কফি খেতে কে না ভালোবাসে? কিছু মানুষের কফির প্রতি এত বেশি আসক্তি যে কফি না খেলে সারাদিনের কাজকর্ম স্থবির হয়ে যায়। কফির জনপ্রিয়তা নিয়ে কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই। কফি হরেক রকমের হয়। তবে কফি নিয়ে আজকে একটু ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করব। আজকে আমি আপনাদের পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি কোপি লুয়াক সম্পর্কে লিখবো। ইন্দোনেশিয়ান কফি ‘কোপি লুয়াক’ সম্পর্কে জানবেন অনেক চমকপ্রদ তথ্য।
কেন এমন অদ্ভুত নাম?
কোপি লুয়াক! নামটি শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে তাইনা? এই নামের উৎপত্তি ইন্দোনেশিয়া থেকে। কোপি মূলত ইন্দোনেশিয়ান শব্দ। ইন্দোনেশিয়ানরা কফিকে কোপি বলে থাকে। পাম সিবেট বা পাম বিড়াল ঐ দেশে লুয়াক নামে পরিচিত। কোপি লুয়াকের নামকরণের পিছে এটাই প্রধান কারন। কোপি লুয়াককে ‘ক্যাট পুপ কফি’ও বলা হয়।
এটি এক ধরনের বিশেষ কফি বিন যা এশিয়ান পাম সিভেট পেটের মধ্যে হজমের মাধ্যমে গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে তৈরি হয়। তারপরে নিঃসৃত হয়- মল আকারে, যাকে ইন্দোনেশিয়ায় লুওয়াক বলা হয়। তবে এই কফি বিন শুধুমাত্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে পাওয়া যায়।
এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত কফি বিনটি ১৯ শতকের ঔপনিবেশিক আমলে ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় কৃষকেরা আবিস্কার করেছিল। যখন ডাচরা স্থানীয় শ্রমিকদের তাদের নিজস্ব কফি সংগ্রহ করতে নিষেধ করেছিল। কোপি লুয়াককে বিশ্বের বিরল এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল কফি বলা হয়; কারণ, মাত্র এক পাউন্ড কফি বিন শত শত মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়।
কোথায় উৎপন্ন হয়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের দ্বীপে কোপি লুয়াক উৎপাদিত হয়। কোপি লুওয়াকের বার্ষিক উৎপাদন প্রতি বছর প্রায় ৫০০-৭০০ কেজি। ইন্দোনেশিয়ার বালি, পূর্ব তিমুর, জাভা, সুলাওয়েসি এবং সুমাত্রা দ্বীপে কোপি লুয়াক উৎপাদিত হয়। সুমাত্রা দ্বীপ হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম কোপি লুওয়াক উৎপাদনকারী।
ফিলিপাইনে কর্ডিলেরাতে কেপে মোটিট, তাগালগ-ভাষী অঞ্চলে কাপে আলামিদ, মিন্দানাওতে কাপে মেলো বা কাপে মুসাং এবং সুলু দ্বীপপুঞ্জে কাহাওয়া কুবিং নামে পরিচিত কোপি লুয়াক। ভিয়েতনামে, কোপি লুয়াক কা ফি চন নামে পরিচিত, যা ইংরেজিতে ওয়েসেল কফি। ভিয়েতনাম এই তিনটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিমাণে কোপি লুয়াক উৎপাদন করে।
কোপি লুয়াক কীভাবে তৈরি হয়?
কোপি লুয়াক তৈরির প্রসেস সম্পর্কে একটু আগেই অল্পস্বল্প ধারণা দিয়েছি। সেটি পড়েই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে এই কফি তৈরির প্রক্রিয়া অন্যান্য কফির তুলনায় ব্যতিক্রম। এমনকি এটি প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি জানলে অনেকেই হয়তো এত দাম দিয়ে এই কফি খেতেই চাবে না! তবুও চলুন জেনে নেয়া যাক কীভাবে কোপি লুয়াক তৈরি করা হয়।
বন্য পাম বিড়ালরা কফি চেরি খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। যা দেখতে সাধারণ চেরির মতোই! এটি এমন একটি ফল যা সবার কাছে কফি অ্যারাবিকা হিসেবে পরিচিত। তবে পাম বিড়াল সব ধরনের কফি চেরি খেতে পছন্দ করে না। তারা খুব বেছে দেখে সবসময় সবচেয়ে পাকা এবং সবচেয়ে সুস্বাদু চেরি খায়। ফলে এদের মল থেকে তৈরি কফি বীজও হয় বেশ সুস্বাদু।
কিন্তু কফি চেরির ভিতরের কফি বীজ পাম বিড়াল হজম করতে পারে না। ফলে বীজগুলো সম্পূর্ণ অক্ষম অবস্থায় পাচনতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যায়, মলত্যাগ করে পরবর্তীতে বেরিয়ে যায়। পাকস্থলীর অ্যাসিড এবং এনজাইমগুলো কফি চেরি ফলের বাইরের আবরণকে হজম করে এবং মলত্যাগের আগে বীজকে গাঁজন করে। এই গাঁজন প্রক্রিয়াই কোপি লুয়াককে অনন্য স্বাদ দেয়।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের ভিতরে এনজাইমেটিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় তা ভেঙ্গে যায় এবং প্রোটিন গঠনকে পরিবর্তন করে। যেহেতু কফিতে তিক্ততার জন্য প্রোটিন আংশিকভাবে দায়ী, তাই প্রোটিনের মাত্রা কমে যাওয়া মানে পানীয়টি কম তেতো।
কফি চেরি খাওয়ার প্রায় দেড় দিন পরে, পাম বিড়াল মলত্যাগ করে। কফির বীজ থাকা মলগুলি খামারের কর্মীরা সংগ্রহ করে এবং প্রক্রিয়াজাত করে। সূক্ষ্মভাবে বাছাই, পরিষ্কার, ধোয়া এবং শুকানোর মাধ্যমে বীজগুলো রোস্ট করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। কোপি লুয়াকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে, এর বেশিরভাগই চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে খামারে ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা হয়।
কোপি লুয়াকের স্বাদ কেমন?
ইতোমধ্যে আপনাদের মনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন জেগেছে! তাইনা? যারা কোপি লুয়াক খেতে খুব পছন্দ করেন তাদের মধ্যে অনেকে বলেছেন যে এই কফির স্বাদ অতুলনীয়। তুলনামূলকভাব অন্যান্য কফির তুলনায় খেতে এটি কম তেতো লাগে। এছাড়াও বেশ সুন্দর একটি সুগন্ধ আসে। তাই এই কফি খেতে বেশ মজার।
কোপি লুয়াকের স্বাদ অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন – পাম বিড়াল যে কফি চেরিগুলো খাচ্ছে তার গুণমান, উৎস এবং কৃষকদের দ্বারা বীজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া, যেমন রোস্ট করে তৈরি করা একটি বড় প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও, পাম বিড়ালের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুসারেও স্বাদে তরতাম্য ঘটে। কিছু গবেষক মনে করেন যে, কোপি লুয়াক অন্যান্য কফির মতোই। এর মধ্যে আলাদা কিছু নেই। আবার কেউ কেউ তো এটাও মনে করে যে কোপি লুয়াক মোটেও স্বাস্থ্যকর কফি নয়। পেশাদার কফির স্বাদ গ্রহণকারীদের দ্বারা যখন একটি অন্ধ কাপিং স্বাদ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তারাও এই কফির স্বাদ সম্পর্কে অসাধারণ কিছু খুঁজে পাননি।
যদিও তারা কোপি লুয়াকের স্বাদকে লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন বলে মনে করেছিল। তবে তারা বলেছিল যে এই কফি পাতলা এবং কম অম্লীয়, তবে এমন কিছুই ছিল না যা তাদের এই ধরনের কফি পছন্দ করবে। তাই বেশি দাম দিয়ে এই কফি খাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
দাম কত এবং কেন এটি এত ব্যয়বহুল?
কোপি লুয়াক বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কফিগুলির মধ্যে একটি। ৪৫৪ গ্রাম বন্য কোপি লুয়াক কফির দাম ৬০০ ডলার হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার বড় সুপারমার্কেটগুলিতে, চাষকৃত কোপি লুয়াকের দাম, যা নিম্নমানের হিসেবে বিবেচিত হয়, প্রতি কিলোগ্রাম ১০০ ডলার থেকে শুরু হয়। যা উন্নতমানের দেশীয় আরবিকা কফির দামের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ কম।
কোপি লুয়াক এশিয়ার বাইরের বিশেষ কফি শপেও পাওয়া যায়। সেখানে, এক কাপ কোপি লুয়াকের দাম ৩৫ – ১০০ ডলারের মধ্যে পাওয়া যায়। এই কফি একটি খুব নির্দিষ্ট উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয় এবং এর চাহিদা অনেক বেশি কিন্তু খুব কম সরবরাহ বিধায় এর দাম অনেক বেশি।
তবে কোপি লুয়াক তৈরি নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। ধারণা করা হয় যেহেতু এটি বুঝার উপায় নেই যে কোপি লুয়াক বন্য নাকি পোষা সিবেট দ্বারা উৎপাদন করা হচ্ছে সেহেতু কফি উৎপাদনের জন্য পোষা সিবেটই বর্তমানে বেশি ব্যবহৃত হয়।
২০১৩ সালে বিবিসির একটি গোপন তদন্তে প্রকাশিত হয়েছিল যে কীভাবে অমানবিক পরিস্থিতিতে খাঁচাবন্দী সিবেট থেকে কফি উৎপন্ন করে পরবর্তীতে ইউরোপে বন্য সিবেট কফি হিসাবে লেবেলযুক্ত করে বিক্রি করা হয়। এমনকি টনি ওয়াইল্ড, কফি ব্যবসায়ী যিনি পশ্চিমে কোপি লুয়াক প্রবর্তন করেছিলেন, গার্ডিয়ানের একটি নিবন্ধে এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
তবে যাই হোক না কেন, কোপি লুয়াকের উৎপাদন খুবই শ্রমসাধ্য, তা বন্য বা চাষ করা যেটাই হোক। আরেকটি সমস্যা হল সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সিবেট প্রায় বিলুপ্তির পথে, যার অর্থ উৎপাদন আগের তুলনায় আরও কম।