কেনই বা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ?

568
0

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এমন এক যুদ্ধ যেটাতে অনন্য এক পর্যায়ের দুর্দশা ও মৃত্যুর সাক্ষী এই পৃথিবীকে হতে হয়েছে। এর বিধ্বংসতা এমন ছিল যে এই যুদ্ধে প্রায় ৪ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে তখনকার সময়ে দ্য গ্লোবাল ওয়্যার, দ্য গ্রেট ওয়্যার ইত্যাদি তকমা দেওয়া হয়েছিল। মূলত সেই সময়ে ভাবা হয়েছিল যে এই ধরণের যুদ্ধ আগামীতে সংঘটন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্ত মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তখন এই যুদ্ধকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামকরণ করা হয়। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিশ্বযুদ্ধে কি হয়েছিল বা কে জয় লাভ করেছে তা নিয়েই আলোচনা হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়কেই বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেন হয়েছিল তা কি আপনি জানেন? আজ আমরা বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার কিছু কারণ জানব। এর মাধ্যমে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আসলেই কি এই যুদ্ধের দরকার ছিল? আর যদি দরকার হয়েও থাকে তাহলে কে বা কারা দায়ী? কেনই বা তারা যুদ্ধকে শান্তির মন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল? 

প্রেক্ষাপট 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যাবে ঐ সময়ে অর্থাৎ, ১৯ শতকের শেষে পশ্চিমা দেশগুলো সভ্যতার প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল। মিলিটারি, ফ্যাশন, টেকনোলজি সব ক্ষেত্রেই তারা উদ্ভাবনার ছাপ বসিয়ে দেয়। অন্য দেশকে বা জাতিকে টপকে নিজ দেশ বা জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দৃশ্যমান প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল পশ্চিমা বিশ্ব। 

এছাড়াও, উক্ত সময়ে ইউরোপের দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি হতে দেখা যায়। চুক্তিগুলোর মাধ্যমে এক দেশ অন্য দেশের উপর আক্রমণ হলে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি পায়। এতে করে বিভিন্ন জোট সৃষ্টি হতে দেখা যায়। সহজ করে বলতে গেলে এখনকার সময়ে ন্যাটোভুক্ত কোন দেশ আক্রমণের শিকার হলে অন্য দেশ যেভাবে সেই দেশকে রক্ষা করতে এগোবে ঠিক ওইরকম একটি ব্যবস্থা দেখা যায়। শুধুমাত্র সেই সময় বর্তমানের মতো কোন বৈশ্বিক বাহিনী ছিল না। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের ও পরের ইউরোপের মানচিত্র। Image Source: slideplayer.com

তখনকার সময়ে মূলত দুটি জোট সম্পর্কে আমরা জানতে পাই। একটি হচ্ছে এলাইড জোট যার সদস্য ছিল রাশিয়া, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিরুদ্ধ শক্তি জাপান এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর পক্ষে ছিল।ভূ-রাজনীতি কতই না বিচিত্র! সে যাই হোক, এর অপরদিকে ছিল সেন্ট্রাল জোট। এখানে ছিল অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, জার্মানি এবং অটোমান সম্রাজ্য। 

উল্লেখ্য, জার্মানদের কাছে হারানো আলসেস-লোরেন অঞ্চলকে ফ্রান্স আবার দখল করতে চাচ্ছিল। আবার, জার্মানরা এই অঞ্চলের বিস্তার আরো বৃদ্ধি করতে চাচ্ছিল। অন্যদিকে, গ্রেট ব্রিটেন তাদের নৌ বাহিনীকে আধুনিকায়ন করার ফলে জার্মানদের একটি আগ্রাসী বার্তা দিচ্ছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, এই দুই দেশ ১৯১৪ সালে নিজেদের সেরা প্রমাণ করতে তাদের ব্যাটেলশিপদের প্রদর্শনী করেছিল। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদ।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কয়েকটি বলকান রাষ্ট্র যেমন- রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া স্বাধীন হয়। এতে করে জাতীয়তাবাদের এক বাতাস বইছিল সমগ্র ইউরোপ জুড়ে। সবাই ভাবছিল যে যুদ্ধ করে নিজ দেশ স্বাধীন করলেই সব কাজ শেষ। এতে করে সবাই নিজ জাতিকে উচ্চতর হিসেবে দেখা শুরু করে। এক কথায় ইউরোপের অবস্থা অস্থিতিশীল ছিল তখন।  

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মান ব্যাটেলশিপের শোডাউন। Image Source: wired.com

তাই বলে সরাসরি যুদ্ধ?

এখন বুঝা গেল যে, ইউরোপে তখন পাওয়ার স্ট্রাকচার নিয়ে এক বড় অস্থিতিশীলতা বইছিল। জাতীয়তাবাদের বাতাসে কাঁপছিল ইউরোপের প্রতিটি নগর-রাষ্ট্র। কিন্ত প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এটি তো এত বড় যুদ্ধের একমাত্র কারণ হতে পারে না!প্রশ্নটি যথার্থ। আসলে যুদ্ধ লাগার পেছনে একটি তাৎক্ষণিক কারণ রয়েছে। আবার বলা যেতে পারে এমন এক ঘটনার জন্যই যুদ্ধ অপেক্ষা করছিল।

সেটি হলো অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ডিউক আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফের্ডিনান্ড ও তার স্ত্রী্র হত্যাকান্ড যেটি সংগঠিত হয় ২৮ শে জুন ১৯১৪ সালে। উল্লেখ্য ঐ সময়ে ইউরোপে রাশিয়ার পর সবচেয়ে বৃহত্তম দেশ ছিল অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য। যা বর্তমান অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বসনিয়া, ক্রোয়াশিয়া, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ নিয়ে গঠিত ছিল। উক্ত হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ একজন ব্যক্তি যে কিনা সার্বিয়া কেন্দ্রিক ব্ল্যাক হ্যান্ড গ্রুপের সদস্য ছিল। 

মূলত এর জের ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই হত্যাকান্ডের পর অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ানরা সরাসরি সার্বিয়াকে দায়ী করে। কেননা ব্ল্যাক হ্যান্ড সার্বিয়া থেকেই মূলত পরিচালিত হচ্ছিল। তারা এই হত্যার বিচার করতে সার্বিয়ার মূল ভুখন্ডে অস্ট্রিয়ার অফিসিয়ালদেরকে পাঠাতে চায় এবং সেখানেই তাদের দ্বারাই সেটির শাস্তি সম্পন্ন করতে চায়। সার্বিয়াকে উক্ত শর্ত দিয়ে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল যা সার্বিয়া প্রত্যাখ্যান করে। সার্বিয়ার যুক্তি ছিল যে এটি তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরুপ।

সার্বিয়াকে কোন শক্ত প্রমাণ ছাড়া দায়ী করেই অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়রা তাদের উপর হামলা শুরু করে। এই হামলায় জার্মানী সরাসরি সমর্থন জানায়। এটি বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেকে বলে যে, অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়রা বুঝতে পারেনি যে রাশিয়া সার্বিয়াকে সমর্থন করে। এইভাবে জার্মানি ,রাশিয়া সমর্থনের সাথে সাথে বলকান অঞ্চলের বাইরে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পরে। আস্তে আস্তে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকাসহ পুরো বিশ্ব যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। এইভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফের্ডিনান্ড ও তার স্ত্রী্। Image Source: Rare Historical Photos

দায়ী কে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকেই অস্ট্রিয়াকে, কেউ রাশিয়াকে আবার কেউবা জার্মানিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে উক্ত সময়ে অনেক চুক্তি, আধুনিকায়ন এবং নিজেদের কলোনিকে বিস্তার করার জন্য ইউরোপ অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল।

অর্থাৎ, সরাসরি কোন হুমকি না দিলেও পরোক্ষ হুমকি দেওয়া হচ্ছিল যা আজকাল আমরা রাশিয়া-আমেরিকা-চীনের মধ্যে অহরহ দেখতে পাই। এতে করে দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। কোন খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হলেই তাতে বিপরীত পক্ষকে দায়ী করা হচ্ছিল যেটা আমরা অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান ডিউকের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করলে বুঝতে পারি। 

আবার গ্রেট ব্রিটেনের নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের সাথে সাথে জার্মানদের শ্লিফেন প্ল্যানকেও অনেকে দায়ী করে। উক্ত প্ল্যানের মাধ্যমে জার্মানরা একসাথে রাশিয়া ,ফ্রান্সকে হারাতে চেয়েছিল যাতে করে জার্মানদের আক্রমণাত্নকতা প্রকাশ পায়। গেরহার্ড রিটার এই প্ল্যানকে খুবই বিপদজনক বলে দাবি করেন। মূলত এর দ্বারাই ইউরোপের ভবিষ্যৎ মনোভাবকে ইঙ্গিত করা যায়।

কৌশলগত দিক থেকে বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ বলেন যে , ‘এই যুদ্ধটি একটি মিসক্যালকুলেশন ছাড়া কিছুই নয়’ (A tragedy of miscalculation)। তিনি বলেন যে, যুদ্ধে একসাথে সম্পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ বিজয় এনে দিবে এটি একটি ভুল ধারণা।

Image Source : Chicago Tribune

আরেকটি যুক্তিতে দেখা যায় যে, তখনকার পুঁজিবাদী জার্মান ব্যবসায়ীরা গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চেয়েছিল এই যুক্তিটি মার্ক্সবাদীরা বিশ্বাস করে। অনেক দাবীই রয়েছে কারণ হিসেবে। কিন্ত পরিশেষে এটিই বলা যায় যে, উক্ত সময়ে যুদ্ধকে শান্তি অর্জনের একটি পন্থা হিসেবে দেখা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ বলুন বা সাম্রাজ্যবাদ। 

১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত এই যুদ্ধে প্রতিটি বিষয়ই যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধের জন্য মূল কারণ চিহ্নিত হয়নি। তাহলে কি এই ভুল কৌশলের দাম সেই কোটি মানুষের জীবন থেকে বড়? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।  

 

Feature Image: Paul Popper/Popperfoto/Getty Images
তথ্যসূত্রসমূহঃ 
01. How did the first world war start.
02. World war – i.
03. 5 things you need to know about the first world war.
04. World war I history, summary, causes, combatants, casualties.