বিশ্বের বড় বড় টেক জায়ান্ট সবসময় আলোচনায় থাকে তাদের নিত্যনতুন কাজের জন্য, নতুন প্রযুক্তির জন্য, নতুন পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় সাহায্য করার জন্য। কিন্তু বিগত ৩ বছর ধরে পৃথিবী বেশ থমকে গেছে মহামারী কোভিড-১৯ এর আচানক আক্রমণে।
২০২০ এর শুরুর দিক থেকে যখন সমস্ত বিশ্ব গৃহবন্দী হতে শুরু হল, সামাজিক-আর্থিক-পারিবারিক-বৈশ্বিক সব ক্ষেত্রে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। হোম অফিস, হাইব্রিড বা রিমোট অফিস, কর্মী ছাটাই, বেতন অনেক শতাংশে কমিয়ে দেয়া সহ অনেক পরিবর্তন এসেছে। ফোর্বসের মতে বিশ্বের টেক জায়ান্টগুলো বিগত কয়েক মাসে ১৫০,০০০ জনের বেশি কর্মী ছাটাই করেছে।
মুদ্রাস্ফীতি এর পেছনের মূল কারণ বলা হলেও এর পেছনেও আছে অন্য কারণ। সূত্র মতে মাইক্রোসফট তার ১০,০০০ এর বেশি কর্মী ছাটাই করেছে একদিকে, অন্য দিকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষনা দিয়েছে। কিসে বিনিয়োগ করবে জানেন? ওপেন এআইতে।
চ্যাট জিপিটির নির্মাতা এই ওপেন এ আই কে এখন চেনেন না, এমন মানুষ হয়তো হাতে গোনা। অন্যদিকে গুগলও ১২০০০ এর বেশি কর্মী ছাটাই করবে বলে শোনা যাচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে এর পেছনেও আছে এই এ আই। গুগল নাকী নিজের মত করেই তৈরি করছে এ আই। কিন্তু এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি হাজার হাজার কর্মীর পেছনে আছে? রোবট কী দখল করে নিচ্ছে মানবশক্তি?
এছাড়াও করোনার কারনে, বিশ্বের রাজনৈতিক জটিলতাসহ অর্থনৈতিক মন্দা, যোগ্য প্রার্থীর অভাব, কিংবা অভিজ্ঞতার অভাব ইত্যাদি নানা কারনে চলছে এই কর্মী ছাটাই।
কেন চলছে কর্মী ছাটাই?
কোভিড চলাকালীন সময়ে, আমাদের সবাইকেই হোম অফিস বেছে নিতে হয়েছিল। অনেকে যেমন এই সময়ে কাজ হারিয়েছে, উচ্চ বেতনে কাজ ও পেয়েছেন অনেকেই। টেক কোম্পানি সহ নানা কোম্পানিতে এই নিয়োগ দেয়ার পেছনে কারন ছিল, ২৪ ঘন্টা গৃহবন্দী মানুষ কে সহায়তা করা। যেহেতু আমরা পুনরায় স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসছি, তাই ২৪ ঘন্টা সাপোর্টের জন্য অতিরিক্ত মানুষের প্রয়োজন আর পড়ছে না অনেকের।
যেমন, প্যান্ডেমিক চলাকালীন, অনলাইন শপিং ছাড়া কোন দ্বিতীয় উপায় ছিল না। অনলাইন অর্ডার নেয়া থেকে প্যাকেজিং থেকে ডেলিভার দিতে, পুরো প্রসেস সামাল দিতে একাধিক কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
যেহেতু, আমরা আবার পূর্বের স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরতে শুরু করছি, তাই এই সব প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাটাই। আমাজন থেকে শুরু করে দারাজ, সবখানেই চলছে এখন ছাটাই আর বাছাই। এর পরে আসে রাজনৈতিক জটিলতা আর অর্থনৈতিক মন্দা। করোনার সময়ে যেহেতু বেশ বড় একটা পরিবর্তন এসেছে, তাই প্রতিটা পদক্ষেপ ভেবে চিনতে ফেলতে হবে।
অনেকে বলছেন, যাদের অভিজ্ঞতা কম, তাদের যেমন দ্রুত নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেরকম ছাটাই চলছে। ব্যাপার আসলে তা নয়। দেখা গেছে এক দশক বা এক যুগ ধরে কাজ করা কর্মীদের ও ছাটাই করে দেয়া হচ্ছে। কারন তাদের অবসরের বয়স হয়েছে বা আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে যে জ্ঞান কম তা নয়।
অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদী। যেটা এক নজরে দেখলে মনে হবে এ আর এমন কী? কিন্তু একটু ভেবে, ট্যাক্টফুলী চিন্তা করুন। একাধিক কর্মীকে উচ্চ বেতন দিলে সামগ্রিক ভাবে টেক জায়ান্টগুলোর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হতে পারে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত যত কর্মী ছাটাই, বেতন কমানো, সুযোগ সুবিধা কমানোর মত ঘটনা ঘটেছে এর একটা বড় অংশ হল এইচ আর বা হায়ারিং রিপ্রেজেন্টেটিভ। ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, এর কারনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কর্মীর অনুপাতে দরকার এইচআর এবং কর্মীর সংখ্যা কমে গেলে স্বভাবতই ম্যানেজমেন্ট এর জন্য লোক সংখ্যাও কম লাগবে। অন্যদিকে ধীরে ধীরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে এই মানব সম্পদের।
অন্যদিকে, এই কর্মী ছাটাই এর পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো বিনিয়োগকারীদের চাপ। অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২২-২০২৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দা আসবে। প্রফিট আসবে কম, লস হতে পারে। এলফাবেট, গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি এবং মেটা তাদের বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু চাপ পাচ্ছিলেন।
শেয়ারহোল্ডারদের মতে, তারা এমন কর্মী ছাটাই করতে বলেছিল, যাদের পারফরমেন্স বেশ খারাপ, খরচ কমাতে বলেছেন। ফলশ্রুতিতে মেটা থেকে প্রায় ১১০০০, এলফাবেট ১০০০০ এর বেশি কর্মী কয়েকদিনের মধ্যে ছাটাই করেছেন। আবার অযোগ্য কর্মীদের জন্য অবশ্যই প্রতিষ্ঠানে একটা চাপ পড়তেই পারে। সে কারনে কিছু কর্মী ছাটাই করাও অবশ্য বাহুল্য নয়। প্রয়োজনীয় ট্রেইনিং বা স্কিলের অভাবে অনেক কর্মী বেঘরে চাকরী হারিয়ে ফেলে।
এদিকে রাউটার্স এর মতে টুইটারের নাকি ঋণ আছে ১৩ মিলিয়ন ডলারের বেশ, এছাড়া এই যে মালিকানা বদলের চক্করে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অতিরিক্ত কাজের চাপ আর নিয়মের বেড়াজালে পড়ে, বেশ কিছু কর্মী টুইটার থেকে পদত্যাগ করেছে, সাথে কর্মী ছাটাই তো আছেই। অফিস থেকে ফিরে অনেকেই দেখছেন কাল থেকে আর অফিসে আসা লাগবে না।
অন্যদিকে দেখা গেছে, হোম অফিস বা হাইব্রিড অফিসের কারনে অনেকের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে স্বেচ্ছায় অনেকে চাকরী ছেড়ে দিয়েছিল। অনেকে আবার ফ্রিল্যান্সের দিকেও ঝুঁকছে।
অনেক কারনের মধ্যে বেশ দুঃখজনক একটা কারন হল, প্রতিষ্ঠানের মানসিকতা। অনেক প্রতিষ্ঠানের ধারনা, কর্মী ছাটাই করলেই লাভ বেড়ে যাবে, বেতন দিতে না হলেও রেভিনিউ আসবে।
এছাড়াও অধিকাংশ কোম্পানীগুলোর নিজের আর একটা বড় ভুল হল, একটা পর্যায়ে গিয়ে ওরা নিজেরা নতুন কিছু তৈরি করে না। অনেকসময় মানোয়ন্নের ক্ষেত্রেও মন দেয় না। যার ফলে নতুন গ্রাহক তৈরি হয় না, যার কারনে তৈরি হয় না নতুন করে লাভ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মূলধন ও তুলতে অক্ষম হয়ে পড়ে। যার ফলে চলে কর্মী ছাটাই।
আজ আপনার চাকরী আছে, কাল নাও থাকতে পারে। আবার আজকে একদিকে যেমন ছাটাই এর মেইল পাচ্ছেন, এরপরেই নতুন চাকরীর মেইল পেতে পারেন। তবে এই যে অর্থনৈতিক মন্দা যেমন দীর্ঘমেয়াদী হবে না বলে আশা করা যায়।
নিজের স্কিল বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া, কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া, সচেতন হওয়া, ব্যাক আপ প্লান রাখা দরকার সবার জন্যই। এ আই কখনই মানুষকে রিপ্লেস করবে না কিংবা আধুনিক প্রযুক্তি পুরোপুরি গ্রাস করে নেবে না মানুষের স্থান। সেই প্রযুক্তিকে চালাবার জন্য প্রয়োজন যোগ্য মানুষের। যতই ছাটাই বা বাছাই চলুক না কেন, নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে নিজেকে আপডেটেড রাখার চেষ্টা করুন।
Feature Image: pixabay.com Sources: 01. why-are-tech-companies-laying-off-so-many-workers. 02. why-are-tech-companies-laying-off-staff-in-the-thousands. 03. explained-why-tech-giants-are-laying-off-staff-globally. 04. the-real-reasons-for-big-tech-layoffs-at-google-microsoft-meta-and-amazon. 05. why-tech-companies-laying-off-employees. 06. tech-company-layoffs-in-2022.