সুখ এমন একটা জিনিস, যা ছোঁয়া যায় না কিন্তু এর অনুভূতি স্বর্গসম! অনেকেই অর্থের দ্বারা সুখী হতে চান, অনেকে চান নিজের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। সুখ একেক দেশে একেকভাবে প্রকাশ হয়ে থাকে। অনেক সময় দেশের উপর ভিত্তি করেও সুখ বহাল হয়ে থাকে।
সম্প্রতি বিশ্ব সুখী দেশ নামক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যেখানে মোট ১০টি দেশ সকল সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে আছে। এটি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের এসডিএসএন নামক এক শাখা। প্রতি ২০ মার্চ সুখ দিবস পালন করে আসছে এই সংস্থাটি।
সাধারণত একটি দেশের সামাজিকতা, জীবনধারা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, রাজনৈতিক অবস্থান, দুর্নীতি, আর্থিক অবস্থান, শিষ্টাচার, দেশটির জিডিপি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকা ১০টি দেশের নানান জানা-অজানা গল্প নিয়েই আজকের আয়োজন।
ফিনল্যান্ড
অন্যান্য দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ড বরাবরই সুখী দেশের তালিকায় সবার উপরে থাকে। ৭.৭ মাত্রা নিয়ে এবারো তাই নিজেদের সুখী দেশ হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে স্কান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড। এই দেশ গতবছর শীর্ষে থাকলেও জানা যায় ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে তারা পিছিয়ে ছিল, অবস্থান ছিল ৫ এ! টানা চার বছর ধরে এই দেশটি সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে থাকার পেছনের মূল কারণটি জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিজেই!
সানা অর্থাৎ দেশটির প্রধানমন্ত্রী তেমন একটা গণমাধ্যমের সামনে না এলেও তার দেশের এই অর্জনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। সানা মারিন জানান ফিনল্যান্ডের আর্থিক অবস্থা দেশটির সুখী হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল। এছাড়া এদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শক্তিশালী রাষ্ট্র, উন্নত সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি এই দেশকে সুখী দেশ হিসেবে আবারো সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
ডেনমার্ক
সুখী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ডেনমার্ক। ৭.৬ মাত্রা নিয়ে দেশটি এগিয়ে আছে অন্যান্য সুখী দেশ থেকে। ডেনমার্ক অন্যান্য দেশ থেকে সুখী। কেননা এই দেশের নানান কারণ পিছনে ফেলে সবার আগে উল্লেখ করেছেন তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিকটি বিবেচনা করে।
এই দেশের নাগরিকেরা স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার দরুণ স্বাস্থ্য অধিকার এবং শিক্ষা নিয়েও গুনতে হয় না কোন অর্থ! আশ্চর্য হলেও এটিই সত্য এবং ঠিক এই কারণেই নিজেদের সুখী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে দেখতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
সুইজারল্যান্ড
চমৎকার পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার রহস্যে ঘেরা দেশ সুইজারল্যান্ড। সুখী দেশ হিসেবে এবার অর্জন করে নিয়েছে তাদের স্থান। তবে প্রতি বছর নেদারল্যান্ডসের আগে থাকলেও এবার এক ধাপ পিছিয়ে আছে দেশটি। ২০১৫ সাল নাগাদ তালিকার শীর্ষে থাকলেও এবার বেশ কিছুটা পিছিয়েই আছে সুইসরা। অন্যান্য দেশ থেকে এই দেশটি সুখী হওয়ার পেছনে কিন্তু রয়েছে বেশ কিছু কার্যাবলি, সুইসরা এসব জানান জাতিসংঘকে।
জানা যায় এদেশের নাগরিকেরা তাদের জীবনযাত্রার মান বেশ উচ্চতর। এছাড়া এদেশের শিল্পমান, সাহিত্য, সিনেমা সবকিছুই বেশ উন্নত। দেশটির আল্পাইন পর্বতটি তাদের সুখী হওয়াকে আরও এক ধাপ এগিয়ে রেখেছে। শিক্ষার মান, স্বাস্থ্য ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করায় এদেশের নাগরিকেরা নিজেদের বেশ নিরাপদ মনে করেন যা তাদের সুখী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আইসল্যান্ড
৭.৪ মাত্রা নিয়ে বর্তমানে চতুর্থ স্থানে আছে আইসল্যান্ড। জানা যায়, দেশটি ২০১৮ সালে এই একই স্থানে ছিল। আইরিশরা বরাবরই সুখী হিসেবে দাবী করে এসেছেন। নিজেদের মধ্যে নেই কোন শ্রেণিভেদ, আর তাই নিজেদের মধ্যে এক অদ্ভুত চমৎকার মিশে থাকার দারুণ উদাহরণ দেখা যায়।
এছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে নেই কোন গোঁড়ামি, আর তাই শান্তিপূর্ণভাবে যে যার ধর্ম পালনে ব্যস্ত থাকে এরা। এদেশের অন্যতম শান্তির দিক হচ্ছে এখানে নেই কোন লিঙ্গ বৈষম্য। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই বলেই এখানে সকল মানুষ নিজেদের সুখী বলে গর্ববোধ করেন। দেশের সরকারের যথেষ্ট সচেতনতা, নিজেদের মধ্যে আপোষ ইত্যাদির কারণে এখানে নেই কোন সেনাবাহিনী বা পুলিশের প্রয়োজনীয়তা।
নেদারল্যান্ডস
প্রতিবছর সুখী দেশ হিসেবে পিছিয়ে থাকলেও এবার এক ধাপ এগিয়ে এসেছে নেদারল্যান্ডস। ৭.৪ মাত্রা নিয়ে এরা এবার স্থান করেছে পঞ্চম। নেদারল্যান্ডসকে সুখী দেশ হিসেবে বাছাই করার অন্যতম কারণ হচ্ছে এখানে শিশুদের মূল্যায়ন করা। অর্থাৎ সকল শিশুদের একই চোখে দেখা, এদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া ইত্যাদির কারণেই দেশটি অনেকাংশে সুখী দেশ হিসেবে স্থান লাভ করেছে।
এছারা এই দেশের উচ্চ আয়, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক সুস্থতা ইত্যাদি যাচাই করেই একে সুখী দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাছাড়া আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা, আবাসন ইত্যাদির উপর আরোপ করে নেদারল্যান্ডস এবার ষষ্ঠ স্থান লাভ করেছে বলে জানান জাতিসংঘ।
নরওয়ে
নিশীথ সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত এই দেশটি তৃতীয় অবস্থানে আছে। যদিও গতবছর এই দেশটি দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল, তবুও সুখী দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি এই দেশটি। এই দেশটি সুখী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে জানা যায় এই দেশের আর্থিক অবস্থান, এদের শিল্প, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দুর্নীতি একেবারে শূন্যের কোটায়! এসব কারণ ছাড়াও এদেশের রাজনৈতিক অবস্থা, প্রযুক্তি উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যাবস্থা ইত্যাদি দেশটিকে সুখী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
দেশটিতে রয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নেই কোন অহেতুক ঝামেলা বা দাঙ্গা! এই দেশটি মূলত একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নরওয়ের সবচেয়ে সুন্দর দিক হচ্ছে এটি প্রায় ৮ মাসই বরফের নিচে ঢাকা থাকে। এছাড়া এদেশ ডার্ক সাইড হিসেবে খ্যাত কেননা এখানে দুই মাস সূর্য উঠে না! অত্যন্ত সৌন্দর্যের এই দেশটি বেশ ক’বছর ধরেই বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে তালিকায় রয়ে গেছে।
সুইডেন
এ যেন সুইজারল্যান্ডের আরেক রূপ! ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ার সাথে দেশটি নিজেকে আরও এক ধাপ আপডেট করছে প্রতিনিয়ত। জানা যায় ২০১৭ সাল থেকেই এই দেশটি সুখী দেশ হিসেবে নিজেদের ধাপ এক এক করে অগ্রসর করতে সক্ষম হয়েছে।
দেশটির সরকার জানান, দেশের নাগরিকদের প্রতি রয়েছে সচেতনতামূলক সংস্থা, যা নানান কাজে সাহায্য করে থাকে। এছাড়া দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে দেশটিকে আবারো সুখী দেশ হিসেবে গণ্য করেছে জাতিসংঘ!
লুক্সেমবার্গ
এবারের সুখী দেশের তালিকায় ৮ নাম্বারে স্থান করেছে লুক্সেমবার্গ নামের দেশটি। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ধনীর দেশ হিসেবেই পরিচিত এই দেশ। ৭.৩২ মাত্রা নিয়ে জাতিসংঘের এই তালিকায় রয়েছে দেশটি।
দেশটি সুখী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশটির শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষা, মাথাপিছু আয়, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মান উন্নত হওয়ার জন্য। ইউরোপের চমৎকার এই দেশটিতে নেই কোন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিংবা কোন অরাজকতা।
নিউজিল্যান্ড
ওশেনিয়ায় দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড। সবুজের সমারোহ আর পাহাড়ের অদ্ভুত মিতালির এই দেশটি বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে স্থান করেছে ৯ম স্থানে। জানা যায়, এই দেশটি পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত।
বাক স্বাধীনতা, উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষার হার, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদির উপর বিবেচনা করে দেশটিকে সুখী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে জাতিসংঘ।
অস্ট্রিয়া
সুখী দেশের তালিকায় ১০ম স্থানে আছে ইউরোপের আরেকটি দেশ অস্ট্রিয়া। আল্পস পর্বতমালার উপর গড়ে উঠা চমৎকার এই দেশটি প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যের সব দেশ থেকে ছাড়িয়ে গেছে। অবাক হলেও সত্য যে, এই দেশের নাগরিকের মধ্যে কোন অপরাধ প্রবণতা নেই!
নেই কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা। প্রাচীন স্থাপত্য, পাহাড়, ঐতিহ্য, ল্যান্ডস্কেপের জন্যই মূলত এই দেশটি পরিচিত। অস্ট্রিয়া সাধারণত একটি উচ্চ আয়ের দেশ। এখানে সাধারণ নাগরিকের জন্য বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা আছে যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে আছে। শিক্ষার মান, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্যেই দেশটি বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় আছে।
Feature Image: iveybusinessjournal.com References: 01. Happiest Countries in The World. 02. Happiest Countries in The World.