বলা হয়ে থাকে, ইতালির ভেনিস হচ্ছে এমন একটি শহর যা কেবল পর্যটককে নিজস্ব সৌন্দর্যই দেখায় না। বরং নিজস্ব যাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করে এবং একরাশ ভালোবাসা আর স্মৃতি দেয় পর্যটকদের। যদি বলা হয়, ইউরোপের সবচেয়ে রোমান্টিক শহর কোনটি? সবার আগেই উঠে আসবে ভেনিসের নাম।
এমনকি যদি পৃথিবীর রোমান্টিক শহরের কথাও বলা হয় – তাতেও ভেনিস থাকবে তালিকার একদম উপরের দিকে। রেনেসাঁর সময়কালের স্থাপত্যশৈলী, গ্রীষ্মেও চির যৌবনার রূপ, সূর্যাস্ত, পাবলিক স্কয়ার, সরু খাল আর গন্ডোলা যাত্রা – এই সবকিছু মিলিয়ে এটি এমন এক শহর, যেই শহরের প্রেমে পড়তে বাধ্য যে কোনো মানুষ। তাই আজকের আয়োজনটা এই রোমান্টিক শহরটাকে কেন্দ্র করেই।
দ্য ফ্লোয়েটিং সিটি – ভেনিসের উত্থান
ইতালির ভেনিস বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত। তবে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ভাসমান শহর নামটিতে। এই ভেনিস শহরটি ১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত যা অসংখ্য খাল এবং সেতুর সাথে যুক্ত। তবে জানা বিষয় হচ্ছে, ভেনিসের এই ইমারতগুলি কিন্তু সরাসরি দ্বীপগুলিতে নির্মাণ করা হয়নি। পরিবর্তে, সেগুলো নির্মিত হয়েছে ভাসমান কাঠের প্ল্যাটফর্ম বা বেলে মাটিতে পোঁতা বড় বড় কাঠের খুঁটির উপর; যা দড়ি দিয়ে আটকানো।
ভেনিসের নির্মাণকাল পঞ্চম শতাব্দীর সময়কালে। সেই সময় একদিকে যেমন ইতিহাসের মহাপরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটছে; অপরদিকে উত্তর থেকে বর্বররা রোমের পূর্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। এই আক্রমণ এর হাত থেকে বাঁচতে, ভেনিসীয় মূল ভূখণ্ডের জনতা আশেপাশের জলাভূমিতে পালিয়ে যায় এবং তোরস্কেলো, আইসোলো এবং মালামোককোর বালিময় দ্বীপে আশ্রয় নেয়। যদিও জনবসতির জন্য নির্মিত এসব আশ্রয়কেন্দ্র সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে গড়া ছিল; কিন্তু ভেনিসিয়ানরা ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে দ্বীপগুলিতে নিজেদের আবাস গড়ে তোলে।
তাদের স্থাপনাগুলির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার জন্য, ভেনিসিয়ানরা প্রথমে মজবুত কাঠের খুঁটি বেলে মাটিতে গাঁথে। তারপরে, সেই খুঁটিগুলোর উপরে কাঠের আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। কেননা, এই সমতল প্ল্যাটফর্মগুলি সমতল জমিনের কাজে আসে। অবশেষে, এই প্ল্যাটফর্মের উপরই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর একটি বইয়ে ভেনিসের নির্মাণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বইটির বর্ণনা মোতাবেক, সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট গির্জাটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন ১১,০৬,৬৫৭টি কাঠের খুঁটি, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪ মিটার, তা খালের নীচে ,মাটিতে পোঁতা হয়েছিল। এই পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সময় লেগেছিল দুই বছর দুই মাস। তার উপরের কাঠগুলো স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং মন্টিনিগ্রোর গভীর বন থেকে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সংগ্রহীত কাঠগুলো পানিপথে ভেনিসে নিয়ে আসা হয়। তখনকার সময়ে এত বড় কর্মপরিকল্পনাকে সাফল্যে রূপান্তর করা কিন্তু রূপকথার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
সহায়ক কাঠামো হিসাবে কাঠের ব্যবহার খানিকটা আশ্চর্যজনক লাগতে পারে অনেকের কাছেই। কেননা, কাঠ পাথর বা ধাতুর তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম টেকসই। ভেনিসের কাঠের কাঠামোর দীর্ঘায়ুর গোপন আর মূল রহস্য হল, ওগুলো পানির তলায় নিমজ্জিত। মূলত কাঠের ক্ষয় হয় ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবের কারণে। ভেনিসে কাঠের খুঁটি পানির নীচে ডুবে থাকার কারণে অণুজীবরা অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারে না। তাই টিকতেও পারে না। এছাড়াও, কাঠের চারপাশে অবিরাম নোনা জলের প্রবাহ সময়ের সাথে সাথে কাঠকে শক্ত পাথরের মতো মজবুত কাঠামোতে পরিণত করেছে। কাঠের শিলাখন্ডে পরিণত হয়েছে সেগুলো।
ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী গন্ডোলা
সমগ্র ভেনিস জুড়েই এক বিশেষ ধরণের নৌযান চোখে পড়ে। এগুলোকে গন্ডোলা বলা হয়। ভেনিসের ভাসমান শহরে চলার জন্য উপযুক্ত এইসব গন্ডোলা। মূলত গন্ডোলা তৈরি হয় সরু খাল দিয়ে চলাচলের জন্য। শহরের অধিবাসীরা যেমন নিত্যদিনের কাজে এই গন্ডোলা ব্যবহার করে। ঠিক তেমনি আবার এই গন্ডোলা দিয়ে অনেকেই জীবিক উপার্জন করে থাকে।
ভ্রমণপ্রেমিরা ভেসে বেড়ায় এই গন্ডোলায় চড়ে। কখনো তাদের সঙ্গী হয় কোনো এক বেহালাবাদকও। ইতালীয় সুরের মূর্ছনায় পর্দা উঠে যেন প্রিয় চলচ্চিত্রের রোমান্টিক কোনো দৃশ্যের। শহরের সংকীর্ণ খালগুলির পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বহুরঙা ভবনগুলোর মধ্য দিয়ে গন্ডোলা যাত্রা করার মতো অনুভূতি বিশ্বে আর দ্বিতীয়টা নেই।
ওয়াটারফ্রন্ট গীর্জা
সান জর্জিও ম্যাজ্জিওরি দ্বীপে ষোল শতকে নির্মিত একটি ঐতিহ্যবাহী ওয়াটারফ্রন্ট গীর্জা আছে। এই ব্যাসিলিকার বেল টাওয়ার থেকে সমগ্র শহরের এক বিস্তৃত দর্শন পাওয়া যায়। একইসাথে এখন থেকেই দেখতে পাওয়া যাবে, দিগন্ত ঘেরা ভিনিশিয়ান হ্রদগুলি কিভাবে ভেনিসের এই খালের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। গ্রীষ্মের দিনেও যখন চির যৌবনা ভেনিসের খালে সূর্যাস্ত হয় তখন গৌধুলির আভায় এক পরাবাস্তব শহরে পরিণত হয় ভেনিস।
রেনেসাঁর সময়কার স্থাপত্যশৈলীতে গড়া হয়েছে এই গীর্জা। তাই এই স্থাপত্যের প্রাচীরগুলিতেও শোভা পাচ্ছে রেনেসাঁ সময়কালে অনুপ্রাণিত দেয়ালিকা। মজার বিষয় হচ্ছে, এই গীর্জায় হাতেগোণা কেবল কয়েকটি শিল্পকর্মই চোখে পড়বে। গীর্জার বেশিরভাগ দেয়ালই হয় সাদা রঙ করা; আর নয়তো একেবারেই খালি। এটি একটি বেনেডিক্টীয় গীর্জাআ। আর বেনিডিক্টাইন সন্ন্যাসীরা এই গীর্জাকে খুব বেশি সাজসজ্জা করার অনুমতি দেয়নি।
মিউজিকা অ্যা প্যালাজোতে অপেরা
মিউজিকা অ্যা পালাজ্জোর অপেরা শো অন্য যে কোনো জায়গা থেকে ভিন্ন। এই অপেরা শো, মোমবাতির মৃদু আলোয় রাঙানো তিনটি আলাদা কক্ষে সঞ্চালিত হয়। আলোকসজ্জা, সংগীত, শ্রোতা (১০০ জনের অধিক নয়) এবং তিন দল গায়কের আবেগী কিন্তু ছোট্ট অন্তরঙ্গ উপস্থাপনা এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে। তিনটি কক্ষের প্রত্যেকটিতে শহরের দুর্দান্ত দৃশ্য, ভিক্টোরিয়ান আসবাব এবং দেয়ালচিত্র যে কাউকে এক মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ে যাবে ইতিহাসের অভ্যন্তরে।
ভেনিসের সড়কগুলোও যেন বয়ে চলা কংক্রিটের এক খাল
পাবলিক স্কয়ারটি ভেনিসের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলে কিনা, ভ্রমণকারীদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই স্কয়ার। রিয়াল্টো সেতু, বিখ্যাত সেন্ট মার্কস চার্চসহ দারুণ সব দর্শনীয় স্থান আর বস্তুতে ভরপুর এই পাবলিক স্কয়ার। তবে, কেউ যদি সত্যি এই শহরকে আপন করে পেতে চায় তবে তাকে মূল অঞ্চল থেকে বেরিয়ে মুরানো বা বুরানো এর মতো ছোট দ্বীপগুলোতে যেতে হবে।
ভেনিস একটি খুব ছোট শহর যা খাল এবং সরু রাস্তায় ঘেরা। শতাব্দী পুরনো রাস্তায় লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে হারানোর মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে ভেনিস ভ্রমনের আসল আনন্দ। আসল ভেনিসকে কাছে পাবার অভিজ্ঞতা পেতে হলেও একবারের জন্য এই নিরব রাস্তায় একাকী রেখে যেতে হবে নিজের পদচিহ্ন।
সবশেষে একটা প্রশ্ন মনে জাগে – সৌন্দর্য কি ডেকে আনতে পারে ধ্বংস? ভেনিসকে অগণিত বিদেশী আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করেছ যে খাল, সেটাই আজ স্থানীয় অধিবাসীদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। স্থানীয় ভেনেসীয়দের কাছে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা সাধারণ ঘটনাই বলা চলে। যেহেতু বছরে প্রায়ই পানির স্তর বেড়ে যায়। এই জলোচ্ছ্বাস অ্যাকোয়া আল্টা (উচ্চ জল) নামে পরিচিত এবং সাধারণত শক্তিশালী বাতাস, ঝড় এবং তীব্র অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির কারণে বা অস্বাভাবিক উচ্চ জোয়ারের কারণে এমনটি ঘটে থাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রজলের স্তরের পরিবর্তন ঘটছে। যার কারণে জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে। যা শহরে বসবাসকারীদের উদ্বিগ্ন করছে প্রতিনিয়ত। অবশ্য ভেনিসকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য বেশ কয়েকটি সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি হল মো.এস.ই. (মডুলো স্পেরিমেটেল ইলেট্রোমেকানিকো বা পরীক্ষামূলক বৈদ্যুতিক মেশিনাল) প্রকল্প। এর মধ্যে ৯টি মোবাইল স্লুইস গেট নির্মাণের কাজ জড়িত; যা জোয়ার যখন স্বাভাবিক জলের চেয়ে এক মিটার উপরে চলে যাবে তখন অ্যাড্রিয়াটিক মহাসাগর থেকে লেগুনকে আলাদা করবে।
তবুও, কিছু নিরাশাবাদী পর্যবেক্ষক সন্দেহ করেন যে ভেনিসকে চিরকাল ধরে রাখার জন্য এই ধরনের ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। এবং একদিন আটলান্টিসের মতই রূপবতী ভেনিসেরও হয়তো সলীল সমাধি ঘটবে।
Feature Image: apkpure.com
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Venice.
02. Venice: A City of Love and Romance.
03. The Construction of Venice, the Floating City.