স্ট্রেসের প্রভাব কি শুধুই মনের উপর পড়ে? স্ট্রেসের জন্য কি শুধু বিষণ্ণতা আর হতাশা আসে? শরীরে কি এর কোনো প্রভাব নেই? এ সকল প্রশ্নের একটাই উত্তর-স্ট্রেসের ফলে শারীরিক এবং মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়ে। স্ট্রেসের প্রভাব শুধুমাত্র মনের উপর সীমাবদ্ধ থাকে না, এর প্রভাব মন ছাড়িয়ে শরীরেও পড়ে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা স্ট্রেসের ফলে হয়ে থাকে, যা কিনা বেশিরভাগ সময় সাধারণ অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
মানসিক চাপ কিংবা স্ট্রেস আসেনি এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। প্রতি মুহূর্তেই কিছু না কিছু নিয়ে স্ট্রেস অনুভব করছে সবাই। কাজের ডেডলাইন চলে এসেছে কিংবা প্রিয় মানুষের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে – সাথে সাথে স্ট্রেসও এসে হাজির হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে স্ট্রেসের মাত্রা থাকে কম আবার কিছু ক্ষেত্রে থাকে বেশি।
কম মাত্রার স্ট্রেসের ইতিবাচক প্রভাব যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনই বেশি মাত্রার স্ট্রেসের নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। আজকের আলোচনায় জানা যাবে কীভাবে স্ট্রেসের প্রভাব শরীরের উপর এসে পড়ে এবং এর ফলে কি কি প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে!
স্ট্রেস কী?
কোনো প্রতিকূল অবস্থায় শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যে প্রতিক্রিয়া হয় ঐ প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করার, তাকে স্ট্রেস বলা হয়ে থাকে। স্ট্রেস আমাদের জীবনে চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি মোকাবিলা করতে প্ররোচিত করে। অল্পবিস্তর মানসিক চাপ ভালো, এটা আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের সাথে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে।
তবে যখন এই স্ট্রেসের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন তা শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। মগজ থেকে শুরু করে পেট পর্যন্ত-স্ট্রেসের প্রভাব কীভাবে পড়ছে তা জেনে নেয়া যাক।
মস্তিষ্ক
তীব্র মানসিক চাপ কিংবা স্ট্রেস স্বল্প সময়ের জন্য উপকারী হতে পারে। স্ট্রেসের ফলে কর্টিসল নামক হরমোন বেশি নিঃসৃত হয়। এই হরমোন বেশি নিঃসরণের ফলে সংক্ষেপে এটাকে হরমোন দ্বারা মস্তিষ্কের গোসল বলা যেতে পারে, যা কিনা অনুপ্রেরণা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে। এভাবে স্বল্প পরিমাণে আসা স্ট্রেস কাজের উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে এবং কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।
বিপরীতভাবে, দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের ফলে তৈরি হওয়া উচ্চ কর্টিসল লেভেল মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং ক্ষতি করতে পারে। মস্তিষ্কের এই হিপ্পোক্যাম্পাস দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী কর্টিসলের বৃদ্ধি মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত এবং কার্যনির্বাহী ফাংশনের জন্য অপরিহার্য (জ্ঞানমূলক প্রক্রিয়া যা পরিকল্পনা করতে, সমস্যা সমাধান করতে, নমনীয় চিন্তাভাবনা করতে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়)।
হৃদযন্ত্র
মানসিক এবং শারীরিক চাপ হৃদয় এবং ভাস্কুলার সিস্টেমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্ট্রেসের ফলে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হার্ট রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখার জন্য তার ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, অক্সিজেন ঘাটতি, বুকে ব্যথা প্রভৃতি নানাবিধ সমস্যা হয়ে থাকে।
স্ট্রেসের প্রভাবে রক্তনালী সংকুচিত হতে পারে এবং উচ্চতর জমাট বাঁধতে পারে (রক্ত জমাট বাঁধা), যা কার্ডিয়াক ইভেন্টের ঝুঁকি বাড়ায়। উপরন্তু, দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেসের প্রভাবে হার্টের উপর তীব্র চাপ তৈরি হয় যা হার্ট এট্যাক বা স্ট্রোকের দিকে ধাবিত হতে পারে।
শ্বসনতন্ত্র
শ্বসনতন্ত্র কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং শরীর থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বর্জ্য অপসারণ করে। বাতাস নাক দিয়ে আসে এবং গলার স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে, শ্বাসনালী দিয়ে নিচে এবং ব্রঙ্কি দিয়ে ফুসফুসে যায়। ব্রঙ্কিওগুলি তারপর সঞ্চালনের জন্য লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেন স্থানান্তর করে।
স্ট্রেস শ্বাস-প্রশ্বাসে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে তা শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি করে আবার কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণ ঘটায়।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য এসব কারণ বিপজ্জনক নয়, তবে যেসব মানুষের শ্বাসকষ্টের সমস্যা পূর্ব থেকেই রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো আরও খারাপ অবস্থার তৈরি করে দিতে পারে।
পেশীতন্ত্র
স্ট্রেসে থাকাকালীন অবস্থায় পেশী টানটান অবস্থায় থাকে। আবার স্ট্রেস কমে গেলে পেশী শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ আওময় স্ট্রেসে থাকলে পেশী শিথিল হোয়ার সুযোগ পায় না। আর এই টানটান পেশীর জন্য মাথাব্যথা, পিঠব্যথা এবং শরীরেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
প্রজননতন্ত্র
যখন কেউ ক্রমাগত স্ট্রেসে থাকে, তখন বিভিন্ন জিনিসের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী স্ট্রেস টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন তৈরি করতে পারে যা কি না পুরুষের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে ভূমিকা রাখে।
স্ট্রেস কিংবা এই মানসিক চাপ বেশি সময় ধরে স্থায়ী হলে এই টেস্টোস্টেরন নামক হরমোনের মাত্র কমে যেতে পারে। এর ফলে শুক্রাণুর উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা পুরুষত্বহীনতার মতো সমস্যাও হতে পারে। এছাড়াও প্রোস্টেট এবং টেস্টিসের মতো প্রজনন অঙ্গগুলোতেও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
মহিলাদের ক্ষেত্রেও এই স্ট্রেস প্রভাব ফেলতে পারে। পিরিয়ডের রুটিনে পরিবর্তন আসতে পারে অর্থাৎ অনিয়মিত পিরিয়ড হতে পারে। আবার রক্তপাত বেশি হওয়া, পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা হওয়া ইত্যাদিও এই স্ট্রেসের প্রভাবে হতে পারে।
পাচনতন্ত্র
স্ট্রেসে থাকাকালীন অবস্থায় লিভার অতিরিক্ত শক্তি সরবরাহ করার জন্য অতিরিক্ত চিনি (গ্লুকোজ) উৎপাদন করে। তবে দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেসে যদি কেউ থাকে, তাহলে শরীরে গ্লুকোজের ক্রমাগত বৃদ্ধি হতে থাকে। শরীর এই ক্রমাগত বর্ধমান গ্লুকোজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এর ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, এবং উচ্চ হৃদস্পন্দন পাচন প্রক্রিয়াকেও বিপর্যস্ত করতে পারে। পাকস্থলীতে এসিড বৃদ্ধির কারণে বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স হতে পারে। স্ট্রেসের প্রভাবে আলসার হয় না, তবে আলসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
শরীরে খাবারের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে স্ট্রেসের প্রভাবে। এর ফলে ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এছাড়াও বমি বমি ভাব বমি বা পেটব্যথা হতে পারে।
স্ট্রেস কমাতে করণীয়
স্ট্রেস কমাতে কিছু কাজ করা যেতে পারে যা সম্পূর্ণরূপে স্ট্রেস থেকে মুক্তি না দিলেও স্ট্রেসের প্রভাব অনেকাংশেই কমিয়ে দিতে পারে –
শরীরচর্চা করা – শারীরিক কার্যকলাপ স্ট্রেস অনেকাংশেই কমাতে পারে। শারীরিকভাবে যতো বেশি একটিভ থাকা যাবে স্ট্রেস ততো দ্রুত কমে যাবে।
স্ট্রেস রিলিফ করার ক্ষেত্রে শরীরচর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাঁটতে যাওয়া, বাগান করা, সাঁতার কাটা, জগিং করা, সাইকেল চালানো প্রভৃতি কাজ শরীরচর্চার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া – নিজের যত্ন নেয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল। শাকসবজি ইত্যাদি খাবারের তালিকায় রাখা উচিত।
অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস এড়িয়ে চলা – কিছু ব্যক্তি স্ট্রেস কমানোর জন্য ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে স্ট্রেস সাময়িক সময়ের জন্য দূরীভূত হয় ঠিকই, তবে সেসবের প্রভাব কেটে গেলে পুনরায় বিষন্নতা গ্রাস করে। তাই এ ধরনের অভ্যাস এড়িয়ে চলা উচিত।
মেডিটেশন – মেডিটেশনের মাধ্যমে স্ট্রেস কমানো সম্ভব এবং কাজের প্রতি নতুন করে উদ্দীপনা তৈরি করা সম্ভব। মেডিটেশন করা, প্রার্থনা করা, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
হাসি থেরাপি – মন খুলে হাসতে পারলে তা পজিটিভ এনার্জি এনে দেয়। এটা স্ট্রেসকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। হাসির কারণ খুঁজে না পেলে অকারণেই হাসার অভ্যাস করতে পারলে দৈনন্দিন নানান দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়।
যোগাযোগ স্থাপন – স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকলে অনেকেই নিজেদেরকে আইসোলেট করে ফেলে পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব থেকে।
তবে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে, সেই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা উচিত। সমস্যা সম্পর্কে কথা বললে তা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
Feature Image: Microba Insight References: 01. How stress can damage your brain and body. 02. Stress. 03. Stress. 04. Chronic Stress and the Heart. 05. How does Stress Impact the Lungs and Respiratory Health? 06. The Effects of Stress on Your Body. 07. Stress management.