বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ফুটবল যদি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হয় তাহলে ফুটবলের বিশ্বকাপের আমেজ কতটা হতে পারে তা আন্দাজের বাইরে। আকাশচুম্বী নয় আকাশ ছাড়িয়ে যাওয়া বললেও ভুল হবে না।
‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বা ‘বিশ্বের সবচয়ে বড় আসর’ নামে খ্যাত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ। ফুটবলের এই বিশ্বকাপ প্রতি ৪ বছর অন্তর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এবারের আসর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়েছে কাতারে।
যেহেতু পর্দা নেমে গেছে সেহেতু সবাইই জানে যে, ৩৬ বছরের হাহাকার ঘুচিয়ে মেসির আর্জেন্টিনা হয়েছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এবারের আসর কিছুটা নয় বরং অনেক কারণেই অনন্য ছিল। আর সেরকম ৮টি কারণ নিয়েই আজকের আয়োজন।
১. মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বিশ্বকাপ
কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম অনন্যতা কাতার নিজেই। এর আগে কখনোই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে অনুষ্ঠিত হয়নি ফুটবল বিশ্বকাপ। ২০১০ সালে লটারির মাধ্যমে ২০২২ এর বিশ্বকাপ কাতারে হবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যা নিয়ে ছিল বিভিন্ন সমালোচনা। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পেছনে ফিফার কয়েকটি উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত আটকে যায়নি আয়োজন।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম ও এশিয়ার মাটিতে দ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে কাতারে। এর আগে ২০০২ সালে জাপান ও কোরিয়ায় যৌথভাবে আয়োজিত হয়েছিল বিশ্বকাপ আসর। কাতারকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল ফুটবল দেশ বলা হয়ে থাকে। সবাইকে তাক লাগিয়ে ২০১৯ সালের এশিয়ান কাপ জিতে নেয় কাতার। তবে বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছে স্বাগতিক হিসেবেই।
২. বাজেট
কাতার বিশ্বকাপের বাজেট শুনে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে অনায়াসেই। সরাসরি না বলে প্রথমে একটা তুলনা করা যাক যাক। এর আগে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপ আসর ছিল ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের বাজেট তার চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ। ২০১৪ সালের আসরে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কিন্তু এবারের বাজেট প্রায় ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে যা প্রায় ২২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এক রিপোর্ট মোতাবেক এই খরচ পোষাতে কাতারকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার অশোধিত তেল বিক্রয় করতে হবে। যার দ্বারা আবহাওয়া মন্ডলে প্রায় ৯২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে।
৩. নতুন টেকনোলজি
কাতার বিশ্বকাপের মাধ্যমে ফুটবল পরিচিত হচ্ছে এক নতুন টেকনোলজির সাথে। নাম ‘সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি’। এই প্রযুক্তি এই বছরের জুন মাসে সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মূলত বলের মধ্য থাকা একটা সেন্সরের মাধ্যমে বলের পজিশন চিহ্নিত করা হবে। তাছাড়া অফসাইড ধরার জন্য ১২টি আলাদা আলাদা ক্যামেরা মাঠে বসানো থাকবে। যার ফলে অফসাইড আরো নিখুঁতভাবে ধরা সম্ভব হবে। ফিফা পরিচালক জোহানেস হোলজমুলার বলেন,
নতুন প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ম্যাচ অফিসিয়ালদের ভিডিওর মাধ্যমে রিয়েল-টাইম অফসাইড সতর্কতা প্রদান করবে।
অফসাইডের রিপ্লেসমূহ ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন-এর মাধ্যমে দেখানো হবে। তাই অফসাইডের রিপ্লেগুলো দেখতে অনেকটা কার্টুনের মতো মনে হবে।
৪. শীতকালে প্রথম বিশ্বকাপ
প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব দেখেছে ফুটবলের ২১টি আসর। আর এর সবকটিই অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ মে থেকে জুন মাসে। বলা যায় গ্রীষ্মকালে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়া একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সেই ঐতিহ্যর ধারা বজায় থাকেনি ২২তম আসরে অর্থাৎ কাতার বিশ্বকাপে।
প্রথমবারের মতো শীতকালে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল আসর। কারণ কাতার মরুভূমির দেশ। গ্রীষ্মকালে কাতারে তাপমাত্রা থাকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এর ওপরে যা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা ৩২টি দেশের মধ্যে দু-একটি দেশ ছাড়া অনান্য দেশের খেলোয়াড়দের জন্য অতি উচ্চ। তাই ফিফা সিদ্ধান্ত নেয় এবারের বিশ্বকাপ গ্রীষ্মকালে নয় শীতকালে হবে।
৫. চোখধাঁধানো স্টেডিয়াম
যে দেশে ফুটবলের আদর্শ কোনো পরিকাঠামো নেই সেই দেশ বিশ্বকাপ আয়োজন করার সুযোগ পাওয়ার পর বিলিয়ন বিলিয়ন কোটি টাকা খরচ করে দিচ্ছে স্টেডিয়াম সাজানোর জন্য। প্রত্যেক স্টেডিয়ামে থাকছে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। পাঁচটি শহরে তৈরি সজ্জিত হয়েছে ৮টি স্টেডিয়াম। এক নজরে জেনে নেওয়া যাক স্টেডিয়ামগুলোর নাম:
লুসাইল স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৮০ হাজার
আল-বাইত স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৬০ হাজার
আল-জানিয়ুব স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
স্টেডিয়াম ৯৭৪ – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
আল-থুমামা স্টেডিয়াম – দর্শক ধারনক্ষমতা ৪০ হাজার
৬. ৫ জন বদলি খেলোয়াড়
আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথমবারের মতো খেলা চলাকালীন ৫ জন বদলি খেলোয়াড় নামানোর নিয়ম চালু হবে। যদিও ক্লাব ফুটবলে এই নিয়ম চালু হয়েছে অনেক আগেই। এর আগের বিশ্বকাপসমূহে মাত্র ৩ জন খেলোয়াড় বদলি হিসেবে নামানো যেতো। এই নিয়ম চালুর সাথে টিমগুলোর স্কোয়াডের দৈর্ঘ্যও বাড়ছে। আগে ২৩ জন প্লেয়ারের স্কোয়াড ঘোষণা করা যেতো বিশ্বকাপে তবে ২২তম বিশ্বকাপে ঘোষণা করা হয়েছিল ২৬ সদস্যের স্কোয়াড।
৭. ইনজুরি ধাক্কা আসতে চলেছে
প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে খেলোয়াড়দের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে, আন্তর্জাতিক বিরতি থাকে ইনজুরি মুক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। কারণ ক্লাব ফুটবল ইতিমধ্যেই অনেক খেলোয়াড়কে আহত করে বিশ্বকাপ থেকে বাদ দিয়েছিল। যেমন- পোগবা, কান্তে, জোটা, সাদিও মানে এবং আরও অনেকে। যাইহোক না কেন কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত যে, খেলোয়াড়দের ফিটনেসের দিক থেকে এটি একটি অস্বাভাবিক বিশ্বকাপ হবে।
৮. মধ্যপ্রাচ্যে ফুটবলের অগ্রগতির সুযোগ
ফিফার সর্বশেষ র্যাংকিং অনুযায়ী কাতার বর্তমানে ৯৬ নাম্বার র্যাংকে অবস্থান করছে। যা ২০১০ সালের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও অনেক নিচে। বরং ইতিহাসে বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হিসেবে সবচেয়ে নিচের র্যাংকিং-এ থাকার রেকর্ড কাতারের। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ফিফা র্যাংকিং-এ সবচেয়ে আগে ইরান, তাদের র্যাংকিং ৫৪ নাম্বার। এই অবস্থানকে খুব ভালো বলার কোনো সুযোগ নেই। সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের ফুটবল অবস্থা খুব একটা ভালো না। তবে এই অবস্থা যে খুব দ্রুত পাল্টাবে তা জানান দিয়েছে কাতার।
Feature Photo: cgtn.com References: 01. Qatar 2022. 02. FIFA world cup 2022 stadiums Qatar. 03. Qatar world cup is different from others. 04. all you need to know Qatar 2022 world cup. 05. 5 reasons why their world cup was a huge success. 06. One of the best world cups ever.