টেক ফোবিয়া: প্রযুক্তির ভয় থেকে যে রোগ!

468
0

সুস্থ দেহ ও মনকে মনে করা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এবং এটি এমন এক সম্পদ যা শুধু অর্থ-বিত্ত নয় বরং কিছু দিয়েই ক্রয় করা সম্ভব না। সুস্থতার গুরুত্ব সে ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারে যে বোধহয় অসুস্থতার মধ্য দিয়ে দিনপাত করে। খুব পরিচিত থেকে অপরিচিত বহু রোগব্যাধির অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকলেও অদ্ভুত একটি রোগ নিয়ে আজকের আলোচনা। সেটি  হলো ‘টেক ফোবিয়া’। 

মূলত টেকনোলজি থেকে ‘টেক’ আর ‘ফোবিয়া’ যা দ্বারা কোনো কিছুর প্রতি ভয় বা ভীতিকে বোঝানো হয় এর মিশেল এই ‘টেক ফোবিয়া’। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে, প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া জীবন এক সেকেন্ড কল্পনা করা যায় না সেখানে এমন একটি রোগ বেশ বিশ্বয়কর বটে! নতুন শোনালেও টেকনোলজির প্রতি এই ভয় বা ফোবিয়া যা টেক ফোবিয়া নামে ইদানীংকালে পরিচিত এর উৎপত্তি কিন্তু বেশ আগেই। 

‘টেকনো ফোবিয়া’ শব্দটি প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময় (১৭৬০-১৮৪০) আবির্ভূত হয়। সেই সময় প্রযুক্তির কল্যানে কাপড় তৈরির নতুন যন্ত্র আসার কারনে একদল তাঁতি তাদের চাকুরি হারায়। ফলশ্রুতিতে তারা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং নিজেদেরকে ‘দ্য লুডিইটস’ নাম দেয়। 

বিক্ষোভ এর অংশস্বরূপ তারা কলকারখানার মেশিন ধ্বংস করে দেয়। পরবর্তীতে ১৭২৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেশিন ধ্বংসের সাথে জড়িতদের বিচার করা হয়। তবে কালক্রমে ‘লুডাইড’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় নতুন প্রযুক্তি বা কাজের পদ্ধতির বিরোধীদের বোঝাতে। 

শিল্পবিপ্লবের প্রতীকী ছবি। Image Source: intelligentengeering.com

টেক ফোবিয়া কি?

খুব সহজ ভাষায় বললে আধুনিক টেকনোলজি প্রযুক্তির প্রতি এক ধরনের অহেতুক ভীতিকেই টেক ফোবিয়া বলা হয়ে থাকে। এটি এমন এক ধরনের ফোবিয়া যাতে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি স্মার্টফোন, কম্পিউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং আধুনিক ডিভাইসসহ প্রযুক্তির অন্যান্য সকল রূপ এছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির প্রতি অযৌক্তিক ভয় অনুভব করেন। 

সাধারণত প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারনা এই টেক ফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। বর্তমান যুগ প্রযুক্তির যুগ, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তির ব্যবহারের এই সময়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রতি  অহেতুক ভয় যেকোনো ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

টেক ফোবিয়ার কারণ কি?

কেনো একজন ব্যক্তি টেক ফোবিয়াতে আক্রান্ত হয় সেটা ঠিক স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা হয়, ক্রমাগত পরিবর্তন-এর ভেতর দিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন রকম ডিজিটাল স্কিল না থাকার কারণে আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে টেকনোলজিকে ভয় পাওয়া। এছাড়া আসন্ন প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব কেমন হবে সেই বিষয়ের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রপাগাণ্ডা থেকেও প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি হতে পারে। 

নিজ অবস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তা হতে পারে এই রোগের অন্যতম কারণ। Image Source: techcrunch.com

মানব মস্তিষ্কের গঠন এমন যা শুধু সহজ চিন্তা এবং কম জটিল কাজ করতে পছন্দ করে। কিন্তু সত্যিটা হলো জীবন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং জীবনের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও নিয়ত পরিবর্তনের স্বীকার। 

টেকফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে এই চিন্তাভাবনাগুলো। এসকল ব্যক্তিদের যেমন নতুন কোনো দক্ষতা অর্জন করে প্রযুক্তি ব্যবহারে যেমন প্রচন্ড অনীহা কাজ করে, অন্যদিকে তাদের মনে ভীতি থাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। 

টেক ফোবিয়ায় আক্রান্তরা মনে করে একদিন হয়তো সবকিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর দখলে চলে যাবে। ফলে নিজেদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে পড়বে রক্তে মাংসে গড়া মানবজাতি। 

টেক ফোবিয়ার লক্ষণ

অন্যান্য রোগের মতো টেক ফোবিয়া নিয়ে আলোচনা কম হলেও রোগটি মোটেও হালকা নয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে দেখা দিতে পারে বেশ কিছু জটিল লক্ষণও। নতুন কোনো ডিভাইস-এর সংস্পর্শে বা ব্যবহারের সময় আতংক থেকে যা দেখা দিতে পারে।  

টেকনোলজি যেন যমদূত! Image Source: txsource.com
  • হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাওয়া
  • দ্রুত শ্বাস নেওয়া
  • মাথা ঝিমঝিম করা, এমনই জ্ঞান হারানোর মতো ঘটনা ঘটা
  • বমি বমি ভাব কাজ করা
  • বুকে ব্যথা
  • শরীরের পেশিগুলো সংকুচিত হওয়া। 

মূলত, ভয় বা দুশ্চিন্তা থেকে এই রোগের উৎপত্তি বলে প্যানিক অ্যাটাক হওয়া বা এর লক্ষণগুলোর সাথে বেশ মিল পাওয়া যায়। 

টেক ফোবিয়ার অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু ফোবিয়া: 

নোমোফোবিয়া

নোমোফোবিয়া হচ্ছে, নো মোবাইল (মো) অর্থাৎ মোবাইল ফোন না থাকার ভয় বা চিন্তাকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। সম্ভবত প্রতিদিনের যাপিত জীবনের সব ক্ষেত্রে, সব সময় মোবাইল ফোনের সীমাহীন ব্যবহারের কারণে এই রোগ অনেকের মধ্যে বাসা বেঁধে গেছে। নোমোফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সর্বদা ভয়ে থাকেন এটা ভেবে যে, এই বুঝি তার ফোন হারিয়ে গেল আর এই বুঝি সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কল মিস করে ফেললো। 

আরো বেশি দুশ্চিন্তা করে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থানে যাওয়ার সময়। শুধু তাই নয়, গোটা ফোন কখন ভ্যানিশ হয়ে যাবে অর্থাৎ হারিয়ে যাবে এই ভয়েও ভীত থাকে নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত এই ব্যক্তিরা।  

টেলিফোন ফোবিয়া

অদ্ভুত এই ভয় লাগার ব্যাপার হলো টেলিফোন ফোবিয়া। টেলিফোন ব্যবহার বা স্পর্শতে অবশ্য কোনো সমস্যা না থাকলেও এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা টেলিফোনকে ভয় পায় যখনই টেলিফোনটি ক্রিং! ক্রিং! শব্দ করে বেজে ওঠে! 

মূলত, ফোন কল রিসিভ করাতেই যেনো এদের যত ভয়। ধারণা করা হয় এই ভয়ের উৎপত্তির কারণ, রোগীরা ভাবতে থাকেন ফোন রিসিভ করলেই বুঝি, বিপরীত পাশ থেকে কেউ বুঝি ধমক দিবে অথবা এমন কিছু বলবে যাতে তার মন খারাপ হয়ে যাবে।  

অদ্ভুত এক রোগ টেলিফোবিয়া। Image Source: thematter.co

সাইবারফোবিয়া

সাইবারফোবিয়াতে ভুক্তভোগীরা সাধারণত কম্পিউটার ব্যবহারকে ভয় পায়! অদ্ভুত মনে হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটনাটি আসলেই সত্যি। 

এমনকি এসকল ব্যক্তিরা এতটাই ভীত থাকে যে কেউ কেউ জীবদ্দশায় কম্পিউটারকে স্পর্শ করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। সাইবারফোবিয়া অর্থাৎ কম্পিউটারকে ভয় পাওয়ার এই ব্যপারটা বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। 

অজানা যেকোনো কিছুকে ভয় পাওয়া যেনো মানবজাতির আদি অভ্যাস! Image Source: mrhillmusings.com

সেল্ফিফোবিয়া

বিশ্বগ্রামের এই যুগে মানুষ একে অন্যের সাথে আরো বেশি সুসম্পর্ক রাখতে, একে অন্যের সাথে নিজেদের প্রতিদিনের আনন্দঘন মুহূর্তকে ভাগাভাগি করে নিতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে ছবি শেয়ার করতে দেখা যায়।  

বন্ধুদের আড্ডা থেকে শুরু করে অফিসের মিটিং শেষেও একখানা সেল্ফি তুলতে কেউ আর পিছিয়ে নেই। সেল্ফি তোলার এই বিষয়টাকে আপাতদৃষ্টিতে সবাই উপভোগ করলেও এটাও সত্যি যে আমাদের ভেতরই কেউ কেউ আছেন যারা সেল্ফি তুলতে ভয় পান। 

আসলে ভয়টা হয়তো সেল্ফি তোলাতে যতটা তার চেয়ে বেশি নিজেকে কেমন লাগছে ছবিতে সেই বিষয়ে। অনেকেই মনে করেন যে তাদের বাস্তব চেহারার থেকে সেল্ফিতে তাদের অসুন্দর লাগে। 

অর্থাৎ নিজেকে অসুন্দর, বা প্রত্যাশা অনুযায়ী দেখতে ভালো লাগবেনা এমন ভয় থেকেই সেল্ফিফোবিয়ার উদ্ভব! অনেক সময় এর মাত্রা এত বেশি হয় যে কেউ কেউ নিজেদের সেল্ফি তোলা থেকে বিরতই রাখেন। 

নিজেকে অসুন্দর দেখতে এতটাই ভয়? Image Source: electronicproducts.com

টেকফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা যেভাবে হতে পারে:

সব অসুখ এর মতো টেকফোবিয়ারও চিকিৎসা আছে। ব্যক্তির নিজের চেষ্টা অর্থাৎ মনোবল বাড়ানো বা কেন ভয় পাচ্ছে, এর পেছনের কারণ খুঁজে বের করার মাধ্যমে এই ব্যাপারটি নিয়ে একটি পরিষ্কার ধারনা নেওয়ার মাধ্যমে ভীতি প্রশমিত করা যেতে পারে। এছাড়া অভিজ্ঞ থেরাপিস্টদের সাহায্যে থেরাপি, ওষধ গ্রহনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই রোগ থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব।  

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. 6 tech phobias that actually exist. 
02. What are the tech-related phobias. 
03. Technophobia. 
04. Why are technophobes afraid of technology.