৫১০.১ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার বিশাল পরিমাণের জায়গা যা পুরো পৃথিবীর মোট ভূমির পরিমাণ। তবে বিশাল এই পরিমাণের বিশ্বে বসবাসকারী ৭.৮৮৮ বিলিয়ন মানুষ হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে গড়ে ১৬ জন করে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ঠিক তার উল্টো। পৃথিবীর কিছু অংশে প্রচুর মানুষের বসবাস আর কিছু অংশ ধুধু মরুভূমি অথবা নির্জন বরফে আচ্ছন্ন।
চায়নার ম্যাকাওতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ২১,০৫৪ জন মানুষ, সিঙ্গাপুরে বাস করে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৭,৬০০ এর কিছু বেশি এবং হংকংয়ে এই সংখ্যা ৭,০৪২ আর বাংলাদেশে ১,২৭৭ জন। যার ফলে এই স্থানগুলোকে নিরবিচ্ছিন্ন চলাফেরা এবং জীবনযাপন করতে বিরক্তিকর মনে হতে পারে। তবে পৃথিবীতে ওয়েস্টার্ন সাহারার মতো কিছু স্থান রয়েছে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব শূন্যের কাছাকাছি – প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ২ জন মানুষ।
এই এলাকাগুলি সাধারণত জঙ্গল, বনপ্রান্ত, মরুভূমি, বৃহত্তম নদীগুলির সৈকত, পর্বতমালা এবং ঘন জলাভূমিগুলো হয়ে থাকে। এই এলাকাগুলি সাধারণত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের বাসস্থান এবং অনেক জানা-অজানা, বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীর অভয়ারণ্য হয়ে থাকে। তাই বলা যায়, পৃথিবীতে এমনও অনেক জায়গায় আছে যেখানে একাকি থাকতে পছন্দ করা মানুষজন সবকিছু ছেড়েছুড়ে সেখানে গিয়ে নিরিবিলি ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে থাকতে পারবে। সেই সকল একাকিত্ব মানুষদের জন্যই আজকে এরকম ৫টি প্রায় জনশূন্য স্থানগুলি নিয়ে আলোচনা যেখানে মানুষ খুঁজতে বাইনোকুলার থেকে শুরু করে দরকার পড়তে পারে দূরবীক্ষণ যন্ত্রও।
১. গ্রিনল্যান্ড (প্রতি কিলোমিটারে ০.০৩ জন মানুষ)
বিশ্বের সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হলো গ্রিনল্যান্ড, যার হার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ০.০৩ জন। গ্রিনল্যান্ড, কিংডম অব ডেনমার্কের একটি অংশ। কিন্তু এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত দেশ। ডেনমার্ক একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই সার্বভৌম রাষ্ট্র ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্বশাসিত অংশ হচ্ছে গ্রিনল্যান্ড।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য যুক্তরাজ্যের কথা উল্লেখ করা যায়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত কিন্তু এরা সবাই আলাদা আলাদা দেশ। কিংডম অব ডেনমার্কও তেমনই গ্রিনল্যান্ড, ফ্যারো আইল্যান্ড ও ডেনমার্ক নিয়ে গঠিত।
গ্রিনল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশই বরফে ঢাকা, এখানকার মানুষজন প্রধানত পশ্চিম উপকূল বরাবর বাস করে, যেখানে হিমবাহের পরিমাণও কম এবং পাথুরে উপকূল দ্বারা পরিবেষ্টিত। যদি কখনো গ্রিনল্যান্ড এর সব বরফ গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রায় ৫৬,০০০ জনসংখ্যার গ্রিনল্যান্ড হলো ১ম স্থান যা হতে পারে সেই স্থান যেখানে আপনি নিরিবিলি, লোকসমাগম ছেড়ে এবং সম্পূর্ণ একা থাকার স্বপ্ন হতে পারে পূরণ।
২. স্ভালবার্ড এবং জেন মায়েন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ০.০৪ জন মানুষ)
অত্যন্ত ঠাণ্ডা এবং দুর্গম দ্বীপ দুটি রয়েছে তালিকার ২য় স্থানে। স্ভালবার্ড এবং জান মায়েন হলো নরওয়ের উত্তরে অবস্থিত দুইটি দ্বীপ। দুটি দ্বীপ নরওয়েরই অংশ, তবে এরা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবেই কাজ করে। স্ভালবার্ড এর যে স্থানে সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে সেই জায়গায় নাম হলো লঙ্গইয়ারবেয়েন (Longyearbyen)।
৬০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপে জনসংখ্যা মাত্র ২৬৬৭ জন। জান মায়েন তুলনায় ছোট এবং এর আয়তন ৩৭৭ বর্গ কিলোমিটার। তবে জেন মায়েনে কোন মানুষ বাস করে না। এটি প্রধানত মিলিটারি এবং মেটিওরোলোজি (meteorology) গবেষণা স্টেশন হিসেবে ব্যবহার হয়।
৩. ফকল্যান্ড আইল্যান্ড (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ০.২৮ জন মানুষ)
প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ০.২৮ জন মানুষ নিয়ে তালিকার ৩য় স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের আরেকটি জায়গা যার নাম ফকল্যান্ড আইল্যান্ড। এই দ্বীপপুঞ্জটি দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থান এবং উত্তর আমেরিকার দক্ষিণের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে পরিচিত এবং এটি ব্রিটিশ সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির অন্যতম অংশ হিসেবে গণ্য।
এই দ্বীপপুঞ্জটির আয়তন প্রায় ৪,৬৮২ বর্গকিলোমিটার। ফকল্যান্ড আইল্যান্ড মূলত ৭৭৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ এবং এর জনসংখ্যা ৩,৩৯৮। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মুখ্য বাসস্থান হলো স্ট্যানলি (Stanley)। এটি দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক ও আর্থিক কেন্দ্র এবং সবচেয়ে বৃহত্তর শহর।
ফকল্যান্ড এর প্রধান দুই দ্বীপ, পশ্চিম এবং পূর্ব ফকল্যান্ডে মানুষের পদচারণা নেই বললেই চলে যার ফলে সেই দুই জায়গায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের পাখিদের অভয়ারণ্য। দ্বীপগুলো অনেকটা পাহাড়ি দ্বীপের মতো এবং দ্বীপটিতে অবিরত শীতল বাতাস বয়ে বেড়ায়।
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের অর্থনীতি মূলত মৎস্য নির্ভর। যদিও কম জনসংখ্যা হওয়ার কারণে জিডিপি এর পরিমাণ অনেক কম, তারপরও, জনপ্রতি জিডিপি বেশ ভালো এবং এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মানও বেশ ভালো।
৪. পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১.০৬ জন মানুষ)
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম এবং কম জনসংখ্যা বিশিষ্ট এলাকার তালিকায় পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম। প্রশান্ত সাগরের দক্ষিণে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ৪টি আগ্নেয়-দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে একটি হলো পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ যার মোট জনসংখ্যা ৫০ এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে মাত্র ১.০৬ জন মানুষ।
মূলত, এই ৫০ জন মানুষ পূর্বে বসবাসকারী উপনিবেশ স্থাপনকারীদের বংশধর। ধারালো ও তীক্ষ্ণ প্রবালে আচ্ছাদিত চুনাপাথরের সূচালো ধারের কারণে পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ অংশে যাওয়া যায় না। যার ফলে সেই অংশগুলোতে কোন বসতি গড়ে উঠেনি। তবে পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জের আবহাওয়া মানুষ বসবাসের জন্যে যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
কম জনসংখ্যার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জে এখনও পর্যন্ত বিমান অবতরণের কোন রানওয়ে নেই, যদিও সমুদ্র পথে জাহাজ এবং ইয়ট ভিড়ানোর জন্যে ছোট ছোট বন্দর রয়েছে।
৫. ট্রিস্টান দা কুন্হা (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১.১৮ জন মানুষ)
দক্ষিণ আটলান্টিকে অবস্থিত অনেকগুলো আগ্নেয়-দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ট্রিস্টান দা কুনহাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপটি যদিও মাত্র ২০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ট্রিস্টান দা কুনহা তারপরও পৃথিবীর কম জনসংখ্যার দ্বীপগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এই দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করে মাত্র ২৪৬ জন মানুষ, যাদের বেশিরভাগই বাস করে মূল দ্বীপে। এই দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা খুব সীমিত হওয়ায় এবং খাদ্য সরবরাহের সুবিধা না থাকায় খাদ্যপণ্য সেখানকার মানুষজন নিজেরাই উৎপাদন করে। ট্রিস্টান দা কুনহা পূর্ণতঃ স্বয়ংক্রিয় ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, তারা তাদের স্বনির্ধারিত কৌশল এবং পদ্ধতি অবলম্বনে প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে।
Feature Image: Ignacio Palacios/Getty Images References: 01. The 10 Least Densely Populated Places In The World. 02. These Are the Least Populated Places on Earth. 03. The World’s Least Crowded Places.