বছর ঘুরে চলে আসলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। যা ইংরেজিতে “ভ্যালেন্টাইন’স ডে” হিসেবে আমরা চিনি। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে এই দিবস বেশ ঘটা করেই বিশ্ব জুড়ে উদযাপিত হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী একসাথে একটি আনন্দমুখর দিন কাটায় এইদিনে। কিন্তু এইদিনটি কেন এসেছে?
এই দিনটির উৎপত্তির পেছনে লুকিয়ে থাকা করুণ ইতিহাস অনেকেরই অজানা। এছাড়াও উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক ধরনের মতামত রয়েছে। চলুন এক নজরে সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেয়া যাক ভালোবাসা দিবসের পেছনে থাকা অজানা ইতিহাস।
যেভাবে আসলো ভ্যালেন্টাইন’স ডে
কথিত আছে, প্রাচীনকালে রোমান সাম্রাজ্যের রোমান দেব-দেবীর রাণী ছিলেন জুনো। তাকে বলা হতো নারী ও প্রেমের দেবী। তখনকার সময়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি তার সম্মানে ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হতো।
আমরা যে সময়ের সাথে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মিলিয়ে ফেলি, সেই সময় রোমে ভ্যালেন্টাইন বেশ জনপ্রিয় একটি নাম ছিল। আর এই সেইন্টকে নিয়ে এমন প্রায় ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন গল্প রয়েছে। ২০০ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার দেশের যুবকদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন।
তৎকালীন সময়ে তিনি এই ঘোষণা দিয়েছিলেন কারণ তিনি মনে করতেন যে, যুবকেরা যাবে যুদ্ধে। বিয়ে করলে যুবকদের যুদ্ধ যাওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবারের সদস্যদের প্রতি মায়া সৃষ্টি হবে। তখন তারা আর যুদ্ধে যেতে চাইবেনা।
সম্রাট ক্লডিয়াসের অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন ভ্যালেন্টাইন নামের এক যুবক। অসীম সাহসী এই যুবকের প্রতিবাদে সম্রাট ক্ষেপে উঠেছিলেন। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা গর্দান নিয়ে নেয়া হয় তার। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এই দিনটিকে পালন করা হয় ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে।
এছাড়া কেউ কেউ বলেন অন্য একটি ইতিহাস। সেটি হলো, ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় কারণ সে অনেক খ্রিস্টানদের রোমান কারাগার থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন। কারন খ্রিস্টান বন্দীদের উপর অনেক অত্যাচার করা হতো।
ভিন্নমতে আরও একটি ভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। রোমান সম্রাজ্যের তৎকালীন রাজা ক্লডিয়াস ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন নামক একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে তার আগে তাকে কারাগারে বন্দি করে রেখেছিলেন। তখন কারাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত জেলারের মেয়ে রোজ কারাগারে ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসতো।
মেয়েটিকে হলুদ ফুল দিয়ে ভ্যালেন্টাইন সুস্থ করে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়েছিল। মারা যাওয়ার আগে, ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে প্রেমপত্র লিখে এবং নিচে লিখে দেয়- ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)।
ভ্যালেন্টাইন ডে’র উৎপত্তির বিষয়ে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। এই মতের লোকেরা বলেন, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন।
পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন, মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই এইদিনে সঙ্গী নির্বাচন করে।
এছাড়াও কবি চসার ৩৭০ কিংবা ১৩৮০’র দিকে পার্লামেন্ট অব ফাউলস (Parliament of Fowls) নামে একটি কবিতা লেখেন। সেখানে তিনি সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে কথাটির উল্লেখ করেন। সাধারণত, তৎকালীন সময়ে চসার ও অন্যান্য কবি; নাইট ও ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের মধ্যকার ভালোবাসার বর্ণনা করতেন, যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো না।
বেদনাদায়ক ভালোবাসার পরিণতি নিয়েই রচিত হতো তাদের লেখাগুলো। তবে সবাই চতুর্দশ শতকের দিকে চসারের কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ভালোবাসা দিবস নিয়ে লিখতে শুরু করেন। আর সেখানেই একটা সময় যুক্ত হতে থাকেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন।
ভ্যালেন্টাইন’স ডে সেলিব্রেশনের উপায়
ভ্যালেন্টাইন’স ডের সেলিব্রেশনের উপায়গুলো কিন্তু সবসময় একই রকম ছিল না। ঐতিহাসিকবিদ কার্ডেনের মতে, ১৬০০ সালে, ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্টার্ন ইউরোপে, এইদিনে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে প্রেমময় বার্তা প্রেরণ করে থাকত। ১৮০০ সালে এসে কিছুটা পরিবর্তন আসে। ১৮০০ এর শেষের দিকে এই বার্তা প্রেরণের বিষয়টি বাণিজ্যিকিকরণ করা শুরু হয়। প্রিন্ট করে পূর্বেই লিখে রাখা বার্তা বিক্রি করার রেওয়াজ শুরু হয়ে যায়।
মানুষ হাস্যরসাত্মক ভালোবাসার শুভেচ্ছা বার্তা সম্বলিত কার্ড পাঠাতো সেই সময়ে। ভিনেগার কার্ড নামে একধরনের কার্ড অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায় তখন। এই কার্ডগুলো ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে কার্ড কোম্পানিগুলোই তৈরি করছিল। তবে কিছু কিছু কার্ডের বার্তায় অশ্লীলতার মাত্রা এতটাই বেশি থাকতো যে, তৎকালীন ডাকবিভাগ সেই চিঠিগুলো প্রেরণ করতে বিরত থাকতো।
এখন খুব সহজেই সরাসরি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালোবাসার মানুষকে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের অনুভূতিকে। কিন্তু একটা সময় ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না। এছাড়াও সেসময়ে ইউরোপের সমাজও বেশ রক্ষণশীল ছিল। ফলে, ছেলে মেয়ে সহজে মিশতে পারতো না, কথা বলতে পারতোনা। তাই ছেলেরা কোন মেয়েকে পছন্দ করলে এক ধরনের কার্ড পাঠাতো। যা “এসকর্ট কার্ড বা ফ্লার্ট কার্ড” হিসেবে পরিচিত ছিল।
যেটাকে সেই সময়ের ছেলেরা ভালোবাসার আহ্বান জানানোর উপায় বলেই বেছে নিত। এই কার্ডগুলোতে ছোট্ট করে নিজেদের মনের কথা লিখে মেয়েদের হাতে পৌঁছে দিত তারা। আর মেয়েরা সেটাকে লুকিয়ে দেখে সম্ভব হলে উত্তরটাও দিয়ে দিতো।
বিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে এই দিনে উপহার হিসেবে ক্যান্ডি, ফুল এবং রোমান্টিক বার্তা সম্বলিত কার্ড উপহার হিসেবে দেয়া শুরু করে এবং প্রেমিক প্রেমিকারা রোমান্টিক ডিনারে যাওয়া শুরু করে।
ভালোবাসা দিবসের মাস্কট
ভালোবাসার সাথে কিউপিড ওতপ্রেতভাবে জড়িত যা একজন গ্রীক দেবতা। প্রাচীন গ্রীক মাইথোলোজি অনুযায়ী, কিউপিড হলো ভালোবাসার দেবতা। কিউপিড হলো ভ্যালেন্টাইন’স ডের মাস্কট। এটি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ইরোস নামে পরিচিত ছিলেন এই দেবতা। গ্রীক দেবী আফ্রোদিতির ছেলে।
আফ্রোদিতি নিজের সন্তানকে দুটি তীর দিয়েছিলেন, যার একটি ছিলো ভালোবাসার প্রতীক, অন্যটি ঘৃণার। মাইথোলোজি অনুযায়ী ভালোবাসার তীর দ্বারা বিদ্ধ হলে আপনি কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভালোবাসায় পড়বেন। তবে কিউপিডকে তার মা আফ্রোদিতি তীর দিয়েছিলেন মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতে।
এই ছিলো ভালোবাসা দিবসের কিছু অজানা ইতিহাস। এইদিন প্রত্যেকে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কাটায় একান্ত কিছু সময় এবং দেয় হরেকরকমের উপহার। এবারের ভ্যালেন্টাইন’স ডেও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারের ভ্যালেন্টাইন’স ডেও আনন্দে কাটুক, সম্পর্কের বন্ধনকে করুক চির অটুট।
ফিচার ইমেজঃ Pixabay.com
তথ্যসূত্রঃ
01. History-of-valentines-day.
02. Valentines-day-facts-history.
03. Valentines-Day.
04. History-of-valentines-day.