চেনা পৃথিবীর অচেনা স্থান

598
0

এমন অনেক মানুষই আছে যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। যাদের পৃথিবীর দূর্গম সব পথে যাবার এক অদম্য নেশা আছে৷ তারা ভ্রমণকে রোমাঞ্চকর করে তুলতে জানা-অজানা, অস্বাভাবিক ও রহস্যময় জায়গাগুলো খুঁজে বেড়ান। এই নিবন্ধে বিশ্বের ১০টি  অস্বাভাবিক ও অজানা স্থান সম্পর্কে আলোচনা হবে।

এই স্থানগুলো প্রতিটি ভ্রমণকারীর কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। কারণ এই অজানা স্থানগুলো একদিকে যেমন অদ্ভুত, অন্যদিকে সৌন্দর্য এবং মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি দ্বারা চিহ্নিত। যেখানে পৌঁছাতে একজন ভ্রমণকারীর জন্য সারা জীবনের দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্যে একটি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।  

তবে যত কষ্টই হোক না কেন ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই সকল স্থানে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু নয়। চলুন সেই চেনা পৃথিবীর অচেনা স্থানগুলো এক নজরে দেখে নিই: 

 ১. রেইনবো মাউন্টেন, চীন 

তালিকার প্রথমেই রয়েছে উত্তর-পশ্চিম চীনের অত্যাশ্চর্য এই রেইনবো মাউন্টেন। এই পর্বত গানসু প্রদেশের ঝাংগিয়ে ডায়েনশিয়া জিওপার্কের মধ্যে অবস্থিত। রেইনবো মাউন্টেন এর চোখ ধাঁধানো রঙ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। রংধনুর রঙে রঙিন এই পর্বতমালার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দৃশ্য হলো দেখার সময় রঙগুলি আকর্ষণীয় এবং কয়েকটি রুপে ধরা দেয়। 

যা একইসঙ্গে দৃষ্টিবিভ্রম ও আশ্চর্যজনক। যদিও এই স্থানটি পর্যটকদের কাছে কম জনপ্রিয়। তবে এলাকাটির নিজস্ব এক আকর্ষণ রয়েছে। এছাড়াও, এখানে লম্বা কলাম এবং পাথরের স্তম্ভের মতো আকর্ষণীয় ল্যান্ডফর্মের বৈচিত্র্য পাওয়া যায়।  

রেইনবো মাউন্টেনের অদ্ভুত সৌন্দর্য। Image Source: forbes.com

এই রেইনবো পর্বতের ভূতাত্ত্বিক গঠনগুলি বেলে পাথর এবং খনিজগুলির রঙিন স্তর দ্বারা গঠিত। ২৪ মিলিয়ন বছরেরও বেশি পুরানো এই পর্বতমালা। প্রাকৃতিক কারণে প্রায় ৫,০০,০০০ বছরে ডানশিয়ার জমিগুলিকে খোদাই করে এই পর্বত তৈরি হয়েছে। যার ফলে প্রতি ১০,০০০ বছরে এর গড় উচ্চতা ০.৮৭ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। লাল বেলে পাথর দিয়ে গঠিত পর্বতটি ভ্রমণকারীকে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের স্বাদ দেবে। 

২. হিনাতুয়ান নদী, ফিলিপাইন 

ফিলিপাইন শহরের বাইরে অসাধারণ মন্ত্রমুগ্ধ মোহনীয় নদীটি হলো হিনাতুয়ান। ফিলিপাইনের জঙ্গলে লুকানো ছোট প্রসারিত নদীটির পানি অলৌকিকভাবে স্বচ্ছ ও নীলাভ। এটি এমন একটি নিশ্ছিদ্র নোনা জলের নদী যা প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাহিত হয়। প্রায় ৮০-ফুট গভীর এবং একটি নদী হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য নামমাত্র দীর্ঘ; তবুও এর প্রবাহটি সারা বিশ্বের দর্শকদের আকর্ষণ করে।  

হিনাতুয়ান নদী। Image Source: travel.earth

আপনি যদি শীতল, সুন্দর জলের অভিজ্ঞতা নিতে চান আপনার জন্য এই স্থানটি অবিশ্বাস্যভাবে লোভনীয়। এর স্ফটিক জলের রঙের ছায়া রয়েছে যা নীল থেকে সবুজে পরিবর্তিত হয়। বহুকাল থেকে স্থানীয়রা নদীটিকে অলৌকিক বলে মনে করেন। 

হিনাতুয়ান নদীর রহস্যময় প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার জন্য অনেক স্থানীয় কিংবদন্তিরা গবেষণা করছেন। তবে এই নদীর রহস্য আজ পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি। 

৩. আইসোলা বেলা বাগান এবং প্রাসাদ, ইতালি

আইসোলা বেলা বাগান এবং প্রাসাদ উত্তর ইতালিতে অবস্থিত। এটি এমন একটি অত্যাশ্চর্য সুন্দর দ্বীপ যা অমূল্য শিল্পকর্ম দ্বারা অলংকৃত করা হয়েছে। জাঁকজমকপূর্ন এই জায়গাটিতে সুন্দর ঝুলন্ত ট্যাপেস্ট্রি ভাস্কর্য রয়েছে; যা প্রাচীন সাম্রাজ্যের নিদর্শন বহন করে। চারদিকে বাগানের ফুলের গন্ধে বৈচিত্র্যসহ স্বর্গীয় অনুভূতি প্রকাশ পায়।    

আইসোলা বেলা প্রাসাদ। Image Source: wikimedia.commons

আইসোলা বেলা বাগানটি বেশিরভাগ দর্শকই আকৃষ্ট হোন মূর্তি, বিরল গাছপালা এবং ঝোপঝাড় দেখে। এমনকি উদ্যানের শান্তি এবং নির্মলতা দেখতেও এই বাগানে একবার হলেও আসতে হবে। 

স্ট্রেসার উপকূল থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপগুলির একটিতে এর অবস্থান। তবে দ্বীপটি এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ যা মানুষের হস্তক্ষেপে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। 

৪. হোয়াইটহেভেন বিচ, অষ্ট্র্বেলিয়া 

হোয়াইটহেভেন বিচ বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারীদের আগ্রহের তালিকায় রয়েছে। এখানে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন।এখানে আইকনিক খাঁটি সাদা বালি রয়েছে; যা শুধু হোয়াইটহেভেন সৈকতেই পাওয়া যায় এবং আশেপাশের জায়গাগুলোতেই কেবল দেখা যায়। হোয়াইট হেভেন বিচ মূলত রেশমি মসৃণ সাদা বালি এবং স্ফটিক স্বচ্ছ ফিরোজা জলের জন্য বিখ্যাত। 

হোয়াইটহেভেন সৈকত। Image Source: traveldiary.com

হোয়াইটহেভেন বিচের বালি ৯৮.৯% খাঁটি সিলিকা থেকে তৈরি। আর এই সিলিকাই বালিকে তার অনন্য সাদা রঙ এবং বিশেষভাবে সূক্ষ্ম গুঁড়ো দানা করে দেয় প্রাকৃতিক উপায়ে। তবে মনে রাখবেন, বালি আসলে এতই সূক্ষ্ম যে এটি সহজেই যেকোনো কিছুতে প্রবেশ করতে পারে এবং ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের ক্ষতি করতে পারে। 

৫. হুয়াকাসিনা মরুভূমি, পেরু

হুয়াকাসিনা মরুভূমির অবস্থান হলো পেরুতে। এই অজানা স্থানটি আশ্চর্যজনকভাবে পর্যটকদের কাছে দিন দিন আগ্রহের তালিকায় যোগ দিচ্ছে। মরুভূমিতে প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করেও কিন্তু প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এখানে অন্যরকম পরিবেশ রয়েছে। 

হুয়াকাসিনা মরুভূমি। Image Source: peru.travel

পেরুর দক্ষিণ-পশ্চিমে হুয়াকাসিনা মরুভূমিতে যাওয়ার সময় এই স্থানের সন্ধান পাওয়া যায়। ছোট্ট কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় পুরোটাই বিশাল বালির টিলা দ্বারা বেষ্টিত। তবে, হুয়াকাসিনা চমৎকার টিলা বগি এবং স্যান্ডবোর্ডিং ট্যুরের জন্যও বিখ্যাত। 

৬. আইস কেইভ, চিলি

বিশ্বের যেকোনো জায়গার চেয়ে সবচেয়ে দর্শনীয় হলো আইস কেইভ গুহা। এই গুহাটি চিলির প্যাটাগোনিয়ায় অবস্থিত যার সবচেয়ে সুন্দর আইস কেইভ মার্বেল গুহা যা কুয়েভাস দে মারমল নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছরের পুরানো অত্যাশ্চর্য গুহা নেটওয়ার্কটি উপদ্বীপে অবস্থিত। এই গুহাটি সম্পূর্ণ মার্বেল দিয়ে গঠিত যা চিলি এবং আর্জেন্টিনার সীমান্তে হিমবাহ লেক জেনারেল ক্যারেরার গভীর নীল জলে ভেসে আসে।   

আইস কেইভ গুহা। Image Source: insider.com

এই অসম্ভব সুন্দর বরফ গুহা হাজার হাজার বছর ধরে জলের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। এই গুহা নেটওয়ার্ক অবাস্তব গঠনের কারণে মার্বেল গুহা নামেও পরিচিত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি হ্রদের জল থেকে প্রতিবিম্বিত আলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রতিফলন তৈরি করে। 

৭. রাশিয়ান ডেথ সিটি, রাশিয়া 

বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাভাবিক জায়গাগুলির কথা আসলে রাশিয়ান ডেথ সিটি অন্যতম। রাশিয়ানদের কাছে এই শহর মৃত্যুর শহর বা দারগাভস শহর নামে পরিচিত। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এটি রাশিয়ার একটি পাহাড়ের অভ্যন্তরে নির্মিত একটি ছোট গ্রাম। যেখানে আপনাকে পৌছাতে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া এবং সরু এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ধরে ৩ ঘন্টা হেঁটে যেতে হবে। গ্রামটির বৈশিষ্ট্য হলো, গ্রামের সমস্ত উচ্চ ভবনগুলি একটি কবরের ভিতরে সমাধির মতো, যা দেখতে ছোট ছোট সাদা দালানের একটি বড় দালান দিয়ে আচ্ছাদিত। 

রাশিয়ান ডেথ সিটি। Image Source: rbth.com

গ্রামটিকে মৃত্যুর শহর নামকরণের কারণ রয়েছে। কারণ এর ভবনগুলিতে কফিনের মতো একটি ছাদ রয়েছে যেখানে শহরের বাসিন্দারা তাদের প্রিয়জন এবং তাদের আত্মীয়দের কবর দেয়। এমনকি মৃতের সংখ্যা যত বেশি হবে, তার গম্বুজ তত বেশি হবে। ১৬ শতকের পর থেকে, এটি নিয়মে দাঁড়িয়েছে যে প্রতিটি জীবিত ব্যক্তির অবশ্যই তার নিজস্ব সমাধি থাকতে হবে। 

গ্রামটি একসময় শহরের জন্য কবরস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো, তাই যদি একজন ব্যক্তি তার সমস্ত আত্মীয়কে হারায় তবে তাকে তার বাকি জীবন কাটাতে মৃত্যুর শহরে এবং সেখানে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। 

৮. ভ্যাগামন, কেরালা, ভারত

ভ্যাগামন কেরালার হলো একটি নির্মল এবং শান্তিপূর্ণ স্থান। যারা শহরের জীবন থেকে অবকাশ পেতে চান তাদের জন্য আদর্শ। কেরালার ভ্যাগামন শক্তিশালী একটি অঞ্চল। এখানের জলবায়ু মনোরম এবং দেখার মতো অনেক আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন-চা বাগান, সবুজ তৃণভূমি এবং শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য যেখানে পাহাড়-এর উপর কুয়াশা ভেসে বেড়ায়।    

ভ্যাগামনের সৌন্দর্য। Image Source: housing.com

যারা দুঃসাহসিক ভ্রমণ পছন্দ করেন তাদের জন্য ট্রেকিং এবং পর্বতারোহণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বন্যপ্রাণী, অভয়ারণ্য এবং নানান প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণী দেখতে পাওয়া যায় এখানে। এটি এমন এক স্থান যা অবশ্যই আপনাকে প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন ঘটাবে। ভ্যাগামন-এ রয়েছে পাহাড় এবং পর্বতমালা, পাইন বন । এছাড়াও, অসম্ভব সুন্দর জলপ্রপাত দ্বারা বেষ্টিত। 

৯. মাচু পিচু, পেরু

মাচু পিচু শহরটি মূলত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮০ মিটার এবং দুটি মহাসাগরের ধারে ৬০০ মিটার দীর্ঘ ঢাল ঘেরা ঘন বনে ঢাকা।পুরো শহরটি বড় পাথর দিয়ে তৈরি। এখানে একে কোনো ইনস্টলেশন যেমন সরঞ্জাম ছাড়াই আচ্ছাদিত করা যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাভাবিক জায়গাগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। এমনকি মাচু পিচুর কিছু শহর ধর্মীয় অনেক মন্দির ও উপাসনালয়ের জন্য বিখ্যাত।  

পাহাড়ের উপর মাচু পিচু। Image Source: pexel.com

প্রাচীনকাল থেকে লোকেরা ১৫ শতকে মাচু পিচু শহরটি আন্দিজের দুটি পাহাড়ের মধ্যে তৈরি করেছিল। এছাড়াও এই শহর  ঝুলন্ত বাগানের জন্য পরিচিত। কারণ এটি একটি খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত। এখানে পার্ক, গ্যালারি, ভবন এবং প্রাসাদ, সেইসাথে খাল, সেচ চ্যানেল এবং স্নানের পুল রয়েছে। বাগান এবং বিভিন্ন রাস্তা একে অপরের সাথে পাথরের সিঁড়ি দ্বারা সংযুক্ত।

১০. হিটাচি সীসাইড পার্ক, জাপান

হিটাচি সীসাইড পার্ক জাপানের উপকূলের প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে অবস্থিত। জাপান প্রাকৃতিক সম্পদের একটি বিস্ময়কর দেশ। এখানে আপনি বালির টিলা, বন এবং স্থানীয় তৃণভূমির পাশাপাশি উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবন সমৃদ্ধ অঞ্চলটি খুঁজে পাবেন। এছাড়াও, বিনোদনের জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে কারণ এখানে একটি বিনোদন পার্ক, সাইক্লিং এরিয়া এবং বারবিকিউ পার্টির  সুবিধা রয়েছে।   

হিটাচি সীসাইড পার্ক এবং মাউন্ট ফুজি। Image Source: japan.travel

এই পার্কে রয়েছে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বিশাল বৈচিত্র্যের ভান্ডার। বিশেষ করে ফুলের গাছগুলি সুগন্ধ ছড়ায় যা প্রকৃতিপ্রেমীদের  মুগ্ধ করে রাখে। যারা ফুলের সুগন্ধ এবং গাছপালা পছন্দ করেন তাদের জন্য এই স্থান উপভোগ্য হবে। পার্কের ভেতরে টিউলিপ, পপি, গোলাপ, লিলি, ডেইজি এবং ল্যাভেন্ডার ও প্রাকৃতিক ঝর্ণাও রয়েছে যা পার্কের পরিবেশকে আর অন্য রকম মাত্রা যোগ করে। 

 

Features Image: pixabay.com 
References: 

01. 36 unknown places in the world that will take your breath away. 
02. unfamiliar tourism destination the most unusual places in the world. 
03. amazing unknown places