বৃদ্ধ শিশু থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে প্রিয় একটি খাবার হলো চকলেট। কমবেশি সবাইই চকলেট পছন্দ করে। পৃথিবীর সকল দেশেই চকলেট একটি জনপ্রিয় খাবার। আর এই জনপ্রিয়তা এবং চাহিদাকে কাজে লাগানোর জন্য বিশ্বের প্রায় সকল দেশই বাণিজ্যিকভাবে চকলেট উৎপাদন করে থাকে।
তবে এর মধ্যে অত্যন্ত সুস্বাদু, বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং এবং সফলভাবে বিতরণের মাধমে বেলজিয়াম চলকেট বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে বেলজিয়াম তাদের এই অবস্থান ধরে রেখেছে। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে বেলজিয়ামের চকলেট কেন এত বিখ্যাত? আর এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের আয়োজন।
তাই, যারা বেলজিয়ামের চকলেট কেন বিখ্যাত এই বিষয়ে জানতে ইচ্ছুক তাদের জন্য আজকের আলোচনা বেশ ফলপ্রসূ হবে। এছাড়াও, এই আর্টিকেলের মাধ্যমে বেলজিয়াম চকলেটের দাম, বেলজিয়াম চকলেটের ইতিহাস, বেলজিয়াম চকলেটের প্রকারভেদ আরও ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
বেলজিয়াম চকলেটের ইতিহাস
বেলজিয়াম চকলেটের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং সেই সাথে অনেক পুরানোও বটে। ইতিহাস অনুযায়ী বেলজিয়াম চকলেটের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় ১৬৩৫ সালের দিকে। অতপর ইমানুয়েল সোয়ারেস ডি রিনেরো নামক এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম ১৭ শতকের সময়ে ব্রাবান্ট চকলেট তৈরির উপর লাইসেন্স জারি করেছিলেন।
সেই সময়ে চকলেট তৈরির পেশাকে কোন পেশার অন্তভুর্ক্তই করা হতো না বরং এই পেশাটি ছিল সেই সময়ে বণিকদের জন্য একটি সাইডলাইন। ১৮ শতকের দিকে বেলজিয়ামের চকলেট ইউরোপব্যাপী সাড়া জাগানো শুরু করে এবং তারপরে থেকে আস্তে আস্তে ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে বেলজিয়াম চকলেটের উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠা শুরু করে।
১৯ শতকের শুরুর দিকে থেকে বেলজিয়াম চকলেট বাণিজ্যিকভাবে শিল্পায়ন শুরু করা হয় এবং চকলেটগুলার দাম প্রথমের দিকে অনেক বেশি থাকলেও আস্তে আস্তে তা কমতে শুরু করে এবং এটি আরো বেশি পরিমানে সহজলভ্য হওয়া শুরু করে।
১৯১২ সালটি ছিল বেলজিয়াম চকলেটের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেই বছরে জিন নিউহাউস নামক ব্যক্তি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে প্রথম ‘প্রালাইন’ নামক এক ধরনের চকলেট আবিষ্কার করে যেটি সেই সময়ে অনেক সাড়া ফেলে দেয়।
তার এই আবিষ্কারের জন্য তাকে প্রায়শই বেলজিয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত চকোলেটিয়ার হিসেবে ধরা হয় এবং তার তিন বছর পরে তার স্ত্রী ‘ব্যালোটিন’ যা একটি বেলজিয়ামের সাধারন বক্স আবিষ্কার করেন।
বেলজিয়াম চকলেটের প্রকারভেদ
বেলজিয়াম চকলেট সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। নিম্নে বেলজিয়াম চকলেটের প্রকারভেদ উল্লেখ করা হলো:
চকলেট
বেলজিয়ামের প্রালাইন বলতে যেগুলাকে বুঝানো হয় তার সবগুলাই চকলেটের অন্তভুর্ক্ত। সাধারণত এগুলো প্রস্তুত করা হয় মাখন ক্রিম, বাদাম, বাদামের পেস্ট এবং ফলের ক্রিম দিয়ে। এই চকলেটগুলো সারা পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত এবং জনপ্রিয়।
ট্রাফলস
ট্রাফলস সাধারনত পাউডারি এক ধরনের চকলেট যেগুলো তৈরি করা হয় কঠিন কোকো পাউডার এবং গানাচে এর মিশ্রণ করে। এগুলা প্রালাইনের থেকে কিছুটা বেশি ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। এগুলা বেশি ক্রিমযুক্ত হয়ে থাকে।
গিয়ান্দুজা
গিয়ান্দুজা চকলেট তৈরি করা হয় খাঁটি বাদাম এবং বাদামের পেস্ট থেকে। এগুলার প্যাকিজিং হয়ে থাকে অনেক সুন্দর। এগুলা ছোট আয়তক্ষেত্রের ব্লক আকৃতি বক্সে সোনার কাগজ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় বাজারজাত করা হয়ে থাকে।
বেলজিয়াম চকলেটের দাম
চকলেটের সাইজ এবং চকলেটের ধরনের উপর ভিত্তি করে বেলজিয়াম চকলেটের দাম বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্র্যান্ড এবং অনেক শপ বেলজিয়ামের চকলেট বিক্রি করে থাকে।
নাম | ওজন | দাম (টাকায়) |
বেলজিয়াম মিল্ক চকলেট | ১০০ গ্রাম | ৪৫০ |
বেলজিয়াম ডার্ক কোকো চকলেট | ১০০ গ্রাম | ৩৫০ |
আমুল বেলজিয়াম চকলেট | ১২৫ গ্রাম | ৩৫০ |
হার্টস বেলজিয়াম চকলেট | ২০০ গ্রাম | ৯২০ |
লুনিয়ান বেলজিয়াম চকলেট | ২৫০ গ্রাম | ১৫৫০ |
বেলজিয়াম চকলেটের ব্র্যান্ড
বিশ্বব্যাপী বেলজিয়াম চকলেটগুলার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেলজিয়ামের চকলেটগুলার ব্র্যান্ড সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরুতে অবশ্য শুধু কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেলজিয়াম চকলেট বানিয়ে বিক্রি করতো।
কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যাটি শতাধিকে পরিণত হয়েছে। এমনই কয়েকটি ব্র্যান্ডের নাম নিচে উল্লেখ করা হলো যেগুলা সারা বিশ্ব ব্যাপী বেলজিয়াম চকলেট বিক্রির জন্য অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং অনেক বেশি পরিচিত।
লিওনাইডাস
লিওনাইডাস হলো একটি ক্লাসিক বেলজিয়াম চকলেট ব্র্যান্ড যারা ৯০০ বছরেরও বেশি সময় ধরেও তাদের ঐতিহ্য ধারন করে আসছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই তাদের অফলাইন এবং অনলাইন শপ রয়েছে।
লিওনাইডাস তাদের নিজেস্ব উপাদান দিয়েই ১০০ এরও বেশি ধরণের চকলেট বানিয়ে থাকে।
গদিভা
বিশ্ব বিখ্যাত একটি চকলেট ব্র্যান্ড হলো গদিভা। ১৯২৬ সালে জোসেফ ড্র্যাপস এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বর্তমানে এটি একটি তুর্কি কোম্পানি ইলফিজ হোল্ডিং এর মালিকানায় চলছে।
নিউহাউস
নিউহাউস একটি সুদীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ব্র্যান্ড। যেটি ১৮৫৭ সালে জন নিউহাউস প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু থেকেই নিউহাউস ব্র্যান্ড অনেক সুস্বাদু প্রালাইন চকলেট তৈরি করে আসছে।
নিউহাউস ব্র্যান্ডের সকল চকলেট বেলজিয়ামের মধ্যেই তৈরি করা এবং চকলেট তৈরির জন্য ব্যবহৃত কোকোর শতকরা ২৫% কোকোই নিজেদের ফার্ম থেকে নিয়ে থাকে।
ব্রুয়েরে
ব্রুয়েরে ব্র্যান্ডের গুরমেট চকলেট ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সারাবিশ্ব ব্যাপী অনেক বেশি জনপ্রিয়।
ব্রুয়েরে সাধারনত ট্রাফলস, হ্যাজেলনাট প্রালাইন, গানচে ক্রিম এবং গিয়ান্দুজা তৈরি করে থাকে।
কোট ডি’অর
ক্রিমযুক্ত স্বাদ, মসৃণ টেক্সচার এবং প্রাকেজিং এর জন্য জন্য কোট ডি’আর সারা বিশ্বজুড়ে পরিচিত। কোট ডি’আর ১৮৮৩ সালে প্রথম চালু করা হয়।
এই চকলেটির বিশেষত্ব হলো এটি আফ্রিকান এবং দক্ষিণ আমেরিকান কোকো বিনের মিশ্রন থেকে তৈরি করা হয় যা চকলেটিকে একটি স্বতন্ত্র স্বাদ দেয়।
কর্নে পোর্ট রয়্যাল
মরিস কর্ণে ১৯৩২ সালে কর্ণে পোর্ট রয়্যাল নামক চকলেট ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। কর্নে পোর্ট রয়্যাল চকলেট ব্র্যান্ডের চকোলেটিয়াররা তাদের চকলেটে তাজা ক্রিম ব্যবহার করে।
সেই সাথে চকলেট কে আবরনকে পাতলা করার জন্য কোন প্রকারের ফিলার ব্যবহার করেন না।
বেলজিয়াম চকলেট কেন বিখ্যাত
কোন পণ্যকে বিশ্ব বিখ্যাত হতে হলে অনেক কারণ থাকতে হয় সেই পণ্যের অনেক ভালো দিক থাকতে হয়। বেলজিয়ামের চকলেট হলো একটি বিশ্ববিখ্যাত পণ্য। নিম্নে বেলজিয়াল চকলেটের বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:
- অন্ত্যন্ত সুস্বাদু
- দাম তুলনামুলক ভাবে কম
- সুন্দর প্যাকেজিং
- স্বাস্থঝুঁকি হীন
এছাড়াও, আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো বেলজিয়ামের চকলেটকে বিশ্বের জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বেলজিয়াম চকলেটের রহস্য
অনেক বিশেষজ্ঞই বলে থাকেন যে, বেলজিয়ামের চকলেটের আন্তজার্তিক খ্যাতি লাভের কারন হলো ভালো মানের কোকো মাখনের দ্বারা সুক্ষ্মভাবে তৈরি সেই জন্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০০৩ সালে চকলেটে কোকো মাখন ব্যবহারের উপরে একটি আইন প্রনয়ন করে। সেখানে বলা হয়ে থাকে চকলেটে কোকো মাখন ব্যতীত অন্য উদ্ভিজ্জ চর্বি সর্বোচ্চ ৫% ব্যবহার করা যাবে। বেলজিয়ামের প্রায় সকল চকলেটের নির্মাতাগণ শত ভাগ কোকো মাখন ব্যবহার করে চকলেট বানিয়ে থাকে।
বেলজিয়ামের চকলেটগুলো অনেক সুস্বাদু এবং মজাদার সেই সাথে চকলেটগুলাতে খুব বেশি পরিমাণে প্রিজারভেটিভ থাকে না। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং এবং সফলভাবে চকলেটের বিতরণের মাধ্যমে বেলজিয়াম চকলেট উৎপাদনকে সম্পূর্ণ নতুন একটি রুপ দিয়ে দিয়েছে। চোখধাঁধানো সুন্দর প্যাকেজিং এবং বিভিন্ন প্রকারের স্বাদের জন্য এই চকলেটগুলো আন্তজার্তিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
Feature Image: belgianchocolate.eu References: 01. The History of Belgian Chocolate. 02. Why Belgium has Best Chocolate Factories World. 03. Why Belgian Chocolate is So Good. 04. What Makes Belgian Chocolate so Good. 05. What Makes Belgiums Chocolate So Popular. 06. The History of Belgian Chocolate.