আদর্শ মানুষ কিংবা আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়। তবে এই ‘আদর্শ’ সমাজ কি কখনো ছিল? ইতিহাসে এমন কোন রাষ্ট্র আছে কি যেটিকে স্বর্গের সাথে তুলনা করা যায়?
এখন হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে স্বর্গের বিষয়বস্ত তো এই নশ্বর দুনিয়াতে অসম্ভব। কিন্ত মানুষ যে তবুও এমন এক সমাজ চায় যেখানে থাকবে না কোন অপরাধ, হত্যা, খুন বা রাহাজানি। এই চাওয়া কি স্বর্গতুল্য নয়?
মানুষের এই আদর্শ জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত তার উপর ভিত্তি করেই যে ধারণা সেটিই মূলত ইউটোপিয়া নামে পরিচিত। অর্থাৎ এটি আদর্শ কমনওয়েলথকেই বুঝায় যেখানে মানুষ নির্ভুল এক পরিবেশে থাকবে। আজকের আলোচনা এই ইউটোপিয়াকে নিয়েই।
ইউটোপিয়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে ন্যায়বিচার। বিষয়টি একই হলেও ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব এটিকে অনেকদিক থেকে বিবেচনা করে। তবে, মূল প্রশ্ন তখনই আসে যখন প্রশ্ন করা হয় এই ন্যায়বিচার কি?
কেনই বা একটি আদর্শ সমাজে ন্যায়বিচারই মুখ্য? এসব উত্তর দিতে গিয়ে অনেক সমসাময়িক দার্শনিকগণ বলেই দেন যে আদর্শ সমাজ অসম্ভব। কিন্ত প্লেটো, থমাস ম্যুরের ইউটোপিয়া তো ফেলে দেওয়ার বিষয় নয়; বরং তাদের সেই শত বছর পূর্বের ধারণা বর্তমানেও ন্যায়বিচার কিংবা ন্যায়তত্ত্বকে আলোকিত করে রেখেছে।
প্লেটো
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ঐতিহাসিক কিছু নয়। তিনি সমসাময়িক গ্রিস নগর রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করেই একটি কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরেন। দার্শনিক প্লেটো রাষ্ট্রের গঠনকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।
তিনি বলতে চেয়েছেন যে রাষ্ট্র হলো মানব আত্নার সদৃশ, তাই এই দুটি বিষয়ের সাথে মিল থাকা খুবই স্বাভাবিক। এজন্য তিনি মানুষকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে অভিভাবক শ্রেণি, দ্বিতীয়টি হলো যোদ্ধা শ্রেণি এবং সর্বশেষটি হলো উৎপাদক শ্রেণি।
অভিভাবক শ্রেণিকে তিনি দার্শনিক রাজা বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, দেশের শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য এই শ্রেণির দরকার। এরা যুক্তিবাদী এবং উচ্চতর প্রজ্ঞার অধিকারী। যার ফলে তারা ন্যায়বান হবেন এবং নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিবেন। এদের মূল লক্ষ্যই হলো রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করা।
অপরদিকে, যোদ্ধা শ্রেণি রাষ্ট্রকে বাইরের দুস্কৃতি বা আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এদের নির্দিষ্ট সম্পত্তি ও পরিবার থাকবে না।
সর্বশেষটি হলো উৎপাদক শ্রেণি। এই শ্রেণির ব্যক্তিগণ খাদ্য উৎপাদন করে দেশের নিত্য নৈমিত্তিক চাহিদা মেটাবে।
এই তিন শ্রেণির মাধ্যমে যেন সার্বিক সমৃদ্ধি সম্ভব হয় সেজন্য প্লেটো শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেন। তিনি মনে করতেন যে আত্নার উৎকৃষ্টতার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই।
তিনি শিক্ষার স্তরগুলোকেও তিন ভাগে ভাগ করেন। প্রথমটি প্রাথমিক স্তর, দ্বিতীয়টি উচ্চতর স্তর এবং তৃতীয়টি হলো ন্যায়ধর্ম। প্রথম দু স্তরে পাশকৃত ব্যক্তিগণই কেবলমাত্র দেশের ন্যায়নীতির কাজে অভিষ্ট হবেন। যারা অনুত্তীর্ণ হবেন তারা যোদ্ধা এবং উৎপাদক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবেন।
প্লেটো তার ইউটোপিয়াতে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও ব্যক্তিত্বের ইচ্ছার কথা বলেননি। এজন্য অনেকেই এই মতবাদকে সমালোচনা করেন।
ম্যুরের ইউটোপিয়া
ব্রিটিশ সমাজ দার্শনিক থমাস ম্যুরের ইউটোপিয়া প্লেটোর থেকে একটু ভিন্ন ধরণের। তিনি তার ইউটোপিয়াকে দুই ভাগে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমে তিনি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন যেখানে ন্যায়বিচারের ধারণা একদম নেই বললেই চলে।
উক্ত সমস্যা সমাধানে তিনি একটি কাল্পনিক গল্প বলার মাধ্যমে তার ইউটোপিয়ান ধারণাকে সাজান। ১৫১৬ সালে রচিত তার ইউটোপিয়া গ্রন্থটিতে তিনি একটি দ্বীপ রাষ্ট্রের ধারণা দেন। উক্ত রাষ্ট্রটি একজন রাজা দ্বারা পরিচালিত হয় যেখানে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হোন।
কিন্ত ঠিক একইভাবে প্লেটোর মতোই সেই রাষ্ট্রের সবাই দেশ পরিচালনার অধিকার পান না। উক্ত রাষ্ট্র মূলত এক ধরণের সেক্যুলার রাষ্ট্র। সেখানে নির্দিষ্ট কোন ধর্ম নেই এবং সবারই ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে। থমাস ম্যুরের এই রাষ্ট্রটি বর্তমানের কমিউনিস্ট ধারণার একটি ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন যে একটি ইউটোপিয়ান রাষ্ট্রে ব্যক্তি সম্পদ বা অর্থ থাকবে না।
অপরদিকে তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতিরও সমর্থক বলে ধারণা পাওয়া যায়। কেননা, তার মতে, উক্ত দ্বীপ রাষ্ট্রটি হবে সার্বিক সহায়তাসম্পন্ন ভিত্তিক। সেখানে মানুষজনের মধ্যে ইচ্ছামতো বাণিজ্য তথা পণ্য আদান প্রদান করা যাবে।
রাষ্ট্রটির পরিবার হবে যৌথ পরিবার। সেখানে সবাই একে অন্যের সাহায্য করবেন। এই ইউটোপিয়ান রাজ্যে যুদ্ধের বিরোধীতা করা হয়েছে। তবে নিজ নিরাপত্তা প্রণয়নের জন্য আক্রমণ প্রতিহত করতে যুদ্ধ করা যাবে বলে ম্যুর তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
ফারাবি
আল ফারাবিকে অনেক মুসলিম দার্শনিক রাজনৈতিক দর্শনের জনক বলে আখ্যা দেন। ফারাবি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি ইসলামের আলোকে ইউটোপিয়ার ধারণাকে একদম তাত্ত্বিক ও মৌলিক দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করেন। তার আদর্শ সমাজে মানুষ ন্যায়ভাবে বাস করবেন। তবে বর্তমানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য ফারাবি দুটি নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করেন।
প্রথমত, তিনি বলেন যে বর্তমান শাসকরা অবৈধ। তারা ইসলামের নাম দিয়ে তাদের অবস্থানকে বৈধ করছেন। অর্থাৎ তারা ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে সেটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এছাড়াও শাসকরা এই জড়বাদী দুনিয়াকেই মুখ্য হিসেবে ধরে নেন। ফলে তাদের মধ্যে আধ্যাত্নিকতার কোন চিহ্ন আজকাল পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, ফারাবি বলেন যে এই শাসকদের টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের সমর্থকদের নীতি নৈতিকতার অভাব এই দুনিয়ার সমস্যাগুলোকে আরো কঠোর করছে।
এই সমস্যা উত্তোলনে ফারাবি ইসলামিক ধারায় আত্নশুদ্ধির কথা বলেন। অর্থাৎ এখানে বুঝা যাচ্ছে যে, ফারাবির মতে ইউটোপিয়া হচ্ছে ‘Purification of Soul.’
তিনি রাজনীতিবিদদের একটি শরীরের ঔষধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ যখন দেশের বা সমাজের কোন সমস্যা হবে সেই সমস্যা সমাধানে রাজনীতিবিদগণ কাজ করবেন। এরজন্যই দরকার নিজ আত্নার পরিশুদ্ধতা।
টম্মাসো ক্যামপানেল্লা
সব ধরণের সমস্যা দুটি জিনিস থেকে আসে। এক, নিজস্ব সম্পত্তি এবং দুই, পরিবার। উক্ত কারণগুলো দেখানোর মাধ্যমে ইতালিয়ান দার্শনিক ক্যামপানেল্লা তার অনন্য ইউটোপিয়ার ধারণা দেন। তিনি সার্বিক কল্যাণের কথা বলেন। তার ইউটোপিয়াতে সন্তান জন্ম দেওয়া অতীতের স্মৃতি ছাড়া কিছু নয়।
‘সোলারিয়ামস’ নামক ধারণায় ইউটোপিয়ার নাগরিকগণ একসাথে কাজ করে , একসাথে বসবাস করবে যেখানে পুরোহিত বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রের প্রধান হবেন।
তার গ্রন্থ ‘দি সিটি অব স্যান’ হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বই যেটিকে অনেকেই অধিক একনায়কতন্ত্রী মতবাদ বলে আখ্যা দেন।
রাষ্ট্রটিতে সর্বোচ্চ পুরোহিত হবেন মেটাফিজিকাল অথবা সূর্য এবং তার সহযোগী হবে শক্তি, ভালোবাসা। এখানে সর্বোচ্চ পুরোহিতকে কেউ নির্বাচন করবে না। বিজ্ঞান হবে উক্ত রাষ্ট্রের ধর্ম কেননা রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই হলো বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করা।
এছাড়াও রাষ্ট্রটির নীতি নির্ধারণ হবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার আলোকে। এই নীতি প্রণীত হবে পুরোহিতদের মাধ্যমে যারা প্রতিনিয়ত “তারা” পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সেটির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ও অন্যান্য পরিবর্তন কিভাবে হবে তা জেনে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে কাজ করবেন।
এছাড়াও বার্কের কনসার্ভেটিভ ইউটোপিয়ার মাধ্যমে জানা যায় যে,মানুষের প্রাকৃতিক আইনে চলা উচিত। কারণ মানুষের জীবন খুবই সাধারণ এবং আনন্দময়। তাই অস্তিত্ত্বশীল পৃথিবীর অবস্থা পরিবর্তন মানেই সেটি কৃত্রিমতা। তাই বর্তমানে যা ঘটছে তা মানুষের ইচ্ছার কারণেই হচ্ছে বলেই এটি একধরণের ইউটোপিয়া।
ইউটোপিয়া অর্থাৎ আদর্শ সমাজ গঠনে অনেক মতবাদই দেখা যাচ্ছে। তবে আধুনিককালে ইউটোপিয়াকে অনেকেই ডিস্টোপিয়া হিসেবে আখ্যা দেন। কারণ আদর্শের এই ধারণা বাস্তবায়নে নেতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয় যেমনটা প্লেটো অভিজাততন্ত্রতে কিংবা ম্যুরের ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে ইউটোপিয়ান ধারণা যে পৃথিবীতে অনুপস্থিত তার প্রমাণ বিভিন্ন রাষ্ট্রেই রয়েছে।
তবুও ‘নির্ভুল ইউটোপিয়া কি আসলেই সম্ভব নাকি এটি শুধুমাত্র মানুষের কল্পনাতেই এর অবস্থান?’ উত্তর এখনো অধরাই থেকে যায়।
Feature Image: ishitaa-ashley-medium References: 01. What Is the Ideal World? 5 Utopias Proposed by Famous Philosophers. 02. Taking a Look at the Concept of Utopia in the Political Philosophy of Plato and Farabi. 03. utopia. 04. Plato on utopia. 05. Utopia is a dangerous ideal. 06. Plato’s “Republic” was a totalitarian nightmare.