গণিতে ভালো ফলাফলের নতুন পন্থা সঙ্গীত

364
0
গণিতে বেশি নম্বর অর্জনের নতুন পন্থা সঙ্গীত image source: Johnson String Instrument

প্রাত্যহিক জীবনে বহু মানুষ কমবেশি সঙ্গীত শুনে থাকে; হোক তা রেডিও, টেলিভিশন, স্মার্টফোন কিংবা রাস্তায় চলার পথে বাজতে থাকা কোনো দোকানে। এমন অনেক মানুষই আছেন যারা কাজ করার সাথে সাথে সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করেন, এতে তাদের আর কিছু হোক বা না হোক, কাজের একঘেয়েমিটা কেটে যায়। ঠিক তেমনই অনেক শিক্ষার্থীও গণিতের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সময় সঙ্গীত শুনে থাকে। কিন্তু এই সঙ্গীতই কিনা হতে পারে গণিতে ভালো ফলাফল অর্জনের এক নতুন পন্থা! শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এই কথাই বলছে বিগত ৫০ বছর ধরে করা গবেষণার ফলাফল।  

সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কাছে গণিতকে আরো আনন্দদায়ক করে তোলে। গণিতের নানা সমস্যা সমাধানে তাদের আরো মনোযোগী হতে এবং গণিতের ভয় বা উদ্বেগ কমাতেও সাহায্য করে। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা যায়, যেসকল বাচ্চারা মিউজিকে ভালো, তারা গণিতেও বেশ ভালো হয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গীত শেখানোর মাধ্যমে গণিতে কোনো উন্নতি সাধন হয় কিনা তা ছিল অস্পষ্ট। 

এই অস্পষ্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে আন্তালিয়া বেলেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তুর্কি গবেষক ডা. আয়কা আকিন, ১৯৭৫ সাল হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই বিষয়ের উপর প্রকাশিত গবেষণার একাডেমিক ডাটাবেস অনুসন্ধান করেন। 

গণিত ও সঙ্গীতের একীভূতকরণ Image source: UCL

গবেষণার শুরু 

ডা. আয়কা আকিন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ৭৮,০০০ তরুণ-তরুণীকে একত্র করেন এবং সারাবিশ্ব থেকে ৫৫টি গবেষণার ফলাফল একত্রিত করেন। এই গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মেটা বিশ্লেষণ করা হয়। মেটা বিশ্লেষণ হলো মূলত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ইতিমধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন গবেষণার তথ্যকে সংগ্রহ, সংকলন এবং সংশ্লেষণ। 

এই গবেষণার মেটা বিশ্লেষণে মোট তিন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হস্তক্ষেপ ছিল: প্রমিত সঙ্গীতের হস্তক্ষেপ (সাধারণ সঙ্গীত পাঠ, যেখানে শিশুরা গান গায়, শোনে এবং রচনা করে থাকে), যন্ত্রসংক্রান্ত বাদ্যযন্ত্রের হস্তক্ষেপ (যে পাঠে শিশুরা পৃথকভাবে যন্ত্র বাজানো শেখে) এবং সঙ্গীত-গণিত সমন্বিত হস্তক্ষেপ, যেখানে গণিত পাঠের সাথে সঙ্গীতকে একীভূত করা হয়।

এই হস্তক্ষেপে অংশগ্রহণকৃত শিক্ষার্থীদের, অংশ নেয়ার পূর্বে এবং পরে দুইটি গণিত পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। তাদের নম্বরের পরিবর্তনকে সেই সকল তরুণ-তরুণীদের সাথে তুলনা করা হয় যারা এই হস্তক্ষেপে অংশ নেয়নি। গবেষণার শেষে দেখা যায় যে, তিন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের হস্তক্ষেপের মধ্যে সঙ্গীত-গণিত সমন্বিত হস্তক্ষেপে অংশ নেয়া ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে, তাদের প্রাপ্ত নম্বর যেসকল তরুণ-তরুণী এই হস্তক্ষেপে অংশ নেয়নি তাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। 

প্রায় ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছিল এবং প্রায় ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা প্রমিত সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিল তাদের ফলাফল, যেসকল তরুণ-তরুণীর সঙ্গীতের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না তাদের ফলাফলের চেয়ে বেশ ভালো ছিল। 

সঙ্গীতের পাঠ বোঝার মাধ্যমে গণিতে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় Image source: Classic FM

গবেষণার ফলাফল 

এই গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত করে যে, সঙ্গীত গাণিতিক সমস্যা শেখার ক্ষেত্রে বেশ সাহায্য করে। বিশেষ করে, যেসকল অল্পবয়স্ক শিক্ষার্থী, যারা গণিতের মৌলিক ধারণাগুলো শিখছে তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির এক বড় প্রভাব রয়েছে। 

ডা. আকিন, যিনি তুরস্কের ন্যাশনাল মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন এবং আন্তালিয়া বেলেক ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন গবেষণাটি চালিয়েছিলেন, তিনি উল্লেখ করেন যে গণিত এবং সঙ্গীতের মধ্যে ব্যাপক মিল রয়েছে, যেমন প্রতীকের প্রতিসাম্যের ব্যবহার। উভয় বিষয়ের জন্য বিমূর্ত চিন্তা এবং পরিমাণগত যুক্তিও প্রয়োজন। 

গণিত সঙ্গীত পড়তে সাহায্য করে 

সঙ্গীতকে কিছু অংশে বিভক্ত করা হয়ে থাকে এবং প্রতিটি অংশেরই নির্দিষ্ট পরিমাণ বিট থাকে। এই পরিমাণটি সময়ের গাণিতিক বিভাজনের সাথে তুলনীয়। সঙ্গীতের প্রতিটি অংশে একটি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ রয়েছে যা তার ছন্দ সংক্রান্ত তথ্য দেয়, যেমন প্রতিটি অংশে কতগুলো বিট রয়েছে। 

একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে, সঙ্গীত সঠিকভাবে গণনা করার জন্য ভগ্নাংশ এবং নোটের মান বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এটি শাস্ত্রীয়, জ্যাজ, রক, হিপ হপ বা অন্য যেকোন ধরনের সঙ্গীত হোক না কেন, এতে গণিতের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। 

সঙ্গীতের অনুপাত Image source: Nepali and Mandarin Motion-Edublogs

ঠিক বিপরীতভাবে, পাটিগণিত সঙ্গীতের মাধ্যমে শেখানোর ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা গণিতের মৌলিক ধারণাগুলো যেমন- ভগ্নাংশ এবং অনুপাতগুলো সঙ্গীতেরও মৌলিক বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের সঙ্গীতের নোটগুলোকে ভগ্নাংশ হিসাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে এবং সঙ্গীতের বেশ কয়েকটি বার তৈরি করতে একসাথে যুক্ত করা যেতে পারে। সঙ্গীত তত্ত্বে, একটি বার (বা পরিমাপ) হলো সময়ের অবিভক্ত একক যাতে একটি নির্দিষ্ট টেম্পোতে বাজানো নির্দিষ্ট সংখ্যক বিট থাকে। 

গানের ফ্রিকোয়েন্সিতে লুকিয়ে আছে গণিত 

বিখ্যাত পিথাগোরাস আবিষ্কার করেছিলেন যে, বিভিন্ন ওজন এবং কম্পন বিভিন্ন রকমের শব্দ তৈরি করে। এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে জানা যায় যে, একটি স্পন্দিত স্ট্রিং এর পিচ সরাসরি তার দৈর্ঘ্যের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, পিচকে এর দৈর্ঘ্য দ্বারাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যদি একটি স্ট্রিংকে অর্ধেক করে কাটা হয়, পিচটি আসলটির চেয়ে এক স্বরগ্রাম বেশি হবে। এর মানে হল যে, স্ট্রিং ছোট হওয়ার সাথে সাথে পিচটি উচ্চতর হবে।  

গণিত এবং সঙ্গীতের প্যাটার্নের মাঝে সম্পর্ক

গণিত এবং সঙ্গীতের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো প্যাটার্নে। উদাহরণস্বরূপ, সঙ্গীতে শ্লোক এবং কোরাস একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে পুনরাবৃত্তি হয়, ঠিক যেভাবে গণিত অজানাকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্যাটার্নের ব্যবহার করে। সঙ্গীতে বিভিন্ন গাণিতিক ঘটনার প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে জ্যামিতি, সংকেত প্রক্রিয়াকরণ, ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস, এমনকি ত্রিকোণমিতিও। প্রকৃতপক্ষে, আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় যে, যখন সঙ্গীত কিছু গাণিতিক কাঠামো দেখায়, তখন এটি আরও জনপ্রিয় হতে থাকে।   

সঙ্গীত অধ্যয়ন এবং চিন্তায় সাহায্য করে 

সঙ্গীত-গণিত সমন্বিত পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে গণিত এবং সঙ্গীতের একটা সংযোগ তৈরি হয়। এই সংযোগ শিক্ষার্থীদের গণিত অন্বেষণ, বোঝা এবং ব্যাখার ক্ষেত্রে এক বিশেষ সুযোগ প্রদান করে। এছাড়াও, সঙ্গীতের সাথে গণিত একীভূত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আনন্দ অনুভব করে থাকে। ফলে গণিত সম্পর্কিত তাদের যেকোনো উদ্বেগ সহজেই কমানো যায়। 

সঙ্গীত-গণিত সমন্বিত পাঠ শিক্ষার্থীকে মনোযোগী করে তোলে Image source: Funderstanding

যেকোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র উপাদান একজন ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ মনে রাখতে সাহায্য করতে পারে। এমনকি কাজ বা অধ্যয়নের সময় সঙ্গীত বাজানোর মাধ্যমে একটি মনোযোগী শিখনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। কর্ণাটিক সঙ্গীতের মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ফোকাস এবং একাগ্রতার পরিবেশ তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে। 

বর্তমানে আন্টালিয়া বেলেক ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ডা. আকিন এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, সামগ্রিকভাবে সংগীতের নির্দেশনা গণিতের কৃতিত্বের উপর সামান্য থেকে মাঝারি প্রভাব ফেলে এবং সমন্বিত পাঠগুলো শিক্ষার্থীদের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে। 

গণিত যেমন সঙ্গীত শেখাকে সহজ করে তোলে, ঠিক তেমনি সঙ্গীতও গণিত শেখাকে সহজ করে দেয়। তাই, যেকোন শিক্ষার্থী চাইলেই সঙ্গীত উপভোগ করার সাথে গণিতের চর্চার মাধ্যমে তার দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।  

 

 

 

Feature Image: johnsonstrings.com 
References: 

01. Combining maths with music leads to higher scores. 
02. Combining math with music leads to higher test scores. 
03. Music, Math Combo Leads to Higher Test Scores Based on 50-Year Research. 
04. The functional relationship between math and music.