‘Man fears time, but time fears the Pyramids.’
‘মানুষ সময়কে ভয় পায়, আর সময় ভয় পায় পিরামিডকে।’
– মিশরীয় প্রবাদ বাক্য
মিশর নামটি শুনলে প্রথমেই মনে পড়ে সুবিশাল উচ্চতা নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডের কথা। আর পিরামিড বলতেই ‘গিজার পিরামিড।’ প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে তৈরি এই পিরামিডগুলো সবসময়ই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। কিভাবে তৈরি হলো এই পিরামিড? সেই প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান যখন আজকালকার মতো এত উন্নত ছিল না, তখন কিভাবে বিশাল বিশাল ওজনের এই পাথরগুলো এত দূর থেকে বয়ে নিয়ে এসে স্তরে স্তরে সাজানো হলো? পিরামিড কি আসলেই মানুষের তৈরি? নাকি এর পেছনে রয়েছে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীদের হাত?
এসব প্রশ্ন আজও তাড়া করে ফেরে কৌতুহলী মানব মনকে। এক অমোঘ রহস্যের সঞ্চার করে মানুষের মনে। যদিও সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা কিছু রহস্যের সমাধান করেছেন। তথাপি, রহস্য প্রিয় মানব মনের পিরামিডের প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। সেই আগ্রহ থেকেই মানুষ ছুটে যায় মিশরে। পাহাড়সম উচ্চতার পিরামিডের সামনে দাঁড়িয়ে ভেদ করতে চায় এর রহস্য।
কোনোকিছুই যেন পিরামিডের অজেয়তার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। হোক সেটা মানুষ অথবা সময়। সময়ের ভয়কে জয় করে পিরামিড হয়েছে অজেয়। সময় তো অনেক আগেই পরাজিত হয়েছে। তবে, মানুষও কিন্তু পিরামিড ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল। ১২ শতকে কুর্দির শাসক রাজা আল আজিজ পিরামিডের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। কিন্তু বিশালাকৃতির এই স্থাপত্য ধ্বংস করতে ব্যর্থ হন তিনি। এরপরও বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষ পিরামিড ধ্বংস করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তো উনিশ শতক থেকে আজ পর্যন্ত পিরামিড পৃথিবীর মনুষ্যসৃষ্ট প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় স্থান করে আছে।
গিজার পিরামিডের অবস্থান
পিরামিডের দেশ হিসেবে পরিচিত মিশরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট বড় প্রায় ১৩০টিরও বেশি পিরামিড। তবে পিরামিড বলতে সাধারণত গিজার পিরামিডকেই বুঝে থাকে সবাই। যা গিজার কবরস্থান নামেও পরিচিত। নীলনদ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে গিজা মালভূমির উপর এর অবস্থান।
যা মিশরের রাজধানী কায়রো শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের মরুভূমিতে অবস্থিত। এখানকার পিরামিডগুলো হচ্ছে প্রাচীন মিশরের রাজাদের সমাধিস্থল। মূলত ফারাও রাজাদের মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়েছিল এইসব পিরামিডে। ডের ম্যানুলিয়ান বলেছেন গিজার পিরামিড সম্পর্কে বলেন—
মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে আপনি যা কিছু জানতে চান, তা গিজার পিরামিডের দেয়ালে পাওয়া যায়।
গিজার পিরামিড বলতে সাধারণত ফারাও খুফুর পিরামিডকেই বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু গিজার পিরামিড মূলত একটি চত্বর। এখানে রয়েছে মোট ৩টি পিরামিড–খুফু, খাফরে ও মেনকাউরের পিরামিড। এই তিনটি পিরামিডের সমষ্টিকে গ্রেট পিরামিড বা বৃহৎ পিরামিড নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও এখানে রয়েছে কয়েকটি সমাধি ও পাহারারত দ্য গ্রেট স্ফিংস।
খুফুর পিরামিড
এটি মিশরের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো পিরামিড। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে ফারাও খুফুর দ্বারা এটি নির্মিত হয়েছিল। তাই বৃহৎ এই পিরামিডটিকে খুফুর পিরামিড নামে অভিহিত করা হয়।
গবেষক ও পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এই পিরামিডটি প্রায় ৭৫৫ বর্গফুট জমির ওপরে স্থাপিত। পিরামিডটির প্রতিটি দিক কম্পাসের চারটি দিক ভিত্তিক। যথা: পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ। এর উচ্চতা প্রায় ৪৮১.৪ ফুট।
পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল বিশাল ওজনের পাথরখণ্ড দিয়ে। প্রতিটি পাথরখণ্ডের ওজন প্রায় ২.৫ টন। এতে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন পাথরের ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পাথরের ব্লকটির ওজন প্রায় ৮০ টন। এই পিরামিডটির ওজন ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু দালান বুর্জ খলিফার চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বেশি।
খুফুর পিরামিড তৈরি করা হয়েছে চুনাপাথর এবং গ্রানাইট পাথর দিয়ে। গ্রানাইট পাথর আনা হতো নীলনদ দিয়ে নৌকায় করে। পুরো পিরামিডটি তৈরীতে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন টন চুনাপাথর, ৮ হাজার টন গ্রানাইট এবং ৫লক্ষ টন সুরকির প্রয়োজন হয়েছিলো। বৃহৎ এই পিরামিডটি তৈরি করতে ১ লাখ শ্রমিকের ২০ বছর সময় লেগেছিল। এই বৃহৎ পিরামিডের সামনেই পাহারারত আছে, দ্যা গ্রেট স্ফিংস নামক মূর্তিটি।
খাফরের পিরামিড
গিজার দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড। এটি খুফুর পিরামিডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এই পিরামিডটি খুফুর ছেলে খাফরে নির্মাণ করেছিলেন। এর উচ্চতা প্রায় ৪৭১ ফুট। পিরামিডটি লম্বায় গ্রেট পিরামিডের তুলনায় বেশি উঁচু মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি খুফুর পিরামিডের চেয়ে ছোট।
এটিকে লম্বা দেখানোর কারণ এটি উঁচু ক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। খাফরে আনুমানিক ২ হাজার ৫৫৮ থেকে ২ হাজার ৫৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পযর্ন্ত মিশর শাসন করেন। তার শাসনামলেই দ্য গ্রেট স্ফিংস নির্মিত হয়।
মেনকাউরের পিরামিড
গিজার তৃতীয় বৃহত্তম পিরামিডটি মেনকাউরের পিরামিড। এটি খাফরের ছেলে মেনকাউরে নির্মাণ করেছিলেন। এই পিরামিডটি গিজার গ্রেট পিরামিড তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ছোট। এর উচ্চতা প্রায় ২১৮ ফুট। এর মধ্যে রয়েছে মিশরীয় ফারাও মেনকাউরের সমাধি।
দ্য গ্রেট স্ফিংস
গিজার ‘দ্য গ্রেট পিরামিড’ এর সামনে পাহারারত একটি মূর্তিই হচ্ছে স্ফিংস। এটি একটি পৌরাণিক প্রাণীর মূর্তি যার শরীর সিংহের এবং মস্তকটি মানুষের। স্ফিংস-এর উচ্চতা ৬৬ ফুট।
ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, মূর্তিটি সম্ভবত ৪৫০০ বছর আগে বেলেপাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। যেহেতু খুফুর পুত্র খাফরের শাসনামলেই স্ফিংস নির্মিত হয়, তাই ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, স্ফিংস এর মুখটি রাজা খাফরের মুখের আদলে বানানো হয়েছ। সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা পাহারারত স্ফিংস ২৪১ ফুট দৈর্ঘ্য নিয়ে এখনো পাহারা দিয়ে চলছে পিরামিডকে।
পিরামিডের ইতিহাস
প্রাচীন মিশরীয়দের ধারণা ছিল মৃত্যুর পরেও মানুষ বেঁচে থাকে। তাই দেহকে অমর করে রাখার জন্য তারা মমি বানানো শুরু করে। প্রাথমিকভাবে মমিগুলোকে সাধারণভাবে সমাধিত করলেও পরে পিরামিডের ধারণার উদ্ভব হয়। এরপর থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মমি পিরামিডের ভিতর সমাহিত করার লক্ষ্যে পিরামিড বানানো শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ফারাও রাজারা নির্মাণ করেন গিজার গ্রেট পিরামিড।
মিশরের প্রথম পিরামিডের স্থপতি ছিলেন ইমহোটেপ। তিনি একাধারে স্থপতি, মহাযাজক, গণিতবিদ, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিদ, এবং সেই সঙ্গে মিশরীয় চ্যান্সেলর ছিলেন। বেঁচে থাকাকালীন প্রতিভার তেমন সমাদর না পেলেও মৃত্যুর তিন হাজার বছর পর ঠিকই সম্মান পাচ্ছেন।
গিজার পিরামিডের অজানা রহস্য
১. একমাত্র গিজার গ্রেট পিরামিডই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া বিশ্বের একমাত্র আট পার্শ্বযুক্ত পিরামিড। এই অসাধারণ নির্মাণকৌশল শুধুমাত্র উপর থেকে তাকালেই দেখা যায়। তাও আবার বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে। অর্থাৎ শরত্ ও বসন্তকালে ভোরে এবং সূর্যাস্তের আলোয়।
২. গিজার গ্রেট পিরামিডের ভেতর তাপমাত্রা সারাবছর ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসই থাকে। বছরের পর বছর ধরে এই তাপমাত্রা অক্ষুন্ন রেখেছে পিরামিডটি। তবে দিন ও রাতের ব্যবধানে তাপমাত্রার তারতম্য ঘটতে পারে।
৩. ফারাও খুফুর পিরামিডের ভেতরে কোন হায়রোগ্লিফিক (চিত্রলিপি) পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, মত্যুর পর শান্তিতে ঘুমানোর জন্যই ফারাও খুফু তার পিরামিডের ভেতরে কোন চিত্রকর্ম রাখতে চাননি।
৪. প্রাচীন মিশরে নির্মিত সবগুলো পিরামিডই নীলনদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। কারণ মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, সূর্য পশ্চিমে মৃত রাজাদের সম্মান জানিয়ে অস্ত যায়।
৫. মিশরের সবচেয়ে পুরোনো পিরামিডটি সাক্কারাতে অবস্থিত। এটি ফারাও জোসেরের জন্য নির্মিত হয়েছিল। এর বর্তমান বয়স ৪ হাজার ৬০০ বছর।
৬. গিজার পিরামিড তিনটি নির্মিত হয়েছে নক্ষত্র কালপুরুষের সঙ্গে একই সারিতে রেখে। পিরামিডের শীর্ষকে একই সরলরেখায় রেখে আকাশের দিকে তাকালে, ঐ সারিতে কালপুরুষকে দেখা যাবে। তাছাড়া আকাশ থেকে দেখলে একে থ্রী-স্টার তারা মনে হয়।
৭. গিজার গ্রেট পিরামিডটির পাশে আরো তিনটি ছোট ছোট পিরামিড রয়েছে। এগুলো রানি, ফারাওয়ের আত্মীয় ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের জন্য। যাতে করে মৃত্যুর পরের জীবনে তারা ফারাও-এর সেবা করতে পারে।
৮. পিরামিডের সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে এর নির্মাণশৈলী। পিরামিড যখন নির্মাণ করা হয় তখনও চাকা আবিষ্কার হয়নি। এরপরও কোনো উন্নত যন্ত্র ছাড়াই কীভাবে এত বিশাল বিশাল ওজনের পাথরগুলো এত ওপরে ওঠানো হয়েছিল তা আজও এক বিস্ময়। কোন ধরনের আঠা দিয়ে ওই পাথরগুলোকে এতগুলো বছর একত্রে আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Pyramids of Giza. 02. Giza Pyramids. 03. Egyptian Pyramids. 04. Interesting facts about the pyramids of Giza.