ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা, যেটি মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতা নামে পরিচিত। বর্তমানের ইরাক অঞ্চলে এই সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল। মূলত অনেকগুলো সভ্যতার মিশ্রণে এক বৃহৎ সভ্যতা ছিল মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা। সুমেরীয় সভ্যতা মেসোপোটেমিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সভ্যতা এবং এই সময়েই রচিত হয়? সেই সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে এটি রচনা করা হয় বলে ধারণা করা হয়। অন্ধ কবি হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি লেখারও ১৫০০ বছর আগের লেখা এই সাহিত্য। হরমুজড নিনেভ ১৮৫৩ সালের দিকে আশুরবানিপালের লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মহাকাব্যের কাহিনী উদ্ধার করেন। উরুকের বীর রাজা গিলগামেশ এবং তার দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডই মূলত এই মহাকাব্যের মূল বিষয়বস্তু।
মহাকাব্যের প্রথমার্ধের পুরোটা জুড়ে আছে গিলগামেশ আর এনকিদুর দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা। প্রাচীন সুমেরীয় শহর উরুকের জ্ঞানী, শক্তিশালী কিন্তু একজন অত্যাচারী রাজা হিসাবে গিলগামেশ ছিল সুপরিচিত। তিনি ছিলেন দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা এবং এক-তৃতীয়াংশ মানব। যুদ্ধবাজ এবং অপরাজেয় কুস্তিগীর হিসাবে সে ছিল বিখ্যাত।
মহাকাব্যের প্রস্তাবনা শুরু হয় গিলগামেশের প্রশংসা দিয়ে। স্থলভাগ এবং জলভাগের সকল কিছু সম্পর্কে তিনি ছিলেন অবগত। সাথে সাথে চরিত্রগত দিক থেকে তিনি ছিলেন লম্পট প্রকৃতির। যদি কোন মহিলা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, হোক সে অবিবাহিত অথবা বিবাহিত; সে তাকে অপহরণ করে নিয়ে আসতো। উরুকের লোকেরা তার এই আচরণে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল এবং কেউ-ই তার সাথে পেরে উঠতো না। তাই, তারা গিলগামেশকে পরাভূত করতে পারে এমন একজন মানুষ তৈরি করার জন্য দেবতা আরুরুর কাছে প্রার্থনা করলো যাতে গিলগামেশের হাত থেকে তাদের মেয়েরা বেঁচে যায়।
আরুরু তখন এনকিদুকে তৈরি করলো। ষাঁড়ের মতো পা বিশিষ্ট একজন লোমশ মানুষ। এনকিদু বন্য প্রাণীদের সাথে ঘুরে বেড়াতো এবং তাদেরকে শিকারীদের ফাঁদ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতো। এদিকে, গিলগামেশ কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার মা নিনসুন সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলে যে, তার খুব শীঘ্রই একটি শক্তিশালী বন্ধু হবে।
এনকিদুর শক্তিমত্তার কথা শুনে গিলগামেশ শামহাট নামের একজন মেয়েকে পাঠালো তার কাছে। যাতে মেয়েটির সাথে সখ্যতা গড়ার ফলে তার প্রাকৃতিক সরলতা নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে বন্যপ্রাণীরা তার সঙ্গ ত্যাগ করে। এনকিদুর যখন আর জঙ্গলে কিছুই করার থাকে না তখন সে শামহাটের কথামতো উরুকের দিকে রওনা হলো।
পথিমধ্যে, গিলগামেশের সাথে তার দেখা হয় এবং দুইজনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে গিলগামেশ জয়লাভ করে এবং দুজনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে৷ নতুন এই বন্ধুত্বের মাধ্যেমে তাদের দুইজনের মাঝেই বেশ ভালোরকম পরিবর্তন আসে। সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয় এবং একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বহু বছর পরে, উরুকের শান্তিপূর্ণ জীবন একঘেয়েমি লাগায় গিলগামেশ তার বন্ধুকে প্রস্তাব দেয় সিডার বন ভ্রমণের জন্যে। বনের কিছু বৃহৎ গাছ কাটা এবং রাক্ষস হুম্বাবাকে হত্যা করা ছিল তার উদ্দেশ্য। এর মাধ্যেমে গিলগামেশ তার নামকে অমর করে রাখতে চেয়েছিল।
কিন্তু, এনকিদু এবং উরুকের প্রবীণেরা তার এই পরিকল্পনায় আপত্তি জানায়। যেহেতু সিডার বন ছিল দেবতাদের একটি পবিত্র ভূমি। কিন্তু, শেষমেশ গিলগামেশের মা’ও তাকে তার পরিকল্পনা থেকে এক পা টলাতে পারেনি। সিডার পর্বতে পৌঁছাবার পর তারা হাম্বাবার মুখোমুখি হয় এবং একটি বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গিলগামেশ দৈত্যটিকে তার নিজের বোনদেরকে স্ত্রী ও বোনদেরকে উপপত্নী হিসাবে রাখার প্রস্তাব দেয় তাকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে। অবশেষে, তারা দানব হাম্বাবাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।
এরপর থেকেই পুরো রাজ্য জুড়ে এমন একটা কথা রটে যায় যে, গিলগামেশ ও এনকিদুকে কেউ কোনোদিন পরাজিত করতে পারবে না। আর দুজনের বন্ধুত্ব এতটাই ভালো ছিল যে, বন্ধুত্বে যেন ফাটল না ধরে তাই কোন নারীকে তাদের বন্ধুত্বের মাঝে আসতে দিতো না তারা। দেবি ইশতার গিলগামেশকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলে সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে ইশতার দেবতা এনলিলের কাছে সাহায্য চায়, স্বর্গের ষাঁড়ের দ্বারা গিলগামেশকে আক্রমণ করার জন্য।যাই হোক, পরবর্তীতে গিলগামেশ এবং এনকিদু দুইজন মিলে ষাঁড়টিকে হত্যা করে। সমস্ত দেবতারা তাদের এই আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে হয়ে একটি প্রাণঘাতী অভিশাপ দেয়। যার দরুণ, বারো দিন অসুস্থ থাকার পর এনকিদু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
মহাকাব্যের দ্বিতীয়ার্ধ গিলগামেশের অমরত্বের সন্ধান খোঁজা নিয়ে বর্ণনা করা। গিলগামেশ, এনকিদুর মৃত্যুতে প্রচন্ডরকম ভেঙে পড়েছিল এবং নিজের মৃত্যু সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সে উৎনাপিশতিমের সন্ধান করা শুরু করে; যে মরণশীল হয়েও অমরত্ব লাভ করে দেবতাদের অনুগ্রহে। গিলগামেশ যেতে যেতে মাশু নামক এক দ্বি-শৃঙ্গ বিশিষ্ট পর্বতের সামনে এসে থামে যেখানে সূর্য রাতে পাহাড়ের একপাশ দিয়ে অস্ত যায় এবং সকালে অন্যপাশ দিয়ে উদিত হয়। উৎনাপিশতিম পাহাড়ের উপরে বাস করে। কিন্তু সমস্যা হলো দুইটি বিচ্ছু দানব এর প্রবেশপথ পাহারা দিয়ে রাখে। গিলগামেশ তাদের কাছে মিনতি করে, এবং তারা কিছুটা নরম হয়ে যায়।
একটি অন্ধকারচ্ছন্ন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গিলগামেশ শেষমেশ সমুদ্রের তীরে একটি সুন্দর বাগানের ধারে আসে। সেখানে তার সাথে সিদুরির দেখা হয়; যে ছিল একজন পর্দানশীন সরাইখানার প্রহরী। গিলগামেশ তাকে তার উদ্দেশ্যের কথা জানায় এবং প্রতি উত্তরে সে তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলে। তিনি আরও বলেন যে, অমরত্বের সন্ধান করা নিরর্থক এবং পৃথিবীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট থাকবার জন্যে বলে। যখন সিদুরি গিলগামেশকে তার লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে না, তখন তাকে উর্ষানবী মাঝির কাছে নিয়ে যায়।
উর্ষানবী তাকে মৃত্যুর নদী পার করিয়ে উৎনাপিশতিমের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। গিলগামেশ বহু নদী, মহাসাগর, পর্বত, গিরিপথ অতিক্রম করে এবং ভয়ংকর পাহাড়ি সিংহ, ভাল্লুকসহ অন্যান্য জন্তুদের হত্যা করে শেষমেশ উৎনাপিশতিমের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
উৎনাপিশতিম তাকে মহাপ্রলয়ের গল্প শোনায় এবং বলে কিভাবে দেবতারা পুরো মানবজাতিকে ধবংস করে দিয়েছিল। অবশেষে যখন পানি কমে গেল, দেবতারা তাদের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনা করলেন এবং সম্মত হলেন যে তারা আর কখনও মানবজাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে না। তারা উৎনাপিশতিমের অমরত্ব নিয়ে পুরষ্কৃত করে।
গিলগামেশ যখন উৎনাপিশতিমের কাছে অবিনশ্বর হবার উপায় বাতলে দেবার জন্য জোর দেয়, তখন উৎনাপিশতিম তাকে একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্যে বলে। পরীক্ষাটি ছিল এক সপ্তাহ টানা না ঘুমিয়ে জেগে থাকা। গিলগামেশ চেষ্টা করে জেগে থাকবার, কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ হয়। অতঃপর, উৎনাপিশতিম তাকে উরুকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়।
গিলগামেশ যখন মনোক্ষুণ্ণ হয়ে চলে যাবার জন্যে তৈরি হয়, তখন উৎনাপিশতিমের স্ত্রী তাকে একটি আলৌকিক উদ্ভিদ সম্পর্কে বলতে রাজী করান যেটি গিলগামেশকে তার চিরযৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
গিলগামেশ সেই ভেষজটিকে উরুকের প্রবীণদের সাথে ভাগ করে নেবার পরিকল্পনা করে। কিন্তু যাবার পথে ক্যাম্পিং করার সময়ে একটি সাপ গাছটি চুরি করে খেয়ে ফেলে অমরত্ব লাভ করে। গিলগামেশ সাপটির খোলস বদলে আবার তরুণ হয়ে যাওয়া দেখতে থাকে। গিলগামেশ খালি হাতে উরুকে ফিরে আসে।
সে বুঝতে পারে, সে চিরকাল বেঁচে থাকবে না। কিন্তু মানবজাতির এই ক্রমধারা বজায় থাকবে। মানুষ মারা যাবে ঠিক-ই কিন্তু নতুন শিশুও সাথে সাথে জন্ম নিবে। সুমেরীয় রাজার তালিকা অনুসারে গিলগামেশ ১২৬ বছর ধরে রাজত্ব করে।
‘দ্য এপিক অব গিলগামেশ’ মেসোপোটেমিয়া এবং এর রাজাদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে। মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই গিলগামেশ হয়ে উঠেছে বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যের নায়ক। বন্ধুর মৃত্যু তার জীবনকে করে তুলেছিল দুর্বিষহ।
গিলগামেশ মহাকাব্যের প্রধান শিক্ষা হল মৃত্যু অনিবার্য। গিলগামেশ অনন্ত জীবন খোঁজার নিরর্থক প্রচেষ্টায় অনেক সময় এবং শক্তি নষ্ট করে। সে তার পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে দূরে সরে যেয়ে এমন কিছুর সন্ধানে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় যা তার কাছে ছিল না।
বন্ধুত্ব, রাজার ভূমিকা, শত্রুতা, অমরত্ব, মৃত্যু, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, শহর বনাম গ্রামীণ জীবন, সভ্যতা বনাম বন্য এবং মানুষ ও দেবতার সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে এই পুরো কবিতা জুড়ে। বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মধ্য দিয়ে কবিতার নায়ক গিলগামেশ যেমন পরিপক্ব হয়ে উঠেছে তেমনি একজন ভালো রাজার খেতাবও অর্জন করেছে।
তথ্যসূত্রসমূহঃ
01. https://www.ancient-literature.com/other_gilgamesh.html
02. https://www.historyonthenet.com/the-epic-of-gilgamesh
03. https://www.worldhistory.org/gilgamesh/
04. https://www.britannica.com/topic/Epic-of-Gilgamesh
05. James Weigel Jr., Mythology