কাকা! মোলায়েম স্বরে চাচা আরিফুর রহমানকে ডাকে শিশু ভাতিজা আমিনুর রহমান। আরিফুর রহমান ভয়ে ভয়ে সাড়া দেন। এই বুঝি একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসে ছেলেটা। চাচার সাড়া পেয়ে আমিনুর জিগ্যেস করে—ওই লোকটা নুয়ে নুয়ে হাঁটে কেন কাকা? আরিফুর জানেন কীসের ভারে বুড়ো রইসুদ্দিনের শরীর ন্যুব্জ, পিঠে কুঁজ। কিন্তু সে কথা ওকে বলা যাবে না। বললে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হবে। তবু ওকে শান্ত করা দরকার। জবাবে জানায় উনি অসুস্থ, তাই নুয়ে নুয়ে হাঁটেন। চুপ হয়ে যায় আমিনুর।
কাক ডাকা সকাল থেকে অফিস টাইমের হুড়োহুড়ি শুরু হবার আগ পর্যন্ত এই পাড়ায় প্রত্যেক ঘরে পানির প্রয়োজন মেটানোর চাকরি করেন রইসুদ্দিন। আগে বিকেলেও পানি টানতেন। ইদানীং বয়সের কাছে পরাজিত হয়ে শুধু একবেলা মশকজোড়া একটা লগি ধরণের কাঠে বেঁধে কাঁধে চড়ান। বিকেলের কাজ তার ছেলেকে দিয়েছেন।
অমন ভরোভরো পানির মশক নিয়ে দুবেলা কাঁধে করে নির্দয় রোদে পুড়ে, ঝুমবরষায় ভিজে পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে সারাদিনে হাজারখানেক সিঁড়ি ভেঙে ক্লান্তি তো ধরতোই, এক সময় কুঁজের চিহ্ন পড়া শুরু করে পিঠে। সেই থেকে পা টিপে টিপে, ধীরে ধীরে নুয়ে নুয়ে হাঁটা শুরু রইসুদ্দিনের। আর দিনশেষে একজন ভিস্তিওয়ালার জীবনটাও অনেকটাই এই গল্পে রূপ নেয়।
ভিস্তিওয়ালা কারা
শহরাঞ্চলে পানির স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত যারা মানুষের বাসায় বাসায় মশক পিঠে বয়ে পানি সরবরাহ করতো, তাদেরকে ‘ভিস্তিওয়ালা’ বলা হতো। জানার বিষয় হচ্ছে, ‘ভিস্তি’ শব্দটির উৎপত্তিতে জড়িয়ে আছে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম। ‘ভিস্তি’ শব্দের মূল হচ্ছে পার্সি শব্দ ‘ভেস্ত’ বা বেহেশত।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র হোসেন (রাঃ) কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধের সময় পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন অমন মশকে করে। তখন শত্রুপক্ষের তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার বেহেশত লাভ হয়। এই ঘটনা থেকেই ওই চামড়ার মশকের নাম হয়ে যায় ভিস্তি। আর সেখান থেকেই আসে ভিস্তিওয়ালা শব্দটি।
যারা ভিস্তি বহন করে বেড়ায়, তারা ভিস্তিওয়ালা। ভিস্তিওয়ালাদের পিঠে ঝুলতে থাকে মশক; যা সাধারণত পশুর চামড়ায় বানানো হতো। ছাগল, উট প্রভৃতির চামড়ায় তৈরি মশকে তারা পানি ফেরি করে বেড়াতো। এরকম পশুচামড়ার নির্মিত মশকে নবী-রাসুলদের ঘরেও পানি মজুদ থাকতো।
এতদঞ্চলে ‘ভিস্তি’ ছাড়া ‘সাক্কা’ও পরিচিত ছিল নাম হিসেবে। ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ বলে হেঁকে হেঁকে জীবিকা নির্বাহ করার ইতিহাস তাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। ‘আব’ শব্দের অর্থ পানি। সুতরাং, ‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’ বলে হাঁক ছেড়ে এরা আসলে এদের কাছ থেকে পানি নেওয়ার জন্য আহবান জানাতো।
ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, এমনকি কলকাতা শহরেও আজকাল ভিস্তিওয়ালাদের অল্পবিস্তর আনাগোনা আছে। মোঘল আমলের ইতিহাসে জড়িত এই জলবহনের পেশাজীবীরা আজ অবশ্য বিলুপ্তির পথে প্রায়। নিজাম নামে এক ভিস্তিওয়ালাকে সেকালে বাদশা হুমায়ূন একদিনের জন্য বাদশা বানিয়েছিলেন। সেই রমরমা ভাব এখন আর ভিস্তিওয়ালা পেশায় নেই বললেই চলে।
এদেশীয় ভিস্তিওয়ালারা
প্রভাতকালীন ঢাকা এক শান্ত, নিরিবিলি শহর। সেই শান্ত শহরের বুকে ব্যস্ততার যোগান দেওয়া পুরোনো পেশাজীবীদের দলে ভিস্তিওয়ালারা আছেন। তবে পেশাজীবীদের নামে ঢাকায় অনেক স্থাননাম হলেও ভিস্তিওয়ালাদের নামে এমন কোনো স্থাননাম নেই। অবশ্য নাজিরাবাজারের সন্নিকটে ‘সিক্কাটুলি’ নামের যে মহল্লা, ধারণা করা যেতে পারে তার পূর্বনাম ছিল সাক্কাটুলি। সাক্কাদের নামে। মুখে মুখে নাম বদলে গেছে। হয়ে গেছে সিক্কাটুলি।
অনুমান করা হয়, ১৮৭৮ সাল থেকে ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের দারুণ প্রতিপত্তি ছিল পেশাজীবী দল হিসেবে। পানীয় জলের সুব্যবস্থার স্বার্থে, অর্থনৈতিকভাবে যারা স্বাবলম্বী ছিলেন সেি সময়, তারা টাকার বিনিময়ে লোক লাগিয়ে নিজেদের জন্য পানি সংগ্রহ করতেন। এরাই ছিল এই শহরের ভিস্তিওয়ালা।
আজকাল প্রয়োজন কমে গেলেও এখনও একেবারেই বিলীন হয়নি তাদের অস্তিত্ব। কোথাও কোথাও দুয়েকজন ভিস্তিওয়ালা চোখে পড়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটছে কাঁধে জলের বোঝা নিয়ে। এখন তাদের মশকের পানির জায়গা নিয়ে নিয়েছে নীলচে জারের পানি।
সকাল হতেই পানিভর্তি জার নিয়ে ছোটে তিন চাকার ভ্যান। আজকালকার ঢাকাবাসী সাপ্তাহিক বা মাসিক চুক্তিতে ওয়াসার এই পানি কিনলেও মিথ্যে হয়ে যায়নি শামসুর রাহমান, নাজির হোসেন, মুনতাসীর মামুনদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা।
ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের নদীলগ্ন বস্তিতে খুঁজলে দুয়েকজন ভিস্তিওয়ালার দেখা পাওয়া যায় এখনো। এই লেখক সর্বশেষ বছরবিশেক আগে একজন মফস্বলী ভিস্তিওয়ালাকে চিনতেন। টিনের কন্টেইনারে পানি বহন করতে করতে তার নাভিশ্বাস উঠে যেতো বয়সের ভারে।
তারা বংশানুক্রমে ভিস্তিওয়ালা হিসেবেই কাজ করেছেন বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন শহরে এবং শহরতলীতে। এই থেকে ধারণা করা যেতে পারে এদেশের মফস্বলেও এই পেশার পসার বহুদিন আগের। আরও ধারণা করা যেতে পারে, ঢাকা থেকেই সারাদেশে এরা ছড়িয়ে গিয়েছেন গাছের ডালপালার মতো।
সাহিত্যে ভিস্তিওয়ালা
সাবঅল্টার্ন তথা সমাজের দলিত শ্রেণির কথা সাহিত্যে উঠে আসতে শুরু করে মোটাদাগে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ এবং মানিক—এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তবে এতদঞ্চলের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ভিস্তিওয়ালাদের সময়কালকে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ের সাথে ঠিক মেলাতে পারে না।
তাদের সময়ে নিম্নবর্গীয় নানা পেশার মানুষের বিকাশ হয়েছে—সেকথা ঠিক। তবু, তাদের পূর্বসূরিরা সাবঅল্টার্ন জীবনধারা তুলে এনেছেন কমবেশি। এভাবে ভিস্তিওয়ালারাও এসেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। তিনি লিখেছেন—
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে
মশক কাঁধে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
এখানে একুশ লাখ একটা কাল্পনিক সংখ্যাই বটে। এখন যেমন সাতসকালে ঢাকার রাস্তায় দলে দলে অসংখ্য গার্মেন্টসকর্মী দেখা যায়, তখনকার সময় ভিস্তিওয়ালাদের ছিল এরকমই সংখ্যাধিক্য। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে সকালে পানির চাহিদা মেটানোর যে একটা হিড়িক পড়ে যেতো, বিশ্বকবি এখানে সে কথাই বুঝিয়েছেন।
আবার এ থেকে যদিও বোঝা যায়— এরা প্রাকৃতিক জলাশয়, যেমন পুকুর, নদী, খাল-বিল থেকে জল ভরতো মশকে, তবুও আমরা জানি, চাপকল থেকে জল ভরেও মশক নিয়ে ছুটতো এদের কেউ কেউ।
সুকুমার রায়ের ছড়ায় অবশ্য ভিস্তিওয়ালা এসেছে একটু অন্যভাবে। তিনি লিখেছেন—
লাখোবার যায় যদি সে
যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই পাইনে দিশে।
নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?
এ কথাটা যেমনি বলা।
রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ ক’রে বাড়িয়ে গলা
প্রণাম করল দু’পায় তাঁর।
নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিকথা ‘স্মৃতির শহর’। তিনি এ গ্রন্থে ভিস্তিওয়ালা প্রসঙ্গে লিখেছেন—
আর ভুলিনি সেই ভিস্তিকে, যে রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। … কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পেতলের কলসের ভেতর। মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি, আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা।
শেষ কথা
এখনও শহরের ফুটপাতে অথবা গলিপথে দুটো টিনের কন্টেইনার কাঠ অথবা বাঁশের দণ্ডে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখে কোনো ভিস্তিওয়ালা। কেউ হয়তো খরচ দিয়ে তাকে দিয়ে পানি টানায়। তবু এই পেশায় তার পেট চালানো দায়। একেকটি পুরাতন পেশা বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে কত কত ধরণের বাস্তবতা! কত অব্যক্ত কষ্ট আর কান্নার গল্প! এসব লেখা থাকে না ওদের হাসিমাখা মুখে। ওরা খুব সহজেই আবেগ লুকোতে জানে।
Feature Image-theasiantribune.com References: 01. ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন। লেখক: ইমরান উজ-জামান। প্রকাশনী: পুথিনিলয়। প্রকাশকাল - ২০১৯ 02. ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির ইতিহাস। লেখক: মুনতাসীর মামুন। প্রকাশনী: অনন্যা। প্রকাশকাল - ২০১৭ 03. বুড়িগঙ্গা তীরের রহস্যনগরী। লেখক: সৈয়দ আবদাল আহমদ। প্রকাশনী: কাশবন প্রকাশন। প্রকাশকাল - ২০১৩