ভ্রমণ মানুষের জ্ঞান-ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার জন্য যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি বিভিন্ন উপায়ে তার সৌন্দর্য মেলে ধরছে। পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যার ইতিহাস, সৌন্দর্য, মনোরম দৃশ্য মানুষকে আকর্ষণ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – রাইন জলপ্রপাত।
আপনি একবার কল্পনা করুন যে, আপনি ইউরোপের বিখ্যাত রাইন জলপ্রপাতের সামনের দাঁড়িয়ে আছেন। পাহাড়ের গা বেয়ে বা হিমবাহ গলে নেমে আসা জল ধারার অপার সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে উপভোগ করছেন। ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে না? তবে চলুন ঘুরে আসি আজ জলের দুনিয়া থেকে। বিশ্বের বিখ্যাত রাইন জলপ্রপাত নিয়েই আজকের আলোচনা।
সুইজারল্যান্ড একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। দেশটিতে অনেক প্রাচীনতম নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে রাইন জলপ্রপাত অন্যতম। রাইন জলপ্রপাত উত্তর সুইজারল্যান্ডের শ্যাফহাউসেন এবং জুরিখের ক্যান্টনগুলির মধ্যবর্তী সীমান্তে রাইন নদীর উপর অবস্থিত। রাইন নদী চারটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কারণ এটি আল্পস থেকে উত্তর সাগরে প্রবাহিত হয়েছে এবং প্রতিটি দেশই এই নদীকে তাদের নিজস্ব হিসেবে বিবেচনা করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, রাইন জলপ্রপাত শেষ বরফ যুগে গঠিত হয়েছিল। যা আজ থেকে প্রায় ১৪০০০ থেকে ১৭০০০ বছর আগে। রাইন নদী পশ্চিম দিকে ক্লেটগাউতে প্রবাহিত হতো। হিমবাহের গলিত পানির সাথে এটি নুড়ি দিয়ে ভরা হয় তখন। আর এটার গঠন হয়েছিল ১,৩২,০০০ বছর আগে।
রাইন জলপ্রপাত ১৫০ মিটার চওড়া এবং ২৩ মিটার উঁচু। ১৯৬৫ সালের দিকে জলপ্রবাহের গড় ছিল ১২৫০ কিউবিক মিটার। বর্তমানে জলপ্রবাহের গড় অনেকটাই কমে গেছে। গ্রীষ্মকালে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬,০০,০০০ লিটার জল জলপ্রপাতের নিচে পড়ে। আর শীতকালে প্রতি সেকেন্ডে ২,৫০,০০০ লিটার জল জলপ্রপাতের নিচে পড়ে।
নায়াগ্রা জলপ্রপাত, ইগুয়াজু জলপ্রপাত, ভিক্টেরিয়া জলপ্রপাতগুলো বৃহত্তম জলপ্রপাত। কিন্তু রাইন জলপ্রপাতকে ইউরোপের বৃহত্তম জলপ্রপাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য জলপ্রপাতের তুলনায়, রাইন জলপ্রপাতের পানিতে ছোট ছোট ফোঁটা থাকে। শীতকালে এখানে পানির প্রবাহ অনেক কম থাকে।
সাধারণত রাইন জলপ্রপাত জাঁকজমকপূর্ণভাবে দেখা যে কোন দর্শকের ভ্রমণকে সার্থক করে তোলে। তবে সেই অভিজ্ঞতা আরো বেশি স্মরণীয় উঠবে যখন জলপ্রপাতটি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে; যখন রাইন জলপ্রপাতের মূলা শিলাখণ্ড থেকে আতশবাজি ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুঃসাহসীদের জন্য আছে অ্যাডভেঞ্চার পার্ক। যেখানে যাবার জন্য ট্রিটপ পথ অনুসরণ করতে হয়। সেখানে যাতে সহজে ভ্রমণ করতে পারে সেজন্য আরোহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাইন জলপ্রপাতে বৃত্তাকার ট্রেইল নামক একটি জায়গা রয়েছে যা ডাচসন গ্রাম থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।
যেসব পর্যটকরা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে পছন্দ করে তাদের কাছে এই জায়গা অনেক প্রিয়। অনেক পর্যটকরা জলের ধারার খুব কাছে যেতে পছন্দ করে। তাদের জন্য রাইন ফলস বেসিনের উত্তর তীরে পার্কিং পয়েন্ট দেওয়া আছে। তাছাড়া, নৌকা অবতরণ পয়েন্টও রয়েছে।
রাইন জলপ্রপাতে যে কেউ সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। যার ফলে যে কেউই গাড়ি বা সাইকেল দ্বারা খুব সহজেই পরিদর্শন করতে পারে। তাছাড়া, যেসব পর্যটকরা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে পছন্দ করে তাদের জন্য নদীর উভয় পাশে রেলওয়ে ষ্টেশন রয়েছে। প্রায় ১৮৫৭ সালের দিকে জলপ্রপাতের উপর রেল সেতু নিমার্ণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
জলপ্রপ্রাতে পায়ে হেঁটে সহজেই পৌঁছানো যায়। রেল সেতুটি জলপ্রপাতের ঠিক উপরে নদীকে অতিক্রম করে। তাছাড়া পর্যটকরা যাতে রাইন জলপ্রপাত বেসিনের চারপাশে সম্পূর্নভাবে হাঁটতে পারে সেজন্য একটি পথচারী পথও রয়েছে। নদীর দুই ধারে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
রাইন জলপ্রপাতের কাছাকাছি দুটি দূর্গ রয়েছে। একেন ক্যাসেল নদীর বাম তীরে এবং ওয়ার্থ ক্যাসেল ডান তীরে অবস্থিত। ওয়ার্থটি ওয়াটার ক্যাসেল নামেও পরিচিত। ওয়ার্থ ক্যাসেলের প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল খ্রিষ্টীয় ১৩ শতকে। খ্রিষ্টীয় ১৯ শতকের দিকে এটি পূর্ব-পশ্চিমের বাণিজ্য রুটের পয়েন্ট হিসেবে কাজ করতো।
জলপ্রপাতটি ইতিহাসে ঠাঁসা এবং জলপ্রপাতের উপরে টাওয়ারের দুর্দান্ত শ্লোথ লাউফেন সকলের কাছে অনেক প্রিয়। প্ল্যাটফর্ম দেখা ছাড়াও পর্যটকরা রেঁস্তরার সুবিধা এবং স্যুভেনির দোকানগুলোও ঘুরে দেখতে পারবে। তাছাড়া রাইন জলপ্রপাতে সামুদ্রিক প্রাণী রয়েছে। জলের মাছ এই জলপ্রপাতের উপরে উঠতে পারে না কিন্তু ঈল হলো তার ব্যতিক্রম। তারা পাথরের উপরে উঠতে পারে। ঈল হাঁসের সাথে জলে ঘনিষ্ঠভাবে সাঁতার কাটে। যা মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
রাইন জলপ্রপাত ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। প্রতিটি ঋতুতে এটি তার নিজস্ব রূপের পসরা সাজিয়ে বসে যেন। বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাসগুলোতে স্রোতের প্রবাহের মাত্রা থাকে সব থেকে বেশি। হাই রাইন নামে পরিচিত প্রসারিত স্থানে আপনি একই নামের সাথে রাইন নদীর জলপ্রপাত দেখতে পাবেন। পানি নিম্ন স্তরে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এটি মনোরম জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে। এই জল সারাবছর প্রবাহিত হয়।
জলপ্রপাতের উভয়পাশে দেখার জন্য প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। যেখান থেকে জলপ্রপাতের নিখুঁত দৃশ্য দেখা যায়। প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে একটিতে এন্ট্রি ফি চার্জ দিতে হয়। তবে উত্তর প্ল্যাটফর্মটি বিনামূল্যে। জলপ্রপাতের মূহুর্তগুলো ক্যাপচার করে রাখার জন্য কয়েকটি ভিউয়িং পয়েন্টও রয়েছে।
রাইন জলপ্রপাতকে তার পূর্ণ মহিমায় দেখতে হলে গ্রীষ্মকালে যেতে হবে। গ্রীষ্মকালে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য ও জাঁকজমক দেখে পর্যটক এবং স্থানীয়রা বিমুগ্ধ হয়। বেশিরভাগ পর্যটক নৌকায় করে জলপ্রপাতের কাছাকাছি ঘুরতে পছন্দ করে। বহু শতাব্দী ধরে পর্যটকরা রাইন জলপ্রপাত দেখে বিমুগ্ধ হয়ে আসছে।
খ্রিস্টীয় ১৯ শতকের দিকে চিত্রশিল্পী জে. এম. ডব্লিউ টার্নার জলপ্রপাতের ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজ করেন। তাছাড়া তিনি বৃহত্তর ক্যানভাসে চিত্রও এঁকেছিলেন। গীতিকবি এডুয়ার্ড মরিক রাইন জলপ্রপাত নিয়ে কবিতা লিখেছেন। লেখক মেরি শেলি ১৮৪০ সালের দিকে তার ছেলের সাথে ইউরোপ ভ্রমণের সময় রাইন জলপ্রপাত ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ১৮৪৪ সালে জার্মানি এবং ইতালিতে র্যাম্বলস প্রকাশিত একটি ভ্রমণ বর্ণনায় তার সফরের কথা বলেছেন।
আপনি পাখি প্রেমিক হলে, সাথে করে অবশ্যই একজোড়া দূরবীন নিয়ে যাবেন। বেশিরভাগ পাখির প্রজাতি গ্রীষ্মকালে সকালের সময় দেখতে পাওয়া যায়। রাইন জলপ্রপাতের আবাসন ব্যবস্থা অনেক উন্নত। পর্যটকদের থাকার জন্য অনেক উন্নতমানের হোটেল রয়েছে। যেমন টাউনশিপ হোটেল, বিএন্ডবি হোস্টেল ইত্যাদি রয়েছে। যেখানে পর্যটকরা সহজেই রাত্রিযাপন করতে পারবে।
প্রতিবছর এক মিলিয়নের বেশি পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। যার ফলে দেশটির অর্থনৈতিক মূল্য বেড়েই চলছে। পর্যটকরা শুধু রাইন জলপ্রপাত নয়, রাইন নদীকে ঘিরে থাকা অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গ্রামগুলো দেখতে আসে। তাছাড়া সম্পূর্ণ পানির প্রবাহ ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয় । তাহলে গড়ে প্রায় ১২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তাই রাইন জলপ্রপাতের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
Feature Image: planetware.com
তথ্যসূত্র:
01. The-Rhine Falls.
02. The-Rhine-falls-Switzerland.
03. top-10-facts-about-the-rhine-falls-in-switzerland.