বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে টাইম ট্র্যাভেল করার ইচ্ছা আমাদের সবারই মনে কোন না কোন সময় জেগে থাকলেও সঠিক উপায় এখনও আবিস্কার হয়নি। তাই টাইম ট্র্যাভেল অসম্ভব হলেও কল্পনার পাল তুলে আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ছোঁয়ায় ভবিষ্যতকে গড়ে দেখিয়েছে পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর দুবাই।
এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে দ্য ফিউচার মিউজিয়াম, যেখানে ভ্রমণ করলে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে ২০৭১ সালে। শুনতে অবাক লাগলেও এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে দুবাই। তবে এখানে আপনি নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে না পারলেও দেখতে পারবেন আমাদের প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ। উপবৃত্তাকার এই জাদুঘর সম্পর্কেই জানতে পারবেন আজকের এই আয়োজনে।
দ্য ফিউচার মিউজিয়ামের ইতিবৃত্ত
২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। দুবাই ফিউচার ফাউন্ডেশনের উদ্যগে এটি তৈরি করা হয়েছে। এটি ২৫২ ফুট দৈর্ঘ্যের ৭ তলা বিশিষ্ট একটি জাদুঘর যা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ইতিমধ্যেই এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ১৪টি জাদুঘরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
৩,২৩,০০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে নির্মিত এই স্তম্ভবিহীন কাঠামোটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে ৯ বছর। দ্য ফিউচার মিউজিয়ামের শুধুমাত্র সামনের দিকটাই তৈরি করতে সময় লেগেছে ১৮ মাসেরও বেশি।
‘কিল্লা ডিজাইন’ নামক সংস্থার শন কিল্লা এই ভবনটির প্রধান স্থপতি। আধুনিক কম্পিউটার ব্যবহার করে গড়া নকশা এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিদর্শন হল দ্য ফিউচার মিউজিয়াম। পুরো ভবনটি রোবটের মাধ্যমে বিশেষ ভাবে তৈরি করা ১০২৪টি অংশ দিয়ে গঠিত।
স্টেনলেস স্টিল এই অংশগুলো তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও চারটি স্তর নিয়ে গঠিত এমন একটি সংকর ধাতু আছে যা ১৬টিরও বেশি ধাপের মধ্য দিয়ে উৎপাদিত হয়। এছাড়াও গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে।
১০২৪টি অংশ দিয়েই কেন গঠন করা হয়েছে? এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মনে জেগেছে। এর পেছনের কারন হচ্ছে ১০২৪ এক কিলোবাইটকে নির্দেশ করে। প্রতিটি অংশ একটি অন্যটি থেকে দেখতে একদম ভিন্ন।
প্রাথমিক নকশার সময়, স্থপতি টিম বিল্ডিংয়ের পৃষ্ঠে ক্যালিগ্রাফি সেট করতে কমপ্লেক্স 3D মডেলিং সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেছিল এবং ক্যালিগ্রাফির প্রাচীন নিয়ম মেনে চলার জন্য প্রতিটি অক্ষরকে সেভাবেই অ্যাডজাস্ট করে বসানো হয়েছিল।
রাতে, ৮.৭ মাইল প্রোগ্রামেবল এলইডি লাইট ক্যালিগ্রাফিকে আলোকিত করে, যা এটিকে দুবাই শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি ড্রামাটিক ভিজুয়াল সংযোজন তৈরি করে।
পুরো কাঠামোতেই যে আরবি ক্যালিগ্রাফি বসানো রয়েছে সেগুলো তিনটি মূল্যবান কোটেশন নির্দেশ করে। কিল্লা এই ক্যালিগ্রাফিগুলোকে ‘জাদুঘরের জানালা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। একটি হচ্ছে-
“The future belongs to those who can imagine it, design it and execute it. It isn’t something you await, but rather create.”
যার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়-
“আমরা শত শত বছর বাঁচতে পারি না, তবে আমাদের সৃজনশীলতার সৃষ্টিগুলি আমাদের চলে যাওয়ার পরেও থেকে যেতে পারে”।
সবগুলো কোটেশনই আরব আমিরশাহির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী তথা দুবাইয়ের শাসক এবং বিখ্যাত কবি এইচএইচ শেখ মোহাম্মাদ বিন রাশিদ আল মাখতুমের দূরদর্শিতার ছাপ রয়েছে। গোটা ভবনের আলোকসজ্জার দৈর্ঘ্য ১৪ কিলোমিটার। এছাড়াও এই মিউজিয়ামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য নিজস্ব সৌর পার্ক রয়েছে যা ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।
যা যা দর্শনীয়
বিভিন্ন ভার্চুয়াল এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি, বিগ ডাটা অ্যানালাইসিস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং মানুষের মেশিন ইন্টারঅ্যাকশন ইনস্টলেশন এবং প্রদর্শন ব্যবহার করা হয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরটি পাঁচটি চ্যাপ্টারে বিভক্ত। যা দর্শনার্থীদের ভবিষ্যতের ভ্রমণে নিয়ে যায়।
প্রথম অধ্যায়ে গ্যালাক্সির বাইরের প্রান্তে একটি স্পেস-স্টেশন দেখা যাবে। এখানে উপরে রয়েছে মহাকাশের থিমযুক্ত ‘ওএসএস হোপ এক্সপেরিয়েন্টাল ডিসপ্লে’। ২০৭১ সালে একটি বিশাল মহাকাশ স্টেশনের ভিতরের জীবনযাত্রা কেমন হতে পারে তা চিত্রিত হয়েছে। ‘ওএসএস হোপ’ মূলত দর্শনার্থীদের মনে ভবিষ্যতের আশা জাগায় ।
দ্বিতীয় চ্যাপ্টার দর্শকদের হিল ইনস্টিটিউটে নিয়ে যায়, এখানে কলম্বিয়ার লেটিসিয়াতে অ্যামাজনের একটি নিরক্ষীয় বনভূমির প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছে।। এটি “ভল্ট অব লাইফ” যা এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ।
এছাড়াও আছে ২৪০০ প্রজাতির DNA লাইব্রেরি সমন্বিত একটি আলোকিত নিমজ্জিত ইনস্টলেশন, যা বিশ্বের জীববৈচিত্র্য ক্যাটালগ করার জন্য লক্ষ লক্ষ প্রজাতি থেকে খুব যত্ন সহকারে বাছাই করা হয়েছে, সেইসাথে আছে একটি পরীক্ষামূলক প্রজাতি পরীক্ষাগার।
দর্শনার্থীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দেখতে পারবে এখানে। পরবর্তী চ্যাপ্টারগুলোতে ভবিষ্যতের অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো দেখতে পারবে, যেমন “আল ওয়াহা” তে দর্শকদের জন্য রয়েছে এমন একটি পরিসরে আত্মান্বেষণ করার সুযোগ যা তাঁদের অনুভূতিকে উদ্দীপিত করবে।
দর্শনার্থীদের সবশেষে নিয়ে যাওয়া হবে ‘ফিউচার হিরোজ’ নামক চ্যাপ্টারে। এখানে তরুণ প্রজন্ম তাদের মনকে নিজেদের এবং চারপাশের বিশ্বকে নতুন করে আবিষ্কার করতে উৎসাহ যোগাবে। একটি সম্পূর্ণ ফ্লোর শিশুদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে তারা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সমাধান করার সুযোগ পাবে।
এই মিউজিয়ামে একটি লেকচার হল রয়েছে। যেখানে ৩৪৫ জন দর্শনার্থী বসতে পারবে। এছাড়াও আছে একটি মাল্টি ইউজ হল যেখানে এক হাজার লোক বসতে পারে।
টিকেটের দাম এবং সময়সূচি
দ্য ফিউচার মিউজিয়াম সকালে ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সবাইকে এখানে আসার পূর্বেই টাইম স্লট অনুযায়ী বুকিং দিয়ে আসতে হবে। তিন বছরের নিচে শিশুদের জন্য এন্ট্রি ফি একদম ফ্রি। তিন বছরের উপরের সবাইকে এন্ট্রি ফি দিয়েই প্রিবুকিং করতে হয়। টিকেট প্রাইজ ডলারে ৪০.৪৭ এবং বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪১৫৩ টাকা।
এছাড়াও আছে হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা, মিউজিয়াম অথরিটির সাথে কথা বলে এই সুবিধাটি নেওয়া যাবে শর্তসাপেক্ষে। পুরো মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে ২-৩ ঘণ্টা হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে।
মহাকাশ পর্যটনের যান থেকে শুরু করে, ভূপৃষ্ঠের ৬০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত ওএসএস স্পেস স্টেশন, আন্ডারস্কিন পেমেন্ট চিপ,সাইবারডগ, ভাইরাস প্রতিরোধী পোশাক, ড্রোন,পাখিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ রোবট, ২৪০০ প্রাণীর ডিএনএ ব্যাঙ্ক, কী নেই এখানে? তাই এই জাদুঘরে হাজির হলে আক্ষরিক অর্থেই মনে হবে যেন এসে পড়েছেন ভবিষ্যতে।
Feature Photo: Shutterstock Sources: 01. Museum of the Future. 02. Ahmad Alnaji Museum of the Future // Killa Design. 03. What Exactly Is a ‘Museum of the Future’? 04. Museum Of the Future- VisitDubai. 05. Museum Of The Future- TripAdvisor.