ঘন কুয়াশা। শ্বেত শুভ্র তুষারে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। ঠান্ডা প্রায় মাইনাস ৩০ ডিগ্রি। এর মধ্য দিয়ে হেটে যাচ্ছে রেড আর্মির নবম রেজিমেন্টের একদল সৈনিক। ঠান্ডা ও ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে এক একজন। চলতে চলতে হঠাৎ দলের একজন লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। কোত্থেকে যেন একটা বুলেট এসে সোজা বিধেছে তার কপালে। স্পট ডেড।
বলতে বলতে পাশ থেকে আরেকজন লুটিয়ে পড়লো। এবার চারপাশে চোখ বোলালো তাদের ক্যাপ্টেন জোকোভিচ। কেউ নেই আশেপাশে। শুধু ধু ধু শুভ্রতা। এর মধ্যে তার ডান পাশ হতে গুলিবিদ্ধ হলো আরও একজন। সাথে সাথে বাকিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দ্বিগবিদিক গুলি করতে শুরু করলো। জোকোভিচ একা দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছু আঁচ করতে পারছে না।
হঠাৎ একটা গুলি এসে আঘাত করলো তার বুকের একটু উপরে। পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো তার। ঢলে পড়ার আগে ঝাপসা দেখতে পেলো বরফের নিচে কে যেন নড়ছে। চিৎকার দিতে চাইলেও সেই শক্তি নেই জোকোভিচের। সাদা, রাইফেল হাতে। মুখে চিকন একটা হাসি লোকটার। মৃত্যুর দূত হয়ে শুষে নিচ্ছে এক একজন সৈনিকের প্রাণ। এই মৃত্যুর দূত একজন রক্তমাংসের মানব। ইতিহাস তাকে চেনে দ্য হোয়াইট ডেথ নামে।
সিমো হ্যায়হা
সিমো হ্যায়হা ১৯০৫ সালের ১৭ই ডিসেম্বর ফিনল্যান্ডের কারেলিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন যেটা আগে ফিনল্যান্ডের অধীনে থাকলেও বর্তমানে রাশিয়ার ভূভাগের অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিক জীবনে তিনি পেশায় একজন কৃষক, শখে শিকারী, শ্যুটার ছিলেন। সিমো বড় হয়েছে রাশিয়ান সীমান্তের ধারের অনুর্বর ভূ-খণ্ডে, যে কারণে তার আশেপাশের এলাকায় জনমানুষের উপস্থিতিও ছিল কম।
শহুরে জীবনের ছিটেফোঁটা স্বাদও পায়নি সে। যার কারণে সহজ জীবন থেকে অনেক অনেক দূরে ছিল তারা। তবে তার একটা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল, আর সেটা হচ্ছে শ্যুটিং। তার কৈশোর জীবনের সে বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছে একটা ছোট পুরনো বোল্ট-অ্যাকশন রাইফেল দিয়ে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন বন জঙ্গলে শিকার করতে করতে।
২০ বছর বয়সে সে ফিনিশ মিলিটারির ম্যান্ডেটরি সার্ভিসে যুক্ত হয় এবং করপোরাল পদে উন্নীত হয়। এরপর সে মিলিটারি দ্বারা আয়োজিত বিভিন্ন স্কিং এবং শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। খুব তাড়াতাড়ি সে রাইফেল শ্যুটিংয়ের জন্য পরিচিতি পেয়ে যায় ব্যাটালিয়নে। এরপর সে ন্যাশনাল মিলিটারির কমপালসরি সার্ভিসে যুক্ত হয়। সে ফিনল্যান্ড মিলিটারির হোয়াইট গার্ড সেকশনে যুক্ত হয়, যেটা ১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতা এবং এর পরের বছরগুলোতে গৃহযুদ্ধ দমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
৩০শে নভেম্বর, ১৯৩৯ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সিমো হ্যায়হা তখন ছিলেন সাদামাটা জীবনের অধিকারী, যে বেড়ে উঠেছে একেবারে সাধারণভাবে। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে তেমন কোনো মাথাব্যথাও নেই তার। তবে এসবে মাথাব্যথা না থাকলেও আর পাঁচটা ফিনিশ স্বাধীনচেতা মানুষের মতো সে-ও ছিল সম্পুর্ণভাবে স্বাধীনচেতা। সবার আগে তার কাছে গুরুত্ব পেত নিজের এবং দেশের স্বাধীনতা।
তখন সে নর্থ লেক লাদোগ এর কোল্লা অঞ্চলের ১৩তম রেজিমেন্টে যোগদান করে। এদিকে রাশিয়ান ব্যাটলের ৯ম ও ১৪ম রেজিমেন্ট দ্রুত কোল্লানজকি নদী দিয়ে প্রবেশ করতে এবং দখল করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাদের এই অঞ্চল দিয়ে আক্রমণ চালানোর মতো যথেষ্ট প্রস্তুতিও ছিল না। আবার আবহাওয়াও ছিল সম্পূর্ণ প্রতিকূল। তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হ্যায়হাকে রেজিমেন্ট থেকে একটি Mosin-Nagant M28/30 দেওয়া হয়, ওজনে একটু ছোট এবং রাশিয়ান রাইফেলের তুলনায় একটু ভারী ছিল যেটা। তবে ছোট ও ভারী হলেও M28 ছিল স্নাইপিংয়ের জন্য একটি আদর্শ রাইফেল।
সম্মুখ সমরে রাশিয়ান আর্মির মতো মাইটি মিলিটারির সাথে পেরে উঠার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না ফিনিশ মিলিটারির। কারণ রুশ আর্মি সেনা, ট্যাংক, রাইফেল, অস্ত্র—সব দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল। তখন ফিনল্যান্ড মিলিটারি তাদের চিরায়ত যুদ্ধকৌশল ‘Hit and run’ এর ওপর নির্ভর করে। যেখানে স্কেটিং ও স্নাইপিংয়ের ওপর নির্ভর করে বরফ ঘেরা অঞ্চলে আঘাত হানবে রাশিয়ান সৈন্যদের উপর। রাশিয়ান সৈন্যরা স্কেটিংয়ের সাথে ওভাবে পরিচিত বা প্রশিক্ষিত ছিল না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে এটি একটি ভালো পন্থা ছিল।
সিমো হ্যায়হার দ্য হোয়াইট ডেথ হয়ে ওঠা
ফিনল্যান্ডের শীত জঘন্যরকমের নির্দয়। এমনকি কিছুক্ষণের জন্য সূর্য উঠলেও শীত তার তাণ্ডব চালিয়ে যায় নিজের মতো করে। তো এরকম আবহাওয়ার মাঝে সিমো হ্যায়হা নিজেকে একটি পুরু ও সাদা ভারী স্যুট দিয়ে ঢেকে নিয়েছিল, যতটা সম্ভব বরফ আর ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছিল। সেইসাথে মুখে পরে নিয়েছিল একটি স্নাইপিং মাস্ক। তার সাদা স্যুট কোল্লার বরফ জমা সাদা আবহাওয়ার সাথে মিশে গিয়েছিল খুব সহজেই।
একজন স্নাইপারের সাধারণত প্রচন্ড বুদ্ধিমান এবং সচল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী হতে হয়। সিমো হ্যায়হাও তেমন ছিল। সে সাধারণত একা একা কাজ করতে পছন্দ করতো। সাদা বরফ ঘেরা বনের মধ্য দিয়ে সে তার সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে চলতো। সাথে থাকতো শুধু একদিনের খাবার আর ৫০-৬০ রাউন্ড বুলেট। এগুলো নিয়ে সে একটা নিখুঁত জায়গা খুঁজতো, যেখান থেকে সে অনায়াসে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।
একবার যদি সে তার পছন্দমতো জায়গা পেয়ে যায়, তারপর সে তার আশেপাশে বরফ দিয়ে ঢেকে দিতো প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার জন্য। আর এরপরই শুরু হতো তার অপেক্ষার প্রহর, শিকারের জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে থাকতো বরফের নিচে। আর যখনই ক্লান্ত, শ্রান্ত, ঠান্ডায় জমে যেতে থাকা রাশিয়ান সৈন্যদল তার হিট এরিয়া দিয়ে যেত, ঠিক তখনই শ্বাস চেপে, নিশানা ঠিক করে………বুম…………ট্রিগার টেনে দিতো।
শোনা যায়, ট্রেনিংইয়ের সময় সিমো হ্যায়হা ১৫০ মিটার দূর হতে প্রতি মিনিটে ১৬ বার তার নিশানায় আঘাত করতে পারতো। তো, সোভিয়েত সৈন্যরা তার প্রাণ এক অচেনা অজানা স্নাইপারের হাতে সমর্পণ করে ঢলে পড়তো, মৃত্যুর আগে জানতেও পারতো না কে তাদের স্বাদের জীবন শুষে নিয়েছে একটি বুলেটের বিনিময়ে।
একটি শট, একটি প্রাণ
সিমো হ্যায়হা বিশ্বাস করতেন যে, সে কখনো তার নিশানা ভেদ করতে ভুল করতে পারেন না। রেকর্ড মতে, ক্রিসমাসের আগের দিন সে একদিনেই মোট ২৫ জন রাশিয়ান সৈন্য হত্যা করেছে। সে তার এই ক্ষুদ্র যুদ্ধের মধ্যে অসম্ভব রকমের দ্রুত শত্রু হত্যা করেছে। শুরুতে তার সহকর্মীরাও এটা বিশ্বাস করতে পারতো না। ধীরে ধীরে তারাও মেনে নিয়েছে।
আমেরিকান স্টাডির এক জরিপ মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতি একজন সৈনিক হত্যা করতে গড়ে বুলেট খরচ হয়েছে প্রায় ৭,০০০টি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এই সংখ্যাটা আরও বেশি ছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতি একজন সৈন্য হত্যা করতে গড়ে ২৫,০০০টি বুলেট খরচ করতে হয়েছে। তো সিমো হ্যায়হা কোল্ড ওয়্যারের সময় প্রায় ৫০০ জন রাশিয়ান সৈন্য হত্যা করেছে।
উক্ত জরিপ মতে, যার জন্য প্রায় ১ কোটি ৩৫লক্ষ ৫০ হাজার বুলেট খরচ করার কথা সিমোর। অথচ সে মাত্র ৯৮ দিনের মধ্যে ৫০০ এরও বেশী রাশিয়ান সৈনিক হত্যা করেছে, যেই সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ৫০ হাজার বুলেট খরচ করা একজনের পক্ষে অসম্ভব প্রায়। এজন্য সিমো হ্যায়হাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা মরণঘাতী স্নাইপার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
যখন বেশীরভাগ ফিনিশ এবং রুশ স্নাইপাররা টেলিস্কোপ লেন্স সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক রাইফেল ব্যবহার করতো স্নাইপিংয়ের জন্য, তখন সিমো হ্যায়হা ব্যবহার করতো M28/30 ফর্মেটের রাইফেল। সে এই পুরনো রাইফেল ব্যাবহার করতো কারণ, এটা তাকে শত্রুর প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ধরতে সাহায্য করতো। শুধু এটার জন্য না, এই রাইফেল তাকে মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করতো, তাকে তার জায়গা আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে বাধ্য করতো।
আর মডার্ন রাইফেলের লেন্সে আলোর ঝলকানি প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যার ফলে হ্যায়হার গোপন জায়গা প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। সেই সাথে রুশ সৈন্যরা পালটা স্নাইপিংও শুরু করে দিতে পারতো। এজন্য সে টেলিস্কোপ লেন্স যুক্ত রাইফেল ব্যবহার করতো না। সে সবসময় তার স্থান গোপন এবং সতর্ক থাকতে পছন্দ করতো।
সিমো হ্যায়হার যুদ্ধ পরবর্তী জীবন
১৯৪০ সালের মার্চ মাস। ততদিনে সে ফিনিশ সরকার ও মিলিটারি হতে সেরা স্নাইপারের খেতাব ও স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। এরই মধ্যে, ৬ই মার্চ, ১৯৪০ রাশিয়ান রেড আর্মির একটা বুলেট এসে তার চোয়ালে আঘাত করে। তার সহযোদ্ধারা ভেবেছিল সে মারা গেছে। কিন্তু হঠাৎ তার পায়ের একাংশ নড়তে দেখে তারা তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।
ওই বুলেটের আঘাতে সে মারা না গেলেও গুরুতর আহত হয়। বুলেটের আঘাত তার উপরের চোয়াল, নিচের চোয়াল এবং বাম থুতনি একেবারে ভেঙে ফেলে। কিছুদিন পর সে জ্ঞান ফিরে পেয়ে পত্রিকা খুলতেই তার মৃত্যু সংবাদ দেখতে পায়। রাশিয়ান মিলিটারি মাইন্ডগেমে এগিয়ে থাকতে তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি সে আরও একটি খবর দেখতে পায়। মস্কো আর হেলসিংকির শান্তিচুক্তির সংবাদ।
এরপর প্রায় ১৪ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল সে। সার্জারীর ছুরি-কাঁচির নিচ দিয়ে যেতে হয়েছে ২৬ বার। এরপর সে বাসায় ফিরে। সে আবার যুদ্ধে যেতে চেয়েছিল, ‘কন্টিনুয়েশন’ এর যুদ্ধে। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা বাধ সাধলো তাতে। ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিম পাশে তাকে একটি খামার দেওয়া হয়, যেখানে সে শিকারী কুকুর পালন করতো।
সে তার পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে হিমশিম খাচ্ছিলো তখন, এমনকি নিজ গোত্রের মানুষের কাছ থেকে হত্যার হুমকিও পেয়েছিল। সিমো হ্যায়হা তার জীবদ্দশায় কখনো বিয়ে করেনি। তার কোনো ছেলেমেয়েও ছিল না। সিমো হ্যায়হা ১লা এপ্রিল, ২০০২ সালে বার্ধক্যজনিত রোগে মারা যান।
Feature image: historyonthenet.com 01. Worlds Deadliest Sniper Simo Hayha Finnish White Death Winter War. 02. Simo Hayha The White Death. 03. The Worlds Deadliest Sniper the White Death. 04. Simo Hayha Born. 05. Simo Hayha Sniper.