রাজগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পায়রা নদী ভেঙে শেষ করে দিচ্ছে লোকালয়। ইউপি চেয়ারম্যানের উদ্যোগে বাঁধ নির্মাণ শুরু হবে দ্রুতই। চুক্তি নিয়েছে বিদেশি একটা কোম্পানি। লেবারদের থাকার জন্য একটা ডরমিটরি বানানোর কাজ চলছে বাজারের ভেতরে।
রাজু, রাকিব আর রাহাত—তিন ভাই সন্ধ্যার দিকে এদিকটায় আসে রোজ। রাহাত ছোটো। রাজু আর রাকিব গ্রামেই থাকে। শহরে থেকে পড়াশোনা করে রাহাত। গ্রামে বেড়াতে এসে আজ কয়েকদিন ধরে মিস্ত্রিদের এই নির্মাণকাজ দেখছে। ওর ভালোই লাগে—খালি গলায় মিস্ত্রিরা গান গায় আর ছাদ পেটায়। কিন্তু এ গানের কথাগুলো কেমন অপরিচিত ঠেকে ওর কাছে। অন্য দুই ভাই বলেছে এ হলো ছাদ পেটানোর গান।
পরিচয় : সারিগানের রূপভেদ
বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ লোকগান কর্মসঙ্গীত। ছাদ পেটানোর গান এক জাতীয় কর্মসঙ্গীত। দিনভর কাজের ক্লান্তি দূর করতে, অন্য কথায় কর্মোদ্দম যোগাতে কর্মসঙ্গীতের তুলনা নেই।
বহুল পরিচিত সারিগানের সাথে ছাদ পেটানোর গানের মূল পার্থক্য যন্ত্রানুষঙ্গে। সারিগান গাইতে হলে যেমন বিভিন্ন প্রকারের লোকবাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয়, তেমনটা ছাদ পেটানোর গানে নেই। শুধু বেহালাই যথেষ্ট। সাধারণত ছাদ পেটানোর জন্য ব্যবহৃত ব্যাট, মুগুর বা গদার মতো হাতিয়ারটিই গানের তাল রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
ইতিহাস
এদেশে পেশা হিসেবে ছাদ পেটানো বেশ পুরোনো। মুঘল আমলেই এর সূচনা বলা যেতে পারে। তখন থেকেই ঢাকায় ইমারত, দালান, দেউড়ি, কাটারা, মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি ভবন তৈরি হতে থাকে। পাকা ভবন তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে জলছাদ তৈরি করতে হতো। আর সেজন্য জাফরি ইট, চুন, সুরকি ইত্যাদির মিশ্রণে গাঁথুনি ও দেয়াল বানাতে হতো।
আবার কাঠ ও লোহার সাতিরের ওপর বিছানো হতো জাফরি ইট। এরপর তার ওপর সুরকি ও চুনের মিশেল দিয়ে তৈরি করা আস্তরণ দিয়ে ছাদের ওপর ঢালাই দেওয়া হতো। লেবাররা কাঠের মুগুর দিয়ে সারাদিন ওই ছাদ পিটিয়ে শক্ত করার কাজ করতো।
এই কাজে যাতে ক্লান্তি না আসে সেজন্য সরদার গান বাঁধত। ছাদ পেটানোর লেবাররা সেই গানের সাথে কোরাস দিত আর তালে তাল মিলিয়ে ছাদ পেটাত। ঢাকার সীমা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে সারাদেশে যেভাবে নির্মাণ শ্রমিকরা ছড়িয়ে পড়েছে, ছাদ পেটানোর গানের ঐতিহ্যও সেভাবে তারা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে একটা সময়।
ছাদ পেটানোর গান আজ বিলুপ্তপ্রায়। সিমেন্টের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াটা এর কারণ। সিমেন্ট আসার পর থেকে জলছাদ বানানোর আর দরকার পড়ে না। ফলে প্রয়োজনের সাথে সাথে প্রচলনও কমে যায় জলছাদের। আর তাতে বিস্মৃতির বিষয় হয়ে যায় ছাদ পেটানোর গান।
ছাদ পেটানোর গানের বৈশিষ্ট্য
- নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম অনুসরণ করে ছাদ পেটানোর গান বাঁধা হয় না।
- প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদের ফলে মানবমনে সৃষ্ট হাসি-কান্নাই এ গানের উপজীব্য।
- সাধারণত কোরাসে গাওয়া হয় এ গান। তবে একজনও গাইতে পারেন।
- সহজ ও সরল লোকআবেদনের ভাষা এ গানে বজায় থাকে।
- গীতিকার প্রধানত পরিবেশ, বাস্তবতার নিরীখে নিজস্ব কথাই এ গানে বলে থাকেন।
- মুখে মুখে শুনে প্রচলিত বলে ছাদ পেটানোর গান লোকসঙ্গীতের মর্যাদা পায়।
- ভাব ও অর্থের দিক থেকে এ গান বেশ সমৃদ্ধ।
- কখনো কখনো আঞ্চলিক বিশেষত্ব ধারণ করে এ গান। কখনো বা প্রচলিত নানা মিথ উঠে আসে ছাদ পেটানোর গানে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রভাব
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বড়ু চণ্ডীদাস এর রচয়িতা। শ্রীকৃষ্ণ আর রাধিকার প্রেম নিয়ে রচিত এ কাব্য। বাংলা লোকগানে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বেশ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ছাদ পেটানোর গানেও এর প্রভাব রয়েছে। ছাদ পেটানোর গানের একটি উদাহরণ দেখলে এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।
‘কালা তোর তরে কদমতলায়
বইসা থাকি, বইসা থাকি,
নাম রাইখেছি, চিকন কালা
বাঁশি বাজায় অতি ভালা
সেই বাঁশিতে হই উতলা
কেম্বে বাইন্দা রাখি,
বইসা থাকি, বইসা থাকি।’
কৃষ্ণের গায়ের রঙ ছিল কালো। সে কারণে তাকে ‘কালা’ বলে সম্বোধন করতেন রাধিকা। কদমতলায় বসে মগ্ন হতেন কৃষ্ণের বাঁশির সুরে। এ সুর তাকে উতলা করতো। এসব বর্ণনা মূলকাব্যের বংশী খণ্ডে পাওয়া যায়।
ছাদ পেটানোর গান যে সারিগানের রূপভেদ, তার উৎসেও শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব। দ্বাপর যুগে তিনি রাধিকাকে নৌকার আগায় বসিয়ে নিজে পেছনে বসতেন এবং এক হাতে বাঁশি বাজাতেন এবং আরেক হাতে নৌকার বৈঠা বেয়ে নদী পাড়ি দিতেন। এ সময় রাধিকার সখীরা, অর্থাৎ গোপীরা নৌকায় বসেই হাতের পাতা যমুনার জলে ডুবিয়ে খেলতেন।
নৌকা বাইচের আসরে যে সারিগান হয়, তা এমন দৃশ্যেরই জন্ম দেয়। আগায় এবং পেছনে দুজন মাঝি বসে আর সারা নৌকা ভর্তি থাকে মাল্লায়। নৌকা বাইতে বাইতে যে দলীয় সঙ্গীত গাওয়ার চল, তা ধীরে ধীরে সব দলগত পেশায় ছড়িয়ে যায়। এ ধারায়ই রাজমিস্ত্রির নেতৃত্বে ছাদ পেটানোর গানের সূচনা।
বাঙাল ভাষারীতির ঘ্রাণ
এতদাঞ্চলে, অর্থাৎ আমাদের দেশে ছাদ পেটানোর গান হিসেবে যেগুলো গাওয়া হয়, সেগুলো প্রচলিত কথা ও সুরের অনুসৃতিতে গাওয়া। লক্ষ্যণীয় যে এগুলোর ভাষা ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বঙ্গ জনপদের সাধারণ কথ্য ভাষা তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সাধারণের কথ্য ভাষারীতি প্রাধান্য পায়। ভাষার ব্যাকরণ মেনে চলিত ভাষারীতি অনুসরণ করা হয় না। একটি গানের অংশবিশেষ এমন-
তরে চন্দ্রহার গড়াইয়া দিল কে?
চন্দ্রমুখী লো, তর লাগি হইলাম দ্যাশান্তরী
চিলায় নিল বিলেরই মাছ
বুক চাপড়াইয়া মরি
চন্দ্রমুখী লো, তর লাগি হইলাম দ্যাশান্তরী!
এ গান খেয়াল করে শুনলে বোঝা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে [ও] ধ্বনির উচ্চারণ [অ] ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়েছে (যেমন তোরে>তরে) আবার [এ] ধ্বনির উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়েছে [অ্যা] ধ্বনিতে (যেমন দেশান্তরী>দ্যাশান্তরী)। আবার, চ বর্গীয় ধ্বনির উচ্চারণ তালব্য না হয়ে অন্তঃস্থ হয়েছে। চন্দ্রমুখী শব্দটির উচ্চারণ এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। বিশেষত খুলনা-যশোর অঞ্চল এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের উপভাষাতাত্ত্বিক সূক্ষ্ম প্রভাব এ গানে পাওয়া যায়। এই বিশেষত্বটি তৎকালীন পূর্ববঙ্গীয় মানুষের মৌখিক ভাষারীতির গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব।
আদিবাসীরাও গায় এই গান
শুধু যে বাঙাল বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্যণীয় এমন নয়। ক্ষেত্রবিশেষে আদিবাসীরাও ছাদ পেটানোর গান করতো। এক্ষেত্রে একটি গান উল্লেখযোগ্য-
দালান দিলি, মহল দিলি
বাড়ির নিচে পুষ্করিনী
একখানা পানসি দিতে পারো নি?
বাঁধা জল, কাঁচা পানি
শুনো হে মিস্তিরি
একটুও লবণ দিতে পারো নি?
চাল পেলাম, জল পেলাম
না পেলাম জ্বালানি
তরকারি সবই হলো
পাইনি সুক্তানি
ভাত হলো, ডাল হলো
পেলাম না আমানি
দিঘির ধারে বাগান হলো
না হলো মালিনী!
এটি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত একটি ছাদ পেটানোর গান। এ আদিবাসী জনগোষ্ঠী আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় বাস করে। তবে ভারতের ঝাড়খণ্ডসহ রাঢ়বঙ্গের কিছু কিছু এলাকায়ও এদের বিপুল বসত। যেখানে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান। মজার বিষয় হলো, সমকালীন সাহিত্যে জনপ্রিয় কাজীদা তাঁর সাহিত্যসৃজনের ধারায় ছাদ পেটানোর গানও লিখেছিলেন। তাঁর একটি লেখা এমন-
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ।
পাত ভরে ভাত খাই না, ধরে আসে হাত গো
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ।
এ গানটি পরবর্তীতে ছাদ পেটানোর গান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। একটি মজার বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ওপরের দুটো গানেই ছাদ পেটানি শ্রমিকদলের না পাওয়ার আক্ষেপ প্রতীয়মান। তা সত্ত্বেও ইতিবাচক বাণীসমৃদ্ধ গান তারা করত না, এমন নয়। এরকম একটা গানের উদাহরণ দেখা যাক-
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে—
কলকাত্তায় নিয়া আমারে হাইকোর্ট দেখাইছে;
যে জন আমারে ভালোবাইসাছে—
গোয়ালন্দ নিয়া আমারে হিলশা খাওয়াইছে…।
এ গানটিতে শোকরানা জ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ সারাদিন কাজ করবার পর অপরাহ্নবেলায় যখন মজুরি পেল শ্রমিকেরা, তখন এ আনন্দসঙ্গীতে মুখর হচ্ছে তারা।
শেষ কথা
জীবনঘনিষ্ঠ বিচিত্র বিষয়াদি নিয়ে গান বেঁধে কোরাসে কোরাসে দিনমজুরদের কর্মচাঞ্চল্য ধরে রাখার সেই দিন আজ আর নেই আধুনিকতার উৎসবে। একদিকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে এগিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে একদল খেটেখাওয়া মানুষের বেকারত্বের হাহাকারে দীর্ণ যুগের হাওয়া বড়ো নিষ্ঠুর। আজও গ্রামাঞ্চলে পুরোনো দিনের কিসসায় ফিরে ফিরে আসে ছাদ পেটানোর গানের স্মৃতি। তখন মন উদাস হওয়াই সার কেবল। যে সময় চলে যায় তা কি আর ফেরে? ফেরে না।
Feature Image: kalerkontho.com References: 01. ঢাকাইয়া আসলি - আনিস আহামেদ, প্রকাশনী - বাংলা একাডেমি। 02. ছাদ পেটানোর গান নিয়ে দু-চার কথা. 03. কালের ভেলায় ছাদ পেটানোর গান. 04. সারি গান | গানের টানে | একাত্তর টিভি.