আজকাল বিশ্বব্যাপী মানুষের উন্নত দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে শরীরে অসুখের মাত্রাও। আশেপাশে একটু তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যেসকল অসুখগুলো সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ হলো শরীরের রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছানোর একটি পর্যায়। এটিকে আবার অনেকে হাইপারটেনশন হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকে।
একটি জরিপ অনুসারে, পৃথিবীতে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই সমস্যার সাথে জড়িত। সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষেধক, ব্যায়াম, মেডিটেশন, চিকিৎসা ইত্যাদি এই রোগকে প্রতিহত করতে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এর পাশাপাশি পরিবর্তিত জীবনধারা, খাদ্যাভাস আমাদের এই রোগের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
দৈনন্দিন জীবনে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিসম্পন্ন যথোপযুক্ত ডায়েট এই রোগ হতে দূরে থাকতে যেমন সাহায্য করবে তেমনই যারা এই রোগে ইতিমধ্যে ভুগছেন তাদেরও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে বেশ। তাহলে আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক সেসকল খাদ্যাবলী ও তাদের গুণাবলী সম্পর্কে:
সাইট্রাস জাতীয় ফল:
নানান ধরনের ভিটামিন সি জাতীয় কিংবা সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন- লেবু, কমলা ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ক্ষমতা। এই ধরনের ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেলস রয়েছে যা আমাদের হার্টকে সুস্থ রাখতে অত্যন্ত সহায়ক।
ডার্ক চকলেট:
কোকো নামক যে উপাদানটি ডার্ক চকলেটে বিদ্যমান তা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ফ্ল্যাভোনয়েডস এর গুরুত্বপূর্ণ বাহক। ফ্ল্যাভোনয়েডস উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ সহায়ক। জরিপ অনুসারে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ডার্ক চকলেট সময় অনুসারে ডায়েটে যোগ করা বেশ প্রয়োজনীয়। এছাড়া, এটি খেতেও সুস্বাদু।
তরমুজ:
গরমকালে তরমুজ খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তরমুজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড। এই অ্যাসিডটির নাম সিট্রুলিন। এই সিট্রুলিনকে শরীর আরজিনিনে পরিণত করে যা শরীর হতে অপ্রয়োজনীয় নাইট্রিক এসিড নিষ্কাশনে সাহায্য করে। এর ফলে শরীরে রক্ত সরবরাহ সহজতর হয়।
একটি জরিপে দেখা গিয়েছে, যেসকল মানুষ স্থুলতা কিংবা উচ্চ রক্তচাপের শিকার তারা নিয়মিত ছয় গ্রাম করে তরমুজ গ্রহণ করার ফলে মাত্র ছয় সপ্তাহের মাঝে তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে।
মানুষ তরমুজ নানানভাবে গ্রহণ করতে পারে। জুস, ফ্রুট সালাদ, স্মুথি এবং আরও অনেক উপায়ে এই ফল গ্রহণ করা শরীরের জন্য বেশ উপাদেয় বলে বিবেচিত।
মিষ্টি কুমড়ার বীজ:
দেখতে ছোট হলেও মিষ্টিকুমড়ার বীজে রয়েছে পুষ্টির ভাণ্ডার। এতে রয়েছে পোইট্রিক অক্সাইড দ্য ম্যাগনেসিয়াম, অ্যামিনো অ্যাসিড পটাসিয়াম যা নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদনে সাহায্য করে। আর এই নাইট্রিক অ্যাসিড সাহায্য করে রক্তনালীকে সহজত ও সুষ্ঠুভাবে রক্ত চলাচলে। এছাড়া, মিষ্টিকুমড়োর বীজের তেল উচ্চ রক্তচাপের জন্য একটি প্রাকৃতিক শক্তিশালী প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে।
বেরি:
বিভিন্ন বেরি জাতীয় ফল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট নাইট্রিক অক্সাইডের জন্ম দেয়, যা রক্তনালীকে রক্তচাপ প্রবাহে বাধা প্রদানকারী উপাদান সামগ্রীর সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটায়। এছাড়া, অ্যান্থোসায়ানিনগুলি রক্তে নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বাড়াতে এবং রক্তনালী-নিয়ন্ত্রিত অণুগুলির উত্পাদন কমাতে সহায়ক, যা রক্তচাপের মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। রাস্পবেরি, চকবেরি, ক্লাউডবেরি এবং স্ট্রবেরি হলো এমন কিছু বেরি যা রক্তচাপ-হ্রাসকারী প্রভাবে সাহায্য করে।
পেস্তা বাদাম:
পেস্তা বাদাম অত্যন্ত উপাদেয় ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাবার, এটি উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ সহায়ক। ২১টি সমীক্ষার পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে দেখা যায়, বাজারে প্রচলিত সকল ধরনের বাদাম অপেক্ষা পেস্তা বাদামই সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার (SBP) ও ডায়াস্টোলিক (DBP) কমাতে অধিক সহায়ক।
গাজর:
গাজরে রয়েছে উচ্চমাত্রায় ফেনোলিক যৌগ, যেমন- ক্লোরোজেনিক, পি-কৌমারিক এবং ক্যাফেইক অ্যাসিড ইত্যাদি যা রক্তনালীকে সহজ সাবলীলভাবে রক্ত প্রবাহে সাহায্য করে। একটি রিসার্চ পেপারে একদল গবেষক জানিয়েছেন, ৪০ হতে ৫৯ বয়স্ক ২১৯৫ জন মানুষ নিয়মিত কাঁচা গাজর খাদ্য হিসেবে গ্রহণের ফলে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছে। গাজর কাঁচা কিংবা রান্না করে উভয়ভাবেই খাওয়া যায়। তবে গবেষকরা এটিকে কাঁচা খাওয়ার উপদেশ প্রদান করেন।
টমেটো ও টমেটো জাতীয় উপাদান:
টমেটো ও টমেটো দ্বারা তৈরি নানান উপাদান ও খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ক্যারোটিনয়েড পিগমেন্ট লাইকোপেনে সমৃদ্ধ।
লাইকোপেন উল্লেখযোগ্যভাবে হার্টের সুস্থতায় অবদান রেখে চলেছে। যার ফলে এই উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে টমেটো ও টমেটো দ্বারা তৈরি দ্রব্যাদি হার্টের নানান রোগে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ব্রকলি:
ফুলকপির মতো দেখতে সবুজ রঙের সবজিটি খেতে বেশ সুস্বাদু না হলেও হার্টের নানান রোগ বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ বড়সড় ভূমিকা পালন করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা রক্তচাপের পাশাপাশি ওজন কমাতেও বেশ সহায়ক। একটি গবেষণায় ১,৮৭, ৪৫৩ জন লোকের তথ্য অনুসন্ধান করে জানা গেছে যারা এক সপ্তাহে ৪ কিংবা তার চেয়ে অধিকবার ব্রকলি গ্রহণ করে তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম।
বীট:
বীট ও বীট গাছের সবুজ শাক অবিশ্বাস্য রকমের উপাদেয়। এসকল সবজি গ্রহণের ফলে রক্তচাপ একটি স্বাভাবিক মাত্রায় থাকবে। এসকল সবজিতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় নাইট্রেটস। তবে, নানান গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, বীটের বীটজাতীয় সবজি গ্রহণের ফলে রক্তে ও রক্তচাপে যে প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা ক্ষণস্থায়ী।
পালংশাক:
বীট-এর মতো পালংশাকেও রয়েছে উচ্চ মাত্রায় নাইট্রেট, এছাড়া এতে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্টস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম, যা রক্তচাপকে স্বাভাবিক মাত্রায় ধরে রাখতে বেশ সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৭ জন লোকের মধ্যে যারা ১৬.৯ আউন্স করে পালংশাকের স্যুপ ৭ দিন নিয়মিত গ্রহণ করেছে তাদের এসডিপি ও ডিবিপি এর মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম ছিল যারা স্যুপ গ্রহণ করেনি তাদের থেকে।
ওটস ও চিয়া বীজ:
দুটি খাবারই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও জাদুকরী ভূমিকা রাখে। ওটসের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাইজন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া, চিয়া বীজ এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফাইবার। এক গবেষণায় দেখা যায়, রক্তচাপ সমস্যাজনিত ২৬ জন লোকের মাঝে যারা ৩৫ গ্রাম করে চিয়া বীজ গ্রহণ করেছে তাদের রক্তচাপের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
দিনশেষে, সকলের মাথায় রাখা উচিত দৈনন্দিন জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট রক্তচাপের মাত্রা ও সেই সাথে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ কেবলমাত্র ওষুধের ওপর নির্ভর করে থাকে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যে।
তাই যারা ইতিমধ্যে রোগে ভুগছেন তাদেরও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এসকল খাদ্য সহায়তা করবে এবং সেই সাথে ধীরে ধীরে ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনবে।
Feature Image: prevention.com References: 01. Foods for High Blood Pressure. 02. 18 Foods for High Blood Pressure.