বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রমজান নিয়ে যত ঐতিহ্য

241
0

এসে গেলো আরো একবার রমজান মাস। পবিত্র এই মাস নিয়ে সারা বছরই মুসলিমদের থাকে একটানা কৌতূহল এবং উত্তেজনা। নামাজ, তারাবিহ, ইফতার এসব মিলে যেন উৎসবের মতো হয়ে উঠে এই মাসটি। দেশ-বিদেশের নানান দেশে চলে নানান কার্যক্রম।

শাবান মাস যেতেই যেন শুরু হয় এই উৎসবমুখর দিনগুলো। রমজানে রোজা থাকাটা সবার কাছে এক হলেও এর রয়েছে বেশকিছু ঐতিহ্যও। একেক দেশের একেক ঐতিহ্য এই রমজান মাসকে করেছে আরো আবেগপ্রবণ। ভিন্ন ভিন্ন দেশে পালিত হয়ে থাকে এই মাসটি। আর তাই এর ঐতিহ্যেও রয়েছে বেশ ভিন্নতা।

পৃথিবীর বুকে রমজানের ভিন্নতা একেক দেশের, আর আজ জানবো সেসব দেশের ঐতিহ্যের কথা যা হাজারো বছর ধরে লালন করে আসছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন মানুষেরা।

মিশরের ঐতিহ্যে রমজান

সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এসব নিয়েই যেন জন্মেছে মিশর। আর এই ঐতিহ্যের দেশে রমজান মাস পালিত হয় একটু বেশীই জাঁকজমকভাবে। বিভিন্ন দোকানপাটসহ ঘরবাড়িতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখা হয়, এতে যেমন সৌন্দর্য বাড়ে তেমনই জানান দেয় রমজান মাসের আনন্দকে।

মিশরের রমজান। Image Source: Pinterest.com

এছাড়া রয়েছে ফানুস, যা আকাশকে এক মনোরম করে তুলতে সাহায্য করে। মিশরের এই ঐতিহ্য হাজার হাজার বছরের পুরোনো। ইফতারের আয়োজনেও কোন কমতি নেই। হরেক রকমের খাবার, পানীয় সহ খাবার টেবিল সাজিয়ে ফুটে উঠে।

পুরো রমজান মাস জুড়ে যে আলো বয়ে বেড়ায় এরা, এমন আলোকিত দেশ রমজানে পুরো পৃথিবীতে অন্য কোন দেশে খুব কমই দেখা যায়। রমজান মাস তাই মিশরের বুকে নিয়ে আসে এক অনন্য প্রশান্তি।

বাহারি ইফতারের দেশ পাকিস্তান

রমজান মাস আসবে আর বাহারি ইফতারের আয়োজন করবে না, এটা ভাবা অসম্ভব প্রায়। আর সেই অসম্ভবের দেশই হচ্ছে পাকিস্তান। রমজান মাসের এই ইফতারের আয়োজন চলছে প্রায় যুগ যুগ ধরে। এ যেন এক বিশাল আয়োজন! পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবের সাথে একসাথে মিলে উপভোগ করা হয় এই ইফতার।

বাহারি ইফতারে পাকিস্তান। Image Source: Pinterest.com

খাবারের মেনুতে থাকে তাই মুখরোচক বিভিন্ন খাদ্য, যেমন: ফ্রুট সালাদ, বিভিন্ন কাবাব, পাকোড়া, ছোলা, বুট, ভেজিটেবল রোলসহ নানান খাবার।

হরেক রকমের খাদ্যে তাদের টেবিল ভরে থাকে, আর এই রমজান মাসের ইফতারের টেবিলই যেন পাকিস্তানের এক অনন্য ঐতিহ্য, যা বয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই।

সেহরির এক অনন্য উদাহরণ তুরস্ক

কমবেশি সব দেশেই সেহরিতে উঠার জন্য একেক পদ্ধতি পালন করে আসছেন। কেউবা মাইকে ডেকে তুলছেন, কেউবা ডাকছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। তবে তুরস্কে সেহরিতে ডেকে দেয়ার জন্য এক অনন্য দৃশ্য দেখা যায় যা যে কারো চোখ কপালে তুলতে যথেষ্ট!

তারা কেবল মাইকে নয়, বরং এই মাসটিতে সবাইকে জাগ্রত করতে ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসবের ন্যায় সবাইকে জানান দিচ্ছেন এখন উঠতে হবে!

তুরস্কে ইফতারের আয়োজন। Image Source: Pinterest.com

রমজান মাস এলেই এই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তোপধ্বনির সাহায্যে জানান দেয়া হয় রমজান মাসের শুভেচ্ছা। এই সময় মসজিদগুলোতে জ্বালানো হয় ‘কানদিল’ নামের বাতি।

তুরস্কের ইফতারে থাকে হরেক রকমের আয়োজন। এরা জলপাই ও পনিরের পেস্ট্রি, কেকসহ খেজুর, গরুর মাংসের পেস্তারমাসহ তাদের বানানো তুর্কি রুটির আয়োজন করে থাকে।

রমজানের ঐতিহ্য পালনে সোচ্চার দেশ মরক্কো 

মরক্কো আফ্রিকার একটি দেশ, যেখানে রমজান মাস আসার ২-৩ সপ্তাহ পূর্বেই এর আয়োজন চলতে থাকে। শুধুমাত্র রমজান মাসকে ঘিরেই এরা এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাড়ি নতুন করে রং করা, দোকানপাট সব নতুন করে সাজানো, বাড়ির আশেপাশে, রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার করে তবেই এরা রমজানের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে তুলে ধরে। ইফতারের ক্ষেত্রে মরক্কোবাসীরা একটু ভোজনবিলাসীই।

মরক্কোর ইফতারের আয়োজন। Image Source: Pinterest.com

এরা দীর্ঘ সময় ধরে ইফতার করে। এদের ইফতারে থাকে মরক্কের নানান ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন: রিজ্জা, ক্রাচেল, স্টিলা, হারশা ইত্যাদি। মরক্কোতে সেহরিতে জাগিয়ে দেয়ার জন্য নাফর নির্বাচন করে রাখা হয় এবং পরে এদের পুরষ্কৃতও করা হয়। এরা সেহরিতে নানান গলায় সুরেলা ভঙ্গিতে গজল গেয়ে সবাইকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

অন্যতম মুসলিম দেশ ফিলিস্তিনে রমজানের ঐতিহ্য

বর্তমানে নির্যাতিত দেশ হিসেবে পরিচিত এই দেশের রমজান মাসের ঐতিহ্য ভিন্ন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি মুসলিম দেশের মধ্যে বৃহত্তম দেশ হিসেবে বেশ এগিয়ে আছে। ফিলিস্তিনিরা বরাবরই মেহমানদারিতে পটু, আর রমজান মাসে যেন তাদের এই মেহমানদারি হাজার অংশে বেড়ে যায়। প্রতিবেশী থেকে শুরু করে মেহমান নিয়ে ইফতারের আয়োজন করে থাকে তারা।

চলে সারামাস একেক আয়োজন। তারা বেশীরভাগ সময়ই মেহমান বা প্রতিবেশীদের সাথে রমজান মাস পালন করতে পছন্দ করে থাকেন। এই মাসে চলে কার আগে কে দরিদ্রদের খাবার বিলিয়ে অশেষ নেকি হাসিল করবে। আর তাই দরিদ্রদের জন্যেও এই মাসটি কাটে বেশ শান্তিতে।

ফিলিস্তিনির ইফতারের আয়োজন। Image Source: Pinterest.com

ফিলিস্তিনির প্রাচীন শহর জেরুজালেমে গভীর রাতে ড্রাম বাজিয়ে সেখানকার ছেলেমেয়েরা সবাইকে সেহরিতে ডাকার রীতি অনুসরণ করে আসছেন, যা তাদের অন্যতম ঐতিহ্য। এরা সাধারণত পনির এবং তামারুন জুস খেতে পছন্দ করেন এই রমজান মাসে।

মালদ্বীপ

মুসলিম দেশ হিসেবে মালদ্বীপ তাদের রমজান ভিন্নধর্মী উপায়ে প্রতিবার রমজান পালন করে থাকে। মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত। এদেশে রমজান মাস নিয়ে চলে পুরো একমাস নানান আনুষ্ঠানিকতা আর ঐতিহ্যের সমারোহে কাটে প্রতিটি রোজা।

এদের ঐতিহ্যে ইফতারের খাবারের মেন্যুকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকে। মাছ এবং ময়দা দিয়ে বানানো এক ভিন্নধর্মী কেকের আয়োজন করা হয় এদেশে যার নাম কুলহি বোয়াকিবা এবং ফোনিবোয়াকিবা।

মালদ্বীপের ইফতার আয়োজন। Image Source: Pinterest.com

এছাড়া এরা গুলহা নামের মাছের কোফতাও আয়োজন করে থাকে। এদের প্রধান ঐতিহ্য হচ্ছে এরা ইফতারের সময় এদেশের কবিরা রাইভারু নামের এক কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন।

এই কবিতাগুলো সাধারণত রমজানকে ঘিরেই লেখা হয়ে থাকে এবং এগুলো বড়জোর ২-৩ লাইনের হয়ে থাকে। কবিতা আবৃত্তি অনেক পুরোনো ঐতিহ্য মালদ্বীপের। এবং এই ঐতিহ্য এখনো বহাল আছে দক্ষিণ এশিয়ার এই ক্ষূদ্র দেশটিতে।

মুসলিম দেশ আরব আমিরাতে রমজানের বিশেষ ঐতিহ্য

অন্যান্য দেশের চেয়ে আরব আমিরাতে রমজানকে ঘিরে শুরু হয় এক আনন্দ উৎসব। বেশ ঘটা করেই বরণ করে নেয়া হয় এই পবিত্র মাসকে। এই মাসে শিশুদের নিয়ে আয়োজন করা হয় হক আল লায়লা নামের এক আগমনী অনুষ্ঠান।

এই আয়োজনে দেখা যায় শাবান মাসের ১৫ তারিখ নাগাদ একদল শিশু পরিষ্কার জামাকাপড় পরিধান করে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়াঘাত করে এবং বলে,

আমাদের দাও, আল্লাহ তোমাদের দিবেন!

আর এই আয়োজনে এরা মিষ্টি, বাদাম এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে যা আরবের ভাষায় খরিতা নামে পরিচিত।

আরবের ইফতার আয়োজন। Image Source: Pinterest.com

এরা রমজান মাস এলেই বিভিন্ন খাবারেদ সমাগমে ইফতারের টেবিল পরিপূর্ণ রাখতে পছন্দ করেন। তালিকায় তাই থাকে বেশ ভারী এবং মুখরোচক খাবার। দুবাইয়ে সাধারণত ইফতারে ভেড়ার মাংস, মসুর ডাল দিয়ে এক প্রকার স্যুপ তৈরী করে থাকে। যা ইফতারে বেশ ঐতিহ্যপূর্ণ খাবার হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে। এছাড়া ভেড়ার মাংস, চিজ দিয়ে পেস্ট্রি, মিষ্টি সহ আরো বেশ কিছু খাবার এদের ইফতারের প্লেটে সাজানো থাকে।

রমজান মাস জুড়েই চলতে থাকে দেশ-বিদেশে এমন অদ্ভুত এবং নানান আয়োজন। খোশ আমদেদ মাহে রমজান, এই শব্দটি যেনো পুরো বিশ্ববাসীকে আরো আবেগপ্রবণ এবং চমৎকার এক অনুভূতি নিয়ে আসে সবার দরজায়। এই পবিত্র দিন পালনে দেশ বিভূইয়ে যেমনই কাটুক না কেন, সবার মনে একটাই আশা, জীবনের পূর্বের সকল পাপ যেনো মুছে যায়।

আর এই পবিত্র মাস যেন সবার জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসে। প্রতিটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য থাকলেও ইফতার আর সেহরির যেনো একই আকাঙ্ক্ষা! নিজেদের তাই পবিত্র করে তুলতে প্রতিটি দেশের যে আয়োজন করা হয়, উৎসবমুখর হয়ে উঠে যে বিশ্ব, সে বিশ্বের সকলের মঙ্গল কামনায় প্রতিটি মানুষ পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক।

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. Ramadan Traditions Around the World. 
02. Ramadan Traditions Around the World.