরিবেশবিদরা এর মূল কারণ হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
বৌদ্ধধর্মের মধ্যে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় অনেকগুলো আলাদা বিদ্যালয় এবং এর নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। তাছাড়া এদের প্রত্যেকটির নিজস্ব কিছু বিশ্বাস এবং অনুশীলন রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সবগুলোই মননশীলতা এবং সহানুভূতির উপর আলাদা জোর দেয়। অনেক পন্ডিতগণের মতে, বৌদ্ধধর্ম অ-ঈশ্বরবাদী ধর্ম। কারণ এখানে ইশ্বরের চেয়ে জীব ও প্রকৃতি প্রেমকেই শ্রেয় বলা হয়েছে এবং এদেরকেই এরা দেবতা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
শিখ ধর্ম
শিখ ধর্ম হল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম। এই ধর্মের আনুমানিক ৩০ লক্ষ অনুসারী রয়েছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১% এরও কম। শিখ ধর্ম ১৫ শতকে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে গুরু নানক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনি শুধু প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি বরং তার এই নতুন প্রতিষ্ঠিত ধর্মের চারিদিকে প্রসার ও প্রচার ঘটাতেও তিনি মূখ্য ভূমিকা রেখে গেছেন।
Featured Image: edudwar.com References: 1. https://www.findeasy.in/world-popuarlati. 2. https://www.britannica.com. 3. https://www.pewresearch.org.