হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা: গল্প নাকি সত্যি?

559
0
শিল্পী জেমস এ্যালডার ক্রিস্টির আঁকা 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'। Image source: Flickr.com.

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। সকলের পরিচিত গল্প। ইঁদুর তাড়াতে শহরে এক বাঁশিওয়ালার আগমন ঘটে। তারপর তার বাঁশির সুরে শহরের সকল শিশুর চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া। কমবেশি সবাই বেশ আনন্দ নিয়ে গল্পটি শুনেছে কিংবা পড়েছে ছোটবেলায়।

কিন্তু আজ যদি এসে হুট করে কেউ বলে ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ নিছক একটি গল্প নয়, বরং বাস্তব সত্য ঘটনা! তবে ছোটবেলার সেই প্রিয় গল্পটিই এক অস্বস্তিকর তীক্ষ্ণ অনুভূতির জন্ম দেবে।

গল্পটিতে ১২৮৪ সালে জার্মানির হ্যামিলন নামক একটি ছোট শহরের কথা উঠে আসে। শহরে হঠাৎ প্রচন্ডভাবে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যায়। ইঁদুরের উপদ্রবে বিরক্ত হয়ে শহরবাসী মেয়রের কাছে এই সমস্যার সমাধান চায়।

একসময়ে এক বিচিত্র রঙচঙে কোট পরিহিত বাঁশিওয়ালা এসে বলে, সে ইঁদুরগুলোকে তাড়াতে পারবে। তবে এর বিনিময়ে সে কিছু অর্থ পারিশ্রমিক হিসেবে দাবি করে। মেয়র দাবি মেনে নিয়ে তাকে ইঁদুর তাড়ানোর পর পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলে।

ইঁদুরের আক্রমণে অতিষ্ঠ হ্যামিলন নগরবাসী। Image source: gutenberg.org

মেয়রের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজানো শুরু করে। তার বাঁশির সুরে শহরের সমস্ত ইঁদুর এক হয়ে যায় এবং তার পিছু পিছু যেতে শুরু করে। বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাতেই থাকে এবং ইঁদুরগুলোকে নিয়ে শহর থেকে দূরে নিয়ে চলে যায়।

নগরবাসী ফিরে পায় তাদের পুরনো স্বাভাবিক জীবন। কর্তব্য শেষ করার পর তিনি তার পারিশ্রমিক নিতে ফিরে আসেন। কিন্তু বারবার অনুরোধের পরও মেয়র পারিশ্রমিক দিতে অস্বীকৃতি জানান।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাঁশিওয়ালা তার বাঁশিটিকে উল্টো করে বাজাতে শুরু করে। এতে করে শহরের সমস্ত শিশু একত্রিত হয়ে যায় এবং তার পিছু পিছু হ্যামিলন থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়।

‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ বই-এর প্রচ্ছদ। Image source: read.gov

জনপ্রিয় এই কাহিনিটিকে বহু বছর ধরে কেবল গল্পই ভাবা হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বের হয়ে আসতে থাকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ, যা থেকে সন্দেহ হয় প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সত্য ঘটনা। হ্যামিলনের একটি চার্চে কাঁচের জানালায় গল্পটি চিত্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা ১৩০০ সালের।

এটি ১৬৬০ সালে ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কিছু লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটি হলো লুয়েনবার্গ পান্ডুলিপি (১৪৪০-৫০ খিস্টাব্দ)। এতে পাওয়া যায়,

১২৮৪ সালে, ২৬ জুন সেন্ট জন এবং পলের দিনে একজন বিভিন্ন রঙ-এর পোশাক পরা বাঁশিওয়ালার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে হ্যামিলনে জন্ম নেওয়া ১৩০ জন শিশু হারিয়ে যায়।

১৩৮৪ সালের হ্যামিলন শহরের একটি রেকর্ডে পাওয়া যায়,

প্রায় ১০০ বছর হয়েছে, আমাদের শিশুরা হারিয়ে যাওয়ার।

ধারণা করা হয়,ইঁদুরের প্রসঙ্গটি মূল ঘটনার অংশ ছিল না। বরং এটিকে গল্পের আকার দেওয়ার জন্য অংশটি যুক্ত করা হয়েছে।

হ্যামিলনের চার্চের জানালা থেকে পাওয়া মধ্যযুগে অলংকৃত ছবি। Image source: Wikimedia.org

বিভিন্ন তত্ত্ব এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে হ্যামিলনে ঠিক কী হয়েছিল তার বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যার মতে, ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ কোনো আসল ব্যক্তি নয়, বরং মূলত কোনো অন্য অশনির রূপক। গবেষকরা বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

একটি গবেষণা অনুযায়ী কোনো প্রাকৃতিক কারণে হ্যামিলনে শিশুদের মৃত্যু ঘটেছিল বলে মন্তব্য করা হয়। ইতিহাসও বলে, ১৩৪৮ সালের দিকে ইউরোপে প্লেগ রোগ স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ মহামারীর আকার ধারণ করে, যা প্রায় ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ হরণ করে।

একে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নাম দেওয়া হয়। যেহেতু প্লেগ রোগের জীবাণু বহনকারী হিসেবে ইঁদুরকে দায়ী করা হয়, সেহেতু এই থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, উক্ত কাহিনীটিই বর্ণনায় ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে ইঁদুরের প্রসঙ্গটি এসেছে।

‘ব্ল্যাক ডেথ’ মহামারিতে মৃতদের অসংখ্য গণকবরের মধ্যে একটি। Image source: smithsonianmag.com

অন্য একটি ব্যাখ্যা বলে, শিশুদেরকে ‘ক্রুসেড’-এ পাঠানো হয়েছিল। একাদশ থেকে তেরোদশ শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের দ্বারা প্রায় সাতটি বৃহৎ এবং আরো বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্রুসেড পরিচালনা করতে দেখা যায়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমে মুসলিমদের সড়িয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে পূর্ণবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদেরও এতে অংশগ্রহণ করানো হয়; যার নাম দেওয়া হয় ‘শিশুদের ক্রুসেড’। ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে হাজার হাজার শিশু পরিবার ছেড়ে জেরুজালেমের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এদের সাথে পরবর্তীতে কী হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে আর জানা যায়নি। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে এদের প্রায় সবার জীবনেই দূর্দশা নেমে আসে।

ধারণা করা হয়, এরা জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছতেও পারেনি। অনেককে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়, অনেকে পথ হারিয়ে ফেলে। পুরো ইউরোপ থেকেই যেসব শিশুরা ক্রুসেডের উদ্দেশ্যে ঘরছাড়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে খুবই অল্পসংখ্যক শিশু ঘরে ফিরে আসতে পেরেছিল।

শিশুদের ক্রুসেডের অলংকৃত ছবি। Image source: sciencephoto.com.

১১০০-১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে জার্মানদের একটি অংশ পূর্ব ইউরোপে দেশান্তরিত হয়, যা জার্মানি ভাষায় ‘অস্তসিদলুং’ বলে পরিচিত। অনেকে মনে করেন, হারিয়ে যাওয়া শিশুরা মূলত এই ঘটনার অংশ। এই পরিবারগুলো টানসেলভেনিয়া আশ্রয় নেয় বলে ধারণা করা হয়।

তবে জার্মান ভাষাবিদ উডলফ-এর মতে, বার্লিনের আশেপাশের অঞ্চলেই হয়েছিল ঘর ছেড়ে আসা মানুষগুলোর নতুন আবাস। আশ্চর্যজনকভাবে এই দাবিকে সঠিক প্রমাণের মতো যুক্তিও পাওয়া যায়। হ্যামিলনে তৎকালীন সময়ে যেসব পারিবারিক নাম বহুলভাবে প্রচলিত ছিল, সেই নামগুলো পরবর্তীতে বার্লিনের আশেপাশের উকারমার্ক এবং প্রিগনিটজে লক্ষ্য করা যায়।

আবার অন্য একটি ব্যাখ্যা বলে, এই গল্পের মূল সূত্র ইউরোপের ঘটনাবহুল সেন্ট জনস নৃত্য উন্মাদনার সাথে জড়িত। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপে বিভিন্ন রাস্তায় মানসিক বিকারগ্রস্ত নৃত্যরত দল দেখা যায়, যারা দিনের পর দিন ক্লান্ত হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত নাচতেই থাকতো। প্রচুর মানুষ নাচতে নাচতে স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাকের স্বীকার হয়ে মারাও যায়। এ ঘটনার কারণ ঠিক কী ছিল তা নিয়ে এখনো চলছে বিতর্ক।

অনেকে মনে করে এটি কোনো ধর্মীয় আবেগ অথবা উন্মাদনার ফল। তবে এর কারণ হিসেবে বহুলভাবে একটি ফাংগাসকে দায়ী করা হয়, যা লিসারজিক এসিড এবং অ্যারগোটামাইনের মতো ক্ষতিকর রাসয়নিক বস্তু বহন করে। আধুনিক দিনে এসব রাসয়নিক বস্তু এলএসডিতে পাওয়া যায়। তাই বলা হয়, কোনোভাবে ছত্রাকটি গ্রহণ করার মাধ্যমে হ্যালুসিনেশনের কারণে এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার জন্ম।

ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্রাণ হরণকারী ‘সেন্ট জনস নৃত্য উন্মাদনা’ এর অলংকৃত ছবি। Image source: bigthink.com.

আবার কেউ মনে করেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ছিল প্রকৃতপক্ষে কোনো পেডোফাইল (মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি, যে শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে)। একটি দল অবশ্য এও মনে করে, বহিরাগত কেউ নয় বরং কঠিন দারিদ্র্যে আক্রান্ত পিতামাতারা নিজেরাই তাদের শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

বিখ্যাত সেই হ্যামিলন শহর কিন্তু এখনো টিকে রয়েছে। বর্তমান সময়ে হ্যামিলন প্রায় ৬০ হাজার মানুষের এক নগর। আজও হ্যামিলনকে দেখলে মনে হয় কোনো রূপকথার শহর। গথিক নকশার ত্রিকোণাকার ম্যানরহাউজ, রেঁনেসা যুগের ছোঁয়া, নানান রঙ্গে মাতানো কাঠের স্থাপনা-সব মিলিয়ে হ্যামিলন যেন শিল্পীর আঁকা মধ্যযুগের নয়নাভিরাম শহর।

হ্যামিলনে ঘুড়লে যে কেউই শহরজুড়ে বিখ্যাত এই গল্পের থিমে বহু আয়োজন দেখতে পাবে। রেস্টুরেন্টে ‘রেট টেইল’ নামে বিশেষ খাবারের পরিবেশনা, বেকারিতে ইঁদুরের আকারে বানানো খাবার, স্থানীয় জাদুঘরে গল্পটির মঞ্চায়ন, এমনকি মানুষের পোশাকআশাকেও বাঁশিওয়ালা কিংবা ইঁদুরের বিভিন্ন ছবি দেখতে পাওয়া যায়। হ্যামিলনে প্রতি বছরই ২৬ জুন ‘ইঁদুর ধরার দিন’ পালন করা হয়। ২০০৯ সালে পর্যটকদের জন্যে একটি ফেস্টিভ্যালেরও আয়োজন করা হয়েছিল।

‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ গল্পটি কেবল গল্প নাকি সত্যিই হ্যামিলনে নেমে এসেছিল কোনো কালো অধ্যায়-তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা রয়েই যাবে। যদি সত্যি হয়েই থাকে তবে ঠিক কোনো অন্ধকার ঘটনাকে শিশুতোষ গল্প দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছিল! আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে ১৩০ জন ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সাথে ঠিক কী হয়েছিল, সে সত্য জানার আগ্রহ সবার থাকবে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আজও হ্যামিলনে ‘বংগেলোসোসট্রাসে’ নামে একটি রাস্তা রয়েছে, যাতে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজতে দেওয়া হয় না, কোনো গান গাইতে দেওয়া হয় না। মনে করা হয়, এই রাস্তাটিতেই শেষবার হ্যামিলনের হারিয়ে যাওয়া শিশুদের দেখা গিয়েছিল।

 

Feature image: wikidata.org 
References: 

01. The Grim Truth Behind The Pied Piper. 
02. Pied Piper Hamelin. 
03. Middle Ages Crusades. 
04. Middle Ages Black Death.