বই পড়ার ইতিহাস আজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে শুরু হয়েছিল। বই পড়ার মতো মানসিক বিকাশে দ্বিতীয় কোন পন্থা নেই বলে অনেক বিশেষজ্ঞই বলে থাকেন। মস্তিষ্কের খাদ্য হিসেবে এই বই বহুকাল ধরে প্রচলিত আছে। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিং থেকে জানা যায়, নিয়মিত বই পড়ার ফলে একজনের বার্ধক্যজনিত স্নায়ুবিক সমস্যা যেমন অ্যালজেইমারসসহ ডিমেনশিয়ার মতো অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে।
এছাড়া, বই পড়ার কারণে একজন মানুষের মস্তিষ্কে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে যা তার ভবিষ্যতে বেশ কার্যকর অংশ হিসেবে কাজ করে থাকে। বই পড়ার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের সকলের উচিত নিয়মিত বই পড়া এতে করে মানসিক বিকাশ উন্নতির পাশাপাশি নিজের আলাদা চিন্তাশক্তির উৎপত্তি ঘটে। আজ জানবো একজনের কেন বই পড়া উচিত।
বই পড়ার সুফল
অনেকের কাছেই বই পড়া বিরক্তির কাজ হলেও বই পড়ুয়াদের কাছে বই পড়া স্বর্গসম মনে হয়। বই পড়ার সুফল হিসেবে প্রথমেই আসে এটি একজনের মানসিক উন্নতিতে কতটা প্রভাব ফেলে। অন্যান্যদের তুলনায় একজন পড়ুয়া একটি বিকশিত মনের অধিকারী হয়ে থাকে।
বই পড়ার মধ্যে যে আনন্দ, অন্য জগতে ডুবে যাওয়ার সুবিধা তা খুব সহজেই অনুভব করতে পারে তারা। পাঠ্যবইয়ের একঘেয়েমি দূর করতে সক্ষম হয় এই বই পড়ার মধ্যেই! বিনোদনের উপাদান হিসেবে যারাই বই পড়াকে বেছে নিয়েছে তারা আর পিছনে ফিরে তাকাননি, কাটিয়েছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো।
বই পড়ার আরেকটি সুফল হচ্ছে নানান অজানা তথ্য সহ পৃথিবীর অদ্ভুত সব গল্প জানতে পারা। অনেকেই মনে করে কেবল পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে রাখলেই সব জানা হয়ে যায় না, বাইরের জগতটা জানতে হলে তাকে অবশ্যই বই পড়তে হবে।
অনেকের বই পড়া শুরুর গল্পটা বেশ মজার এবং চমৎকার।
মনে আছে সেই সোনালী দিনগুলো? স্কুলের বিরক্তিকর সকালগুলোতে এক পশলা বৃষ্টির কারণে গৃহবন্দি হয়ে বইয়ের নিচে মাসুদ রানা কিংবা তিন গোয়েন্দা নিয়ে সময় কাটানো। শীতের বন্ধে লেপের নিচে শুয়ে শুয়ে বই পড়ার মজা কেবল মাত্র বই পড়ুয়ারাই অনুভব করতে পারবে। শৈশবকালকে চমৎকার এক সময় উপহার দেয়া কেবল বইই পারে!
মস্তিষ্কের উন্নতির অবদান
২০১৫ সাল নাগাদ এক গবেষণায় জানা যায়, একদল গবেষক এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে দেখতে পান বই পড়ার ফলে মস্তিষ্কের বেশ জটিল যেসব নিউরাল নেটওয়ার্ক ও সিগনাল আছে তা অধিক সক্রিয় থাকে। একজন যখন কোন বই পড়ে তখন তা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। এর আগে আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় বই পড়ার ফলে মস্তিষ্কের কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পায়। এই গবেষণায় ২১ জনকে ৯ দিনের জন্য একটি উপন্যাস পড়তে দেয়া হয় তাদের মস্তিষ্কের অবস্থান জানার জন্য। সেই উপন্যাসটির নাম “পম্পেই”।
এই ৯ দিনের বই পড়ার ফলে জানা যায় Somatosensory Cortex নামক অংশ যা শারীরিক সংবেদনশীলতার প্রতি সাড়া দেয় তা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের অন্যান্য উন্নতির জন্য বই পড়ার বেশ ভালো উপকারিতা জড়িয়ে আছে।
চিন্তাশক্তির উন্নতি
বই পড়ার একটি বড় উন্নতির দিক হচ্ছে নিজের চিন্তাশক্তির উন্নতি লাভ করা। একজন মানুষ যখন কোন বই পড়ে তখন সেই বইয়ের গল্পগুলো তার মস্তিষ্কে গভীর চিন্তার সৃষ্টি করে থাকে। সেই বইটি পড়ার সাথে সাথে সে তার চিন্তার তাৎক্ষনিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে যা অন্য কোন কিছু পারে না। একদল গবেষক জানান, বই পড়ার সাথে নিজের আত্মশুদ্ধির একটি গভীর যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায় যা তার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে।
একটি বইয়ের প্রেক্ষাপট, চরিত্র, নানান কাজকর্ম সেই বই পড়ুয়াকে ভাবুক করে তুলে। এতে করে চিন্তাশক্তির যে উপকারিতা তা উপভোগ করতে পারে। কোন একটি উপন্যাসের চরিত্র, প্রেক্ষাপট, দৃশ্য এসব একজনের বিভিন্ন দিক উপলব্ধি করতে সাহায্য করে থাকে। এই চিন্তা করার ব্যাপারটিকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন “Theory of Mind”.
এর সাহায্যে সে সামাজিক বন্ধনে অনেকটাই এগিয়ে থাকতে পারে। আর এর জন্য নিয়মিত বই পড়া জরুরী। বছরে প্রায় ৪০-৫০ টি বই পড়লে তার জানার ঝুড়িতে জমে হাজার হাজার তথ্য যা কেউ বই পড়া ছাড়া অন্য কোন উপায়ে লাভ করতে পারে না।
শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করা
বই পড়ার একটি বিশাল উপকারিতা হচ্ছে বিভিন্ন নতুন নতুন শব্দ নিয়ে জানা। পৃথিবীতে কোটি কোটি অজানা শব্দ আছে যা একেক লেখক একেক বইয়ে ব্যাবহার করে গেছেন। আর যতো বেশি বই পড়া হবে ঠিক ততোই নতুন শব্দএর সাথে পরিচিত হওয়া যাবে।
১৯৬০ সাল নাগাদ কিছু বিজ্ঞানী “The Mathew Effect” নামে এক গবেষণা চালায় যা মূলত বাইবেলের শ্লোককে কেন্দ্র করে করা। এতে দেখা যায় যেসকল পড়ুয়ারা অনেক আগে থেকে বই পড়ে আসছে তাদের শব্দভাণ্ডার অন্যের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী।
এছাড়া বই পড়ার ফলে তাদের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধির পাশাপাশি কথা বলার বাচনভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে, যা বেশ ইতিবাচক বলেই জানা যায়। এই দক্ষতা অর্জনে বই বিশাল ছায়া হিসেবে পাশে থাকে।
মানসিক অবসাদ, চাপ হ্রাস করা
কেউ যখন একটি হাস্যরসাত্মক বই পড়ে তখন তার মানসিক অবসাদ অনেকটাই হ্রাস পেতে সাহায্য করে থাকে। একদল গবেষক বলেন এর জন্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ মিনিট বই পড়া প্রয়োজন সবার। ২০০৯ সালে কয়েকজনকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয় বই পড়তে দিয়ে এবং কয়েকজনকে যোগব্যায়াম, করতে দেয়া হয়।
তখন দেখা যায় যোগব্যায়ামের মতোই উপকার পেয়ে থাকেন কেউ যদি বই পড়ে থাকেন! ব্যাপারটি আশ্চর্যের হলেও সত্যি। বই পড়ার ফলে রক্তচাপ, হ্রদস্পন্দন ইত্যাদি স্বাভাবিক থাকে।
এই গবেষণায় জরিত এক গবেষক বলেন প্রতিদিন ৩০ মিনিট বই পড়ার ফলে একজনের মানসিক চাপ কমাতে বেশ কার্যকরী উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। আর এতে করে দৈনন্দিন কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটবে না।
রাতে পর্যাপ্ত ঘুমে সাহায্য করা
রাতে বই পড়ার ফলে আপনার পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। মায়ো ক্লিনিকের পরামর্শ হিসেবে রাতে যদি কমপক্ষে দুই পাতাও বই পড়ে কেউ তাহলে তার রাতে বেশ ভালো ঘুম হবে।
তবে সেক্ষেত্রে মোবাইলে পিডিএফে বই পড়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, কেননা এই সময় মোবাইলে বই পড়ার ফলে মোবাইলের আলো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আর এতে যে কেউ ব্যাবহার করতে পারে ই-বুক রিডার। আর হ্যা,বিছানা থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করার কথাও কিন্তু মনে রাখতে বলেছেন। আর এতে যখন ঘুম চলে আসবে তখনই বিছানায় যাওয়া উচিত বলে মনে করেন গবেষকরা।
নিজের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করা
বই পড়ার ফলে একজন খুব সহজেই নিজের মনের ভাষা প্রকাশ করতে পারে এবং তা যতোই অর্থবহ হয় ততোই সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়। দেশে-বিদেশের বিখ্যাত যতো লেখক আছেন তারা সবাইই অনেক বই পড়েছেন।
আর এতে করে মগজের ধার আরও ধার হয়েছে। আর তাই নিজের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। এতে করে একজনের কল্পনাশক্তি যেমন বাড়বে তেমনই দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট পরিবর্তন ঘটবে।
খারাপ অভ্যাস দূর করা
বর্তমানে মোবাইল, ফোনের ব্যবহার তুলনামুলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে যেমন গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে তেমনই শারীরিক ভাবেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আর বই পড়ার ফলে এই খারাপ অভ্যাস গুলো অনেকটাই কমে আসে। মোবাইল, ফোনের আসক্তি কমিয়ে একজন যখন বই পড়া শুরু করবে তখন সে পাবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার যা অন্য কিছু তাকে দিতে পারবে না।
এসব কারণ ছাড়াও একজন চমৎকার মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বই পড়ার কোন বিকল্প পন্থা নেই। আর তাই প্রতিদিন সবার উচিত সাধ্যমত বই পড়া। বই পড়া কেবল এসবই দিবে না, আপনার জীবনকে দিবে এক অন্যরকম অনুভূতি যার মূল্য কেবল বই পড়ুয়ারাই বুঝতে পারবে।
Feature Image: pinterest.com Reference : 01. https://www.inc.com/christina-desmarais/why-reading-books-should-be-your-priority-according-to-science.html 02. https://www.healthline.com/health/benefits-of-reading-books