চোখ ভালো রাখতে যেসব বিষয় লক্ষ্যণীয়

246
0

চোখ-মানবদেহের অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মানুষ তার চারপাশের জগতকে দেখার এবং বোঝার জন্য এই চোখের উপরই নির্ভর করে। চোখের জ্যোতি নিভে গেলে পুরো জীবনটাই হয়ে যাবে অন্ধকার। একজন অন্ধ মানুষই বুঝতে পারে চোখের কি মর্ম!

চোখ ছাড়া মানুষ তার ৮০-৯০ শতাংশ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া, দেহের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য চোখের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই, চোখের যত্ন নেয়া অতীব জরুরি। দৈনন্দিন জীবনে দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো চোখের গুরুত্ব সহকারে যত্ন নেয়া হয় না।

কিন্তু জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন নিয়ে আসলে চোখের সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব। চোখ সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখতে যেসব বিষয়গুলি লক্ষ্য রাখতে হবে সেই অনেকগুলো থেকে বাছাই করা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কিছু টিপস নিয়েই আজকের আলোচনা।

১. চোখের নিয়মিত চেক-আপ 

বছরে অন্তত একবার একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ/চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো প্রয়োজন, এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দৃষ্টি কতটা শক্তিশালী বা চোখ কতটা সুস্থ তা পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে, প্রয়োজন হলে ওষুধের পাশাপাশি চশমা বা লেন্স দেওয়া হতে পারে।

বছরে একবার হলেও চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। Image Source: puppycarenes.top

বর্তমানে মায়োপিয়া রোগ প্রায় মহামারী আকার ধারণ করে উঠেছে, বিশেষ করে অল্প বয়সীরা মায়োপিয়াতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই মায়োপিয়া থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত চোখের চেকআপ অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়াও চোখের ছানি, রেটিনাল বিচ্ছিন্নতা এবং গ্লুকোমা থেকে বাঁচতেও ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ নেয়া উচিত।

২. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস 

চোখের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পুষ্টিকর, সুষম খাদ্য অপরিহার্য। প্রতিদিনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল এবং শাকসবজি, বিশেষ করে রঙিন এবং সবুজ শাক-সবজি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

বাছাই করা এমন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার যা চোখের জন্য উপকারি সেগুলো হলো-বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছ, যেমন-টুনা, স্যামন, ট্রাউট, সার্ডিন, ম্যাকেরেল, অ্যাঙ্কোভিস, হেরিং ইত্যাদি যা ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিডের সর্বোৎকৃষ্ট উৎস।

পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। Image Source: morelandobgyn.com

সব ধরনের বীজ এবং বাদাম–আখরোট, কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, কাজু, চিয়া সিডস, কালোজিরা। কমলা ও লাল রঙের খাবার, যেমন-গাজর, স্কোয়াশ, ক্যান্টালুপ, হলুদ মরিচ, লাল শাক, লাল মরিচ এবং টমেটো। এগুলো বিটা-ক্যারোটিন, লুটেইন, লাইকোপেন জিঙ্ক এবং ভিটামিন সি, এ, ই এর যোগান দিতে সাহায্য করে।

ডিম, সয়াবিন, দুগ্ধজাতীয় দ্রব্য, ডাল ইত্যাদি অনুরূপ আমিষ জাতীয় খাবার। পালংশাক ভিটামিন এ ও সি এর অনেক ভালো উৎস। রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন এ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। মলা-ঢেলা জাতীয় ছোট মাছ চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পুষ্টিকর খাদ্য শুধু চোখ ভালো রাখতেই নয় সাথে স্থূলতা বা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।

৩. ধূমপান বর্জন 

ধূমপান শুধুমাত্র ফুসফুসের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি চোখের জন্যেও সমানভাবে ক্ষতিকর। এটি চোখের দৃষ্টিশক্তির উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তির হ্রাস পায় যেটাকে ত্বরান্বিত করে এই ধূমপান। এছাড়াও, ধূমপান ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, গ্লুকোমা, ড্রাই আই সিনড্রোমের ঝুঁকি বাড়ায়।

ধূমপান চোখের ক্ষতি করে। Image Source: rebuildyourvision.com

এজন্য যত দ্রুত সম্ভব ধূমপান কমিয়ে আনা, যদি আপনি চেইন স্মোকার হন এবং বাদ দেয়া অসম্ভব বলে মনে হয়, তাহলে একজন থেরাপিস্টের পরামর্শ নিন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন।

৪. চোখের ব্যায়াম করা 

নিয়মিত বিরতিতে, চোখকে একটু ব্যায়াম করানো যেমন-১৫ সেকেন্ডের জন্য একটি দূরবর্তী কোনো জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকা একটু পরেই দৃষ্টি কোনো কাছাকাছি বস্তুর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং আরও ১৫ সেকেন্ডের জন্য পুনরায় একই কাজ করা।

এভাবে ৪-৫ বার পুনরাবৃত্তি করা। চোখকে অপ্রয়োজনীয় চাপ এবং অস্বস্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতি দারুণ কার্যকর।

৫. রৌদ্রে সানগ্লাস ব্যবহার করা 

সূর্যের UV রশ্মি আপনার চোখের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। অতিরিক্ত ইউভি এক্সপোজার অস্থায়ী অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। সেজন্য এমন সানগ্লাস ব্যবহার করা যা ৯৯% থেকে ১০০% UVA এবং UVB রশ্মিকে ব্লক করতে সক্ষম।

যেমন-Wraparound Sunglass যেটা চোখকে চারিদিক থেকে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এছাড়াও সূর্যের প্রখর তাপ চোখে লাগতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

৬. সবসময় হাইড্রেটেড থাকা 

চোখসহ মানুষের শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ অপরিহার্য। চোখ ভালো রাখতে গেলে, সারাদিনে প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেকদিন অন্তত ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করতে হবেই।

হাইড্রেটেড থাকলে চোখ ভালো থাকে। Image Source: health.harvard.edu

এর ফলে একদিকে যেমন চোখ পরিষ্কার, সতেজ এবং ঠান্ডা থাকবে, তেমনই ডিহাইড্রেশন/পানিশূন্যতারও চিন্তা থাকবে না। শরীর যদি যথেষ্ট হাইড্রেটেড থাকে, তাহলে চোখ শুষ্ক হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

৭. নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম 

চোখের বিশ্রামের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী কাজ হচ্ছে ঘুম। একটানা লম্বা ঘুম শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি চোখের জন্যও উপকারি। এতে চোখ সারাদিন সতেজ ও প্রাণবন্ত থাকে।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। এতে যেমন ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, মানসিক অশান্তি, অবসাদ, উৎকণ্ঠা দূরে থাকবে সাথে চোখও চাপমুক্ত ও ভালো থাকবে।

৮. ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করা 

আপনার দৈনন্দিন কর্মজীবনে যদি ৪-৬ ঘণ্টা যাবৎ বা এর থেকে বেশি সময় কম্পিউটার স্ক্রিনে ব্যয় করা লাগে তবে আপনি স্বাভাবিকভাবেই আপনার চোখের পলক ফেলতে ভুলে যাবেন বা অল্প পলক ফেলবেন যার কারণে চোখ শুষ্ক এবং ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ডের জন্য বিরতি নিতে হবে। Image Source: praxis42.com

আর চোখ সুরক্ষার জন্য অন্যতম একটি নিয়ম হচ্ছে ২০-২০-২০। এতে প্রতি ২০ মিনিট পর পর, ২০ ফুট দূরত্বের কোনো জিনিসের দিকে ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতে হয়। এতে চোখের আর্দ্রতা বজায় থাকে এবং চোখের ওপর চাপ কম পড়ে।

কাজের ফাঁকে একটু বিরতি নেয়া এবং ৫-১০মিনিট হাঁটা-চলা করা। এটি শুধু চোখের দৃষ্টিশক্তির জন্যই ভালো নয়, সেই সাথে সারা শরীরে ও অপটিক নার্ভে রক্ত সঞ্চালন এবং একঘেঁয়েমিতা কাটিয়ে উঠতেও সহায়তা করে।

৯. চারপাশ পরিষ্কার রাখা 

আপনি যেখানে থাকেন অর্থাৎ আপনার শোবার ঘর, বিছানা, টেবিল, অফিসরুম ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক জায়গা ও জিনিসপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। কারণ ময়লা এবং ধূলাবালির কারণে চোখ জ্বালা ও চুলকানি হতে পারে; তাই নিশ্চিত করুন যে আপনার আশেপাশের জায়গাগুলি এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলির ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়।

১০. হাত ও চোখ সবসময় পরিষ্কার রাখা 

মাঝেমাঝে চোখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিন, এতে চোখ সতেজ ও পরিষ্কার থাকবে। আপনার চোখ, চশমা এবং কন্টাক্ট লেন্সকে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া থেকে দূরে রাখতে অযথা চোখ কচলানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

চোখ ভালো রাখতে চাইলে নিজের চারপাশ এবং নিজেকেও পরিষ্কার রাখতে হবে। Image Source: luteineyesupport.com

কারণ এতে হাতের ময়লা চোখে গিয়ে জ্বালাপোড়া বা চুলকানি হতে পারে আবার অধিক ঢলাঢলির ফলে চোখের চারপাশে রক্তজালিকা ছিঁড়ে গিয়ে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই চোখে হাত দেয়ার আগে এবং কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারের আগে অবশ্যই হাত সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।

খাবারে লবণ বেশি না খাওয়া এবং মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা ত্যাগ করা। চোখে অতিরিক্ত প্রসাধনী ব্যবহার না করা। চোখের স্বাস্থ্য বয়সের সাথেও যুক্ত, আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে থাকে,তাই তখন বেশি বেশি চক্ষু ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। বিশেষজ্ঞের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ ও চশমা ব্যবহার করা।

সংক্রামক রোগ থেকে বেঁচে থাকা এবং অন্যের ব্যবহৃত চশমা, কন্টাক্ট লেন্স ও সানগ্লাস ব্যবহার না করা। আর চোখের কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিলে বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং সে অনুযায়ী মেনে চলা। সর্বোপরি,স্বাস্থ্যবীধি মেনে চললে আমাদের অমূল্য এই চোখকে সহজেই ভালো রাখা সম্ভব।

 

 

 

Feature Image: sightsaverindia.com 
References: 

01. 9 Simple Tips To Keep Your Eyes Healthy!
02. How to Keep Your Eyes Healthy. 
03. Keep Your Eyes Healthy. 
04. Eye Care. 
05. 12 Ways to Take Care of Your Eyes Everyday.