ঘটনাটি ১৯৯৩ সালের, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য নিউ মেক্সিকোর ছোট্ট শহর তাওসে আট দশটা রাত্রির মতো স্বাভাবিক রাত নেমে এসেছিল। ছিমছাম ছবির মতো গুছানো ছোট এই পাহাড়ি শহরে রাত নামলেই যেন পরিণত হয় নিরবতার স্বর্গরাজ্যে। তাওসের ছেলেবুড়ো সব ঘরে বন্দি।
রাত বাড়ছে ক্রমে, সকলেই ঘুমে মত্ত। ঘড়িতে তখন ঠিক ৯টা বাজে। হঠাৎ করে তাওসের অন্ধকার রাত্রি ভেদ করে এক তীক্ষ্ণ শব্দের বিস্তার ঘটতে থাকে। অনেকটা রেডিও তরঙ্গের মতো দুর্বল কম্পাংকের এই শব্দ যেন মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল তাওসের বাসিন্দাদের।
শব্দ ক্রমেই বেড়েই চলেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শতকতরা ২ ভাগ মধ্যবয়স্ক নগরবাসী এই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছিল। রহস্যাবৃত এই শব্দের প্রকৃত কারণ আজ পর্যন্ত জানতে পারেনি কেউ। তাই ইতিহাসে এই ঘটনা ‘তাওস হাম’ নামে একটি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই থেকে যায়।
হাম মানে কি?
অভিধানে হামের অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, হাম (HUM) একটি ইংরেজি শব্দ। প্রতিশব্দ অনুসন্ধানে বের হয় এমন অর্থ-গুঞ্জন করা, গুণগুণ করা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে রাতের বেলা অদ্ভুতুড়ে শব্দ শোনা যায় যা কিনা বেশিরভাগ সময়ই রেডিও তরঙ্গের মতো মনে হয় তাকেই সচরাচর হাম বলা হয়ে থাকে।
রহস্য
১৯৯৩ সালে পুরো আমেরিকান কংগ্রেস নড়েচড়ে বসে এই ঘটনায়। নানা ব্যাখ্যা, পাল্টা ব্যাখ্যা, তদন্ত পাল্টা তদন্ত করলেও রহস্যময় এই শব্দের নেপথ্য কারণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে তেমন কিছুই জানা যায়নি। যা জানা গিয়েছে তা শুধু কতেক সন্দেহ আর সম্ভাবনা। তাওসের অধিবাসীদের একটি অংশ যারা কিনা সংখ্যায় লঘু তাদের এমন দাবিতে প্রথম প্রথম কেউ কর্ণপাতই করেনি।
এই নির্দিষ্ট সংখ্যক নাগরিকদের ভাষ্যমতে, তারা রাত্রিবেলা অদ্ভুত ঝিরিঝিরি এক ধরণের শব্দ শুনতে পায় যা তাদের মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল। তাদের এমন কথার পক্ষে তেমন কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় ছোট্ট শহর তাওস হঠাৎ করে টালমাটাল হয়ে যায়, অনিশ্চিত এক ঘটনা যেন গ্রাস করে ফেলে পুরো শহরকে।
রাত হলেই সবাই কান পেতে থাকে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ শুনবে বলে, কিন্তু বিধি যথারীতি বাম। সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রোতারাই শুনতে পায় ভুতুড়ে হাম। যার ফলে অপরাপর নগরবাসীদের মধ্যে হাম নিয়ে এক ধরণের বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, অনেকে একে ভুয়া এবং উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি বলেও উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু প্রকৃত হাম শ্রোতারা বসে থাকেনি।
তারা কংগ্রেসের কানে তুলে ব্যাপারটা। মার্কিন কংগ্রেসও যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এর তদন্তের জন্য একটি বিশেষ সেল গঠন করে। তদন্ত কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে এসে ভিক্টিমদের সাথে কথা বলে এবং তাদের অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এছাড়া, উপদ্রুত স্থানে তারা শব্দ নিরীক্ষণ যন্ত্র বসিয়ে পরীক্ষা চালায়। কিন্তু আদতে কোন ধরণের অস্বাভাবিক কিছু উদঘাটনে ব্যর্থ হয় এই বিশেষ সেল।
নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির অ্যামেরিটাস প্রফেসর জো মুলিন্স তাওস হাম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালান। হাম শ্রোতাদের বাড়ির পাশে সাউন্ড ডিটেক্টর যন্ত্র বসিয়েও যখন কোন কার্যসিদ্ধি হয়নি তখন আপাতত তিনি এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দেন।
উদ্ভট তথ্য
তাওস হামের পর কিছু উদ্ভট তথ্য সামনে আসে। যেগুলো হামের শ্রোতারা বিশ্ব জগতের কাছে সত্য বলে জোর প্রচার চালাচ্ছে-তাওস হাম শুনেছেন এমন দাবি করা নাগরিকদের সবার বয়স ৩০ থেকে ৫৯ এর ভেতর! শুধুমাত্র রাত ৮টা এবং ৯টার মধ্যেই এই শব্দ শ্রুত হতো! এমনকি শ্রোতাদের মধ্যে শব্দের তীব্রতা নিয়ে ছিল বেশ শক্ত দ্বিধাবিভক্তি।
কেউ বলেছেন এই শব্দ ছিল অনেকটা ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হয়ে মাথা চিনচিন করে দেয়ার মতো। আবার বাকিদের দাবি অনুযায়ী এই শব্দ ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর ভোঁ ভোঁ শব্দের ন্যায়। হাম শ্রোতাদের এরপর থেকে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। কারো অনিদ্রা, মাথাধরা কারো বা কানে অযথা চাপ অনুভব করা।
বিজ্ঞান না ব্যাখ্যা?
তাওস হামের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোন ব্যাখ্যাই আজ পর্যন্ত টেকেনি। তাওস হামের পেছনের কারণ সম্পর্কে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলা হয়, আশেপাশের কোন শিল্পকারখানার সাজসরঞ্জামাদি থেকে উৎপন্ন কোন শব্দই বোধহয় এই শব্দের পেছনের কারণ। এর আগে ব্রিস্টল শহরের হামের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে এই কারণটাই সবার সামনে আসে।
তাই, তাওস হামের ক্ষেত্রে এটাকেও প্রমাণ হিসেবে দাবি মানতে অনেকেই জোর তৎপরতা চালিয়েছেন। উচ্চমাত্রার গ্যাসলাইন কিংবা বৈদ্যুতিক লাইনের তীক্ষ্ণ শব্দ থেকেও তাওসের হামের উৎপত্তির কারণ স্বীকার করা হয়। এছাড়া কারো মতে, সরকারের গোপন কোন সামরিক পরীক্ষার কারণে উদ্ভুত শব্দই ছিল তাওস হাম।
মনোবিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যেহেতু বারবার শুধুমাত্র ঐ ২ শতাংশ নগরবাসী শব্দ শুনছেন বলে দাবি করছেন এবং বাদবাকি সব তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। সুতরাং এর কারণ হচ্ছে নির্দিষ্ট সেসব হাম শ্রোতার মনোবৃত্তি। তাদের মতে, হামশ্রোতারা একবার বিশ্বাস করে নেয়ার কারণে শুধুমাত্র তাদের সাথেই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আর এজন্যই দায়ী তাদের এমন চিন্তা। তারা এই ঘটনাকে এক ধরণের হ্যালুসিনেশন বলেও উড়িয়ে দেন।
অন্য এক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যখন সুনসান নিরবতা আমাদের ঘিরে রাখে তখন যেকোনধরণের শব্দ যদি হুট করে আমাদের কানে আসে তখন সে শব্দকে আমাদের উচ্চমাত্রার কোন শব্দ বলে মনে হয়। আর তাওসের অধিবাসীদের বেলায়ও তাই ঘটেছে। এ ব্যাখ্যায় তাওস হামের শ্রোতাদের সাধারণের তুলনায় উচ্চ শ্রবণশক্তির বলে স্বীকার করা হয়েছে। যার কারণে অন্যরা যা শুনতে পেত না, তারা তা শুনতে পেয়েছিল।
আবার আরেকদল গবেষকের মতে, তাওস হাম আসলে স্পনটেনাস ওটোঅ্যাকিউস্টিক ইমিশন (Spontaneous otoacoustic emissions) এর কারসাজি। মানুষের কান নিজস্ব শব্দ উৎপন্ন করে যাকে স্পনটেনাস ওটোঅ্যাকিউস্টিক ইমিশন (এস.ও.ই) বলে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি সম্পন্ন প্ৰাপ্ত বয়স্কদের ৩৮-৬০ শতাংশের মধ্যে এস.ও.ই দেখা যায়।
যদিও তাদের বেশিরভাগের এই শব্দ সম্পর্কে কোন ধারণা থাকে না। এস.ও.ই শুনতে পেয়েছেন এমন ব্যক্তিরা বলেছেন তারা সর্বদা কানে একধরনের হিস হিস আওয়াজ শুনতে থাকেন অনেকটা তাওস হামের মতো। তাওস হামের সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাখ্যা হিসেবে সেই চিরায়ত এলিয়েনকেও সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। শেষ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে এই শব্দ হয়তো ভিনগ্রহের প্রাণীদের পৃথিবীতে তাদের গোপন কোন কর্মসূচির অংশ!
অনেক ব্যাখ্যার ভিড়ে চাপা পড়ে আছে তাওস হামের আসল রহস্য। আসলেই কি এটা কি কোন রহস্য? নাকি কিছু লোকজনের ভ্রম। ভবিষ্যতে যদি আসল সত্যিটা উন্মোচন হয়, নয়তো এরকম হাজারো ব্যাখ্যার ভিড়ে থাকবে এই তাওস হাম।
Feature Image: sporcle.com References: 01. The Taos Hum: The Unsolved Mystery 02. The legend of the ‘Taos Hum’ continues 03. Unexplained Noises – What is the Taos Hum? 04. What is the Taos Hum?