জাপান। এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী এক দ্বীপরাষ্ট্র। এই দ্বীপরাষ্ট্রেরই এক ছোট্ট গ্রামের নাম নাগোরো। এই গ্রামের সড়ক ধরে হেঁটে যাবার সময় চোখে পড়ে নিত্যদিনের কর্ম ব্যস্তে গ্রামের বাসিন্দাদের। কেউ হয়তো সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছে; কেউ দোকানে বসে আছে খদ্দেরের আশায়; কেউ নিজের বাড়ির উঠোনে বসে আছে; আবার স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় বাচ্চারা শান্তমনে ক্লাস করছে। আর বাকি ৮/১০ টা সুন্দর সাজানো-গোছানো গ্রামের মতোই নাগোরো বেশ ছিমছাম একটা গ্রামশহর।
তবে একটা কিন্তু আছে। এতক্ষণ গ্রামবাসীদের যা বিবরণ শুনলেন তারা সবাইই আসলে প্রাণহীন। তাহলে কি তারা মৃত? মোটেই না। তাহলে? এই পুরো গ্রামটাই হচ্ছে আসলে পুতুলের গ্রাম। পুতুলরাই সড়ক ধরে হাঁটার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে; দোকানে বসে আছে পুতুল দোকানি; বাড়ির উঠানেও পুতুল এবং এমনকি স্কুলের সারি সারি বেঞ্চে বসে থাকা সব বাচ্চা পুতুল। এই গ্রামে কি জীবিত কেউ থাকে না? অবশ্যই থাকে তবে সঙ্গে নিয়ে প্রাণহীন একঝাঁক পুতুল। আজকের আয়োজনটা এই অদ্ভুত আর রহস্যেঘেরা গ্রামটাকে কেন্দ্র করেই।
ছোট্ট গ্রাম নাগোরো। যে গ্রামে এককালে প্রায় ৩/৪০০ পরিবারের বাস ছিল। কিন্তু, এখন মাত্র ১৫ থেকে ১৬ জন মানুষ থাকেন সেখানে। কারণ কি? গত শতকের পঞ্চাশের দশকে গ্রামটিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে একটি বাঁধ নির্মান করা হয়। এরপর থেকেই গ্রামে পানির অভাব দেখা দেয়। বেশীরভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। রয়ে যান হাতে গোণা কয়েকজন কেবল।
জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতেই থাকে। গ্রামটিতে শেষ শিশুর জন্ম হয়েছিল ২০০১ সালে। গ্রামটিতে এখন কোনো দোকান নেই। নেই কোনো হাসপাতালও। সামান্য অসুখ হলেও শহরে যেতে হয় বাসিন্দাদের। এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০১৪ সালে গ্রামটিতে মাত্র ৩৭ জন বাস করতো। যা ২০১৫ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ জনে। এভাবেই ক্রমাগত কমতে থাকে গ্রামের লোকসংখ্যা।
যোগাযোগ ব্যবস্থাও মোটেও ভালো নয় গ্রামটির। গ্রামের সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশনটিতে পৌছতেও সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। মাঝে মাঝে দুয়েকটি বাসের দেখা মিলে অবশ্য। কিন্তু সেসব বাসের স্টপেজ নেই বিধায় থামেও না। কারণ অনেকের মতেই গ্রামটি অশুভ! কেন? সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে জেনে নেই কেন গ্রামের নাম – পুতুলের গ্রাম! কারণ গ্রামের নির্জীব কিছু বাসিন্দা আছে। তারা সকলেই পুতুল! পুরো গ্রাম জুড়েই এদের দেখা পাওয়া যায়।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুতুল, দোকানে পুতুল, স্কুলে পুতুল, বাড়ির উঠানে পুতুল! সবখানে পুতুল! পুরো গ্রামটিকে ভরে ফেলা হয়েছে পুতুল দিয়ে। জীবিত বাসিন্দাদের সাথে ওরাও হয়ে উঠেছে এই গ্রামেরই নতুন বাসিন্দা। কিন্তু গ্রামটি পুতুলদের গ্রাম হয়ে উঠলো কী করে? এর জন্য দায়ী সুকিমি আইয়ানো নামের এক নারী।
যিনি বহুকাল আগে গ্রাম ছেড়ে পড়াশোনার জন্য ওসাকায় চলে গিয়েছিলেন। তারপরে সেখানেই বিয়ে করে সংসার পাতেন। ২০০২ সালে নিজের অসুস্থ বাবার দেখাশোনা করার জন্য ফিরে আসেন তিনি গ্রামে। এসে অবাক হয়ে যান! তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়েও গ্রামে প্রায় ৩০০ মানুষ ছিল। কিন্তু তখন গ্রামের লোকসংখ্যা পঞ্চাশেরও নিচে নেমে গিয়েছিল। হতাশ হয়ে যান সুকিমি। কিন্তু কী আর করা? নিজের বাবার দেখাশোনা আর মাঝে মাঝে টুকটাক ক্ষেতে কাজ করা শুরু করেন তিনি।
২০০৩ সালের কথা। সুকিমির বাবার একটি মূলা আর মটরশুঁটির ক্ষেত ছিল। সেই ক্ষেতের দেখাশোনা করতে লাগলেন সুকিমি। কিন্তু গ্রামে কাক আর অন্যান্য পাখিদের উৎপাত বাড়তে লাগলো দিনকে দিন। নীরব আর জনবিরল জায়গা বলে পাখিরা নিজের আবাসস্থল বানাতে শুরু করলো। সমস্যা বাঁধল, পাখিগুলোর ব্যাপক অত্যাচারে। কোনো গাছের চারা বের হলেই পাখিরা চারাগুলো নষ্ট করে দিতো। বিরক্ত হয়ে একদিন সুকিমি একটি কাকতাড়ুয়া বানালেন। ওটার মুখটা বানালের নিজের বাবার মুখের আদলে! তারপর দাঁড় করিয়ে দিলেন ক্ষেতের ঠিক মাঝ বরাবর।
কাকতাড়ুয়াটাকে মানুষ ভেবে ভয়ে আর এলো না পাখিগুলো। ব্যাপারটা সুকিমিকে নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করলো। পুতুল গ্রামের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। মৃত মানুষদের স্মরণে একের পর এক পুতুল বানাতে লাগলেন তিনি। প্রথম পুতুলটা বানালেন নিজের এক মৃত প্রতিবেশীর আদলে। যার সাথে ছোটবেলায় খেলতেন তিনি, তারপর ওটাকে বসিয়ে দিলেন সেই প্রতিবেশীর বাড়িতে। ধীরে ধীরে পুতুলে ভরে যেতে লাগলো গ্রামটি।
গ্রামের অন্য বাসিন্দারাও সুকিমির এই বিচিত্র শখে বেশ উৎসাহই দিতে লাগলেন। ফাঁকা গ্রামে পুতুলগুলোর উপস্থিতি উনাদের মন্দ লাগতো না। এভাবেই চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে আলোচিত হয়ে উঠতে লাগলো নাগোরো গ্রামের পুতুলগুলো। জাপানি একাধিক সংবাদমাধ্যম সুকিমির সাক্ষাৎকার নিতে আসা শুরু করলো।
এভাবেই কেটে গেল নয়টি বছর। ২০১২ সালের কথা। গ্রামের স্কুলে তখন মাত্র দুজন শিক্ষার্থী ছিল। তাদের স্কুলের পড়াশোনাও একটা পর্যায়ে গিয়ে শেষ হলো! উচ্চ শিক্ষার আশায় শহরের দিকে পাড়ি দিল ওরা। স্কুল রয়ে গেল ফাঁকা। কোনো ছাত্র-ছাত্রী নেই। তাই বন্ধ হয়ে গেল গ্রামের একমাত্র স্কুলটিও।
ওই স্কুলে সুকিমিও ছোটবেলাতে পড়তেন। নিজের সহপাঠীদের চেহারা ভেবে ভেবে তিনি পুতুল বানাতে শুরু করলেন। পরিচিত শিক্ষকদেরও পুতুল বানালেন। সেগুলোকে বই-খাতা সহকারে বসিয়ে দিলেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীকক্ষে। ধীরে ধীরে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষই ভরে উঠলো পুতুলে। যেন সবাই শান্তমনে বসে ক্লাস করছে।
কিন্তু সব কিছু নীবর! তাই, গ্রামের প্রতিটি দোকান খুলে দেওয়া দেওয়া হলো। সেখানেও বসিয়ে দেওয়া হলো পুতুলদের। নেই কোনো মালামাল, নেই কোনো খদ্দের, শুধু আছে পুতুল!
জানা যায়, গ্রামের শেষ বিয়েটি হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। যে জায়গাতে বিয়ের উৎসব হতো সেখানে দুটো বর আর বউ পুতুল বানিয়ে বসিয়ে দেন সুকিমি। আশেপাশে বসে আছে নিমন্ত্রিত অতিথিরা। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাদকেরা। যেন পুতুল বিয়ে হচ্ছে সেখানটাতে।
গ্রামটি আবার ভরে উঠলো। কিন্তু নেই কোনো কোলাহল। নেই কোনো শব্দ। এভাবেই কেটে গেল আরো দুটি বছর। ২০১৪ সালে জার্মান তথ্যচিত্র নির্মাতা ফ্রিটজ স্কুম্যান এই গ্রামটি নিয়ে তৈরী করেন তাঁর বিখ্যাত তথ্যচিত্র ‘ভ্যালি অফ ডলস’। এরপর থেকেই গোটা পৃথিবীতে নাগোরো পরিচিত হয়ে ওঠে ‘পুতুলদের গ্রাম’ হিসাবে। দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকেরা আসেন শুধুমাত্র এই গ্রামটি দেখতে।
পর্যটকেরা অবাক না হয়ে পারে না। গাছের নিচে কেউ বসে আছে, পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা…সবকিছুকে কেমন যেন জীবন্ত মনে হয় তাদের কাছে। সুকিমির কাজ এতই নিখুঁত যে তারা চমকে উঠতে বাধ্য হন! পুতুল বানানোর ক্লাসও নিয়ে থাকেন সুকিমি। বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি বুধবার তিনি পর্যটকদের দেখান যে কী করে পুতুল বানাতে হয়। যদিও পুতুল বানানোর সরঞ্জাম শিক্ষার্থীকেই বহন করতে হয়।
বছরের অক্টোবর মাসে গ্রামের সবগুলো পুতুল নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ২০১৩ সাল থেকে এমনটা হয়ে আসছে। এই সময়েই সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসে গ্রামটিতে। আপনি চাইলে সুকিমির বাড়িতেও যেতে পারেন। তার বাবা এখনো জীবিত। ভদ্রলোকের বয়স এখন ৯০। নাগেরোর সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি তিনিই।
বারান্দাতে সবসময় বসে থাকেন সুকিমির মায়ের আদলে তৈরী করা একটি পুতুল। সুকিমি মাঝে মাঝেই পুতুলটার সাথে কথা বলেন। কিন্তু ওটা কোনো জবাব দেয় না।সুকিমিকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের বেজায় আগ্রহ। কেন তিনি এসব করছেন? এই প্রশ্নের কখনোই তেমন গ্রহনযোগ্য উত্তর দেন না তিনি।
একবার এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিল, “আপনি কি কখনো ওসাকাতে ফিরে যেতে চান?” সুকিমি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমার অসুস্থ বাবার সেবা করার জন্য এই গ্রামে ফিরে এসেছিলাম, ওসাকাতে আমার সন্তানেরা রয়েছে। যদি কখনো খুব বেশী অসুস্থ হয়ে যাই তবে ওদের কাছে ফিরে যাবো। কিন্তু যতদিন সুস্থ আছি ততদিন নাগোরোতে থেকেই পুতুল বানিয়ে যেতে চাই!”
মোটামুটি এই ছিল নাগোরোর পুতুল গ্রামের গল্প। কিন্তু উপরে একবার বলেছিলাম এই গ্রামের ভিতর দিয়ে খুব কম বাস যাতায়াত করে। এর পেছনে কারণটা অশুভ বলেই গণ্য। হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্য। খুব কম বাসই আসে যারা পারতপক্ষে এদিকটাতে আসে না। আর আসলেও দিনের বেলা, রাতের বেলা কোনো বাস এই গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে চায় না। কারণ আশেপাশের গ্রামগুলোর লোকেদের মতে এই গ্রামটি অশুভ।
আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। তারা মনে করে যে মৃত মানুষদের চেহারার আদলে পুতুলগুলো বানানোর ফলে মৃতদের আত্মা ঢুকে গেছে পুতুলগুলোর ভিতরে। শুধু আশেপাশের গ্রামের লোকেরাই না। এমনকি, নাগোরোর অনেক বাসিন্দাই সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে চায় না। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের মধ্যেও অনেকে বলে যে রাতের বেলা নাকি পুতুলগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে।
যেসকল পর্যটকেরা নাগোরো ঘুরতে চান, তারা মোটামুটি সবাইই একই অভিযোগ করেন। গ্রামটি খুব বেশী নীরব, এখানকার মানুষেরা জোরে কথা বলে না। আর এই নীরবতার মাঝে পুতুলগুলোকে খুব অপার্থিব লাগে! কেন যেন মনে হয় ওগুলো জীবন্ত, ওরা সব দেখছে, সব শুনছে।
২০১৮ সালে, ম্যাকি নামে একজন অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক সন্ধ্যাবেলা গ্রামের ভিতর ঘুরতে বের হন। অনেক রাত পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সে ফিরে না এলে গ্রামের কয়েকজন মিলে তার খোঁজে বের হয়। বিরাট একটা গাছের নিচে বসে থাকা দুটো পুতুলের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় ম্যাকিকে। জ্ঞান ফেরার পরেও পুতুল দেখে ভয় পাচ্ছিলো সে। সবাইই জিজ্ঞাসা করে যে কী হয়েছিল। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি তার কাছ থেকে। ম্যাকি শুধু এটুকুই বলেছিলো,
আমি আর কখনো এই গ্রামে আসবো না, এটা জীবন্ত মানুষদের জন্য নয়!
ম্যাকির এই ঘটনা ইন্টারনেটে দ্রুত ছড়াতে থাকে। এত বেশী ছড়িয়ে যায় অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা এক রাতে এই গ্রামে কাটানোর জন্য সুকিমির কাছে অনুমতি চায়। কিন্তু তাদের অনুমতি দেননি সুকিমি। রহস্য আরো ঘনীভূত হয়।
২০১৯ সালে আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গ্রামের ঠিক মাঝের রাস্তার মাত্র ৩০ সেকেন্ডের ব্যবধানে তোলা দুটি ছবি দেখা যায়। প্রথম ছবিতে দেখা যায় রাস্তার মাঝখানে দুটি পুতুল দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায় যে পুতুলদুটো একে অপরের থেকে বেশ অনেকটা দূরে সরে গেছে!
মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যবধানে কে ওদের দূরে সরালো? যেখানে আশেপাশে কোনো বাড়িও নেই। নাগোরো নিয়ে অতিপ্রাকৃত গুজব আরো দ্রুত ছড়াতে থাকে। এখনো ছড়াচ্ছে। যাই হোক, কখনো যদি জাপান যান, তবে একবার ঘুরতে যাবেন পুতুলদের এই গ্রামে। তবে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবেন অবশ্যই। বলা তো যায় না…
Feature Image: unusualplaces.org
তথ্যসূত্র-
01. Nagoro – A Creepy Japanese Village Where Dolls Replace The Departed.
02. Japan’s CREEPIEST GHOST TOWN? | VILLAGE of THE DOLLS!