সুইজারল্যান্ড দক্ষিণ-মধ্য ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত পার্বত্য দেশ। যার সীমানা অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং লিখটেনস্টাইন পর্যন্ত প্রসারিত। প্রাচীনকালে সুইজারল্যান্ডকে হেলভেটিয়া নামে ডাকা হতো, আজও এই নামটি সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। দেশটির সরকারি ল্যাটিন নাম কনফোডেরাটিও হেলভেটিকা।
৪১,২৮৫ কি.মি. আয়তন নিয়ে দেশটি নেদারল্যান্ডের চেয়ে সামান্য ছোট বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির আকারের প্রায় দ্বিগুণ। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যা মাত্র ৮.৭ মিলিয়নের নিচে (২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী)। এর রাজধানী বার্ন এবং বৃহত্তম শহর জুরিখ। প্রচলিত কথ্য ভাষাগুলি হলো জার্মান, ফরাসি, ইতালীয় এবং রুমান্টস, ঐতিহ্যগতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে (ক্যান্টন) কথ্য। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২১ অনুসারে, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের পরে সুইস কনফেডারেশন পৃথিবীর তৃতীয় সুখী দেশ।
ভৌগলিকভাবে দেশটি তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত; দক্ষিণে রয়েছে সুইস আল্পস পর্বতমালা। পাহাড়, সমভূমি এবং বড় হ্রদ এবং ৪০০ মিটার এবং ৭০০ মিটারের মধ্যে গড় উচ্চতার সাথে রয়েছে আল্পস সুইস মালভূমি। ফরাসি/সুইস সীমান্ত বরাবর উত্তর-পশ্চিমে জুরা, একটি উপ আল্পাইন পর্বতশ্রেণী রয়েছে।
সুইজারল্যান্ড বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধের কোনোটিতেই জড়িত ছিল না। গত অর্ধ শতাব্দীতে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একীকরণ এবং জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় এবং বহুজাতিক ব্যাংক ও কর্পোরেশনের সদর দফতর হিসাবে সুইজারল্যান্ডের যে ভূমিকা ছিল তা একে অনন্য করে তুলেছে।
জনসংখ্যা
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যা ৮,৬৯৮,০৭৭ অনুমান করা হয়েছিল। এটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ০.১১% এর সমান। জনসংখ্যা অনুসারে দেশগুলির পরিপ্রেক্ষিতে, এটি বিশ্বব্যাপী সুইজারল্যান্ডকে ১০১ নম্বরে রাখে। মজার বিষয় হলো জনসংখ্যার অধিকাংশই (৭৪.১%) শহরাঞ্চলে বাস করে এবং দেশের গড় বয়স হলো ৪৩.১ বছর।
সুইসদের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা মূলত গড়ে উঠেছে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অনুসারে। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার কারণে একটি পার্বত্য প্রধান, গ্রামীণ এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পূর্ণ ভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৈচিত্র্যময় এবং গুরুতপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভাষা
পশ্চিম মহাদেশীয় ইউরোপের বেশিরভাগ প্রধান সাংস্কৃতিক অঞ্চল-জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং ইতালিও-সুইজারল্যান্ডের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে, দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হলো এর ভাষার বৈচিত্র্য। সুইস সংবিধান জার্মান, ফরাসি এবং ইতালিকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মোট জনসংখ্যার তিন-পঞ্চমাংশের বেশি জার্মান, এক-পঞ্চমাংশ ফরাসি, প্রায় এক-দ্বাদশ ভাগ ইতালীয় এবং ১ শতাংশেরও কম রুমান্টস ভাষায় কথা বলত। জনসংখ্যার প্রায় এক- দশমাংশ একটি নন-অফিসিয়াল ভাষায় কথা বলতো। ক্রোয়েশিয়ান, পর্তুগিজ, সার্বিয়ান এবং স্প্যানিশ বংশোদ্ভূতরা এই বিভাগে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। দেশের জাতিগত ভাঙ্গন মূলত এর ভাষাগত বিভাজনের প্রতিফলন ঘটায়।
ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিসের মতে, সুইজারল্যান্ডে চারটি সরকারী ভাষা রয়েছে, যা জার্মান (২০১৯ সালে ৬২% জনগণ কথ্য), ফরাসি ( ২৩%), ইতালীয় (৪%) এবং রোমান্স (০.৫%)। যাইহোক, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ সহ সারা দেশে আরও বেশ কয়েকটি অ-জাতীয় ভাষাতেও কথা বলা হয়।
ধর্ম
সুইজারল্যান্ডে যথেষ্ট ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে। সুইজারল্যন্ডে শিল্পায়নের ফলে বহিরাগত বিপুল জনসংখ্যার সমাবেশ ঘটায় ধর্মের বৃহত্তর মিশ্রণ ঘটে। সুইজারল্যান্ডে রোমান ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে সামান্য পরিমাণ সংখ্যায় বেশি, এবং সেখানে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও উল্লেখযোগ্যভাবে মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে- প্ৰধানত তুর্কি বা বলকান বংশোদ্ভূত- এবং একটি ক্ষুদ্র ইহুদি সম্প্রদায়।
সুইজারল্যান্ড একটি খ্রিস্টান প্রধান দেশ। দেশের প্রধান ধর্ম হল রোমান ক্যাথলিক (৩৬.৫%), সংস্কারকৃত ইভানজেলিকাল সম্প্রদায় (২৪.৪%), অন্যান্য খ্রিস্টান সম্প্রদায় (৬%), মুসলিম (৫.২%), এবং ইহুদি (০.৩%)। বলা হয় যে, সুইস জনসংখ্যার ২৫% এর কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই।
অর্থনীতি
অর্থনীতির দিক থেকে সুইজারল্যান্ড হল একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক ক্ষেত্র, এখানে বেকারত্বের হার অনেক কম। সুইজারল্যান্ডে একটি দক্ষ শ্রমশক্তি রয়েছে এবং এর মাথাপিছু জিডিপি বিশ্বের সর্বোচ্চ।
দেশের অর্থনীতি একটি উচ্চ বিকশিত পরিষেবা খাত থেকে আসে যেগুলো আর্থিক পরিষেবাগুলির নেতৃত্বে, এবং একটি উত্পাদন শিল্প যা উচ্চ-প্রযুক্তি এবং জ্ঞান-ভিত্তিক উৎপাদন দ্বারা পরিচালিত হয়। দেশের শ্রম উৎপাদনশীলতা অনেক উচ্চ, এবং ফেডারেলভাবে বাধ্যতামূলক ন্যূনতম কোন মজুরি নেই।
সুইজারল্যান্ডের খুব কম ক্ষেত্রেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং এর কৃষি খাত সুরক্ষিত কারণ এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হয় সরকারিভাবে।
সুইজারল্যান্ডকে কয়েকটি বৃহত্তম বৈশ্বিক কোম্পানির আবাসস্থল বলা হয়। ফল্গুন ৫০০ কোম্পানীর মধ্যে এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘনত্বের একটি, অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটি হার্ভার্ডের কান্ট্রি অ্যান্ড প্রোডাক্ট কমপ্লেসিটি র্যাঙ্কিংয়ে জাপানের পরে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক যা সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক একটি স্বাধীন কেন্দ্ৰীয় ব্যাংক হিসাবে সুইজারল্যান্ডের মুদ্রানীতি পরিচালনা করে থাকে।
সুইসদের নিয়ে মজার কিছু তথ্য
সুইসদের নিয়ে অজানা কিছু তথ্য যা আপনাকে আরো বেশি অবাক করবে! চলুন জেনে নেই সেই তথ্যগুলো সম্পর্কে।
- সুইসরা সাধারণত দেরিতে বিয়ে করতে পছন্দ করে। একজসন সুইস পুরুষের গড় বিয়ের বয়স ৩১.৮ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ২৯.৫ বছর। অন্যদিকে, দ্য লোকাল সিএইচ রিপোর্ট করেছে যে, সুইজারল্যান্ডে বিবাহবিচ্ছেদের হারও অনেক বেশি প্রায় ৪০%।
- সুইজারল্যান্ডে খুব কম খরচে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যায়ন করা যায়। যেমন: সুইজারল্যান্ডে জেনেভার মতো প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি প্রতি সেমিস্টারে মাত্র ৫৭ হাজার টাকা যা (বাংলাদেশী টাকায়) খুবই কম।
- সুইজারর্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষের কাছে নিজস্ব বন্দুক রয়েছে কিন্তু সেখানে অপরাধ প্রবণতার হার একেবারে কম।
- পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ভাবনী একটি দেশ হলো সুইজারল্যান্ড। ২০১৮ সালে, সুইজারল্যান্ড দ্য গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী দেশ হিসেবে টানা অষ্টম বারের মতো প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
- সুইসদের জনসংখ্যার প্রায় ২৫% বিদেশী। সুইজাল্যান্ডে বসবাসকারী বিদেশীদের মধ্যে ৮০% ইউরোপীয় দেশ থেকে এসেছে।
- সুইজারল্যান্ডে প্রচুর নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিবর্গ রয়েছে। সুইস বিশ্ববিদ্যালগুলি অসংখ্য নোবেল বিজয়ী তৈরি করেছে এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিজ্ঞানী ছিলেন।
- জাতীয় ভাষা হিসেবে চারটি ভাষা রয়েছে সুইসদের। চারটি ভাষার মধ্যে রয়েছে ফরাসি (২৪.৪%), জার্মান (৬৪%), ইতালীয় (৬.৫%), এবং রুমান্টস (১% এর একটু বেশি)। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সুইসরা তাদের নিজস্ব ভাষা বোঝে না।
সুইজারল্যান্ড তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক ছোট হলেও এই দেশের রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে চমৎকার চমৎকার অর্জন ও বৈশিষ্ট্য। এখানে বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনা (৪.৮%)। আর এটি সম্ভব হয়েছে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির কারণে।
সুইজারল্যান্ড অর্থ, শিক্ষা ও অন্যান্য দিক থেকে এত সমৃদ্ধির অধিকারী হওয়ার একটাই কারণ আর তা হলো তারা সারাবিশ্বের মেধাবীদের নিজেদের দেশে চাকরি, থাকা, ও শিক্ষার জন্য সুযোগ করে দেয়। আর পরবর্তীতে এই সকল মেধাবীরাই তাদের দেশকে আরো উন্নত করতে সহায়তা করে। আর এই সকল মেধাবীদের জন্যই সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক সুইজারল্যান্ডের অর্থ ভান্ডার হিসেবে সারাবিশ্বেি আজ পরিচিত।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Switzerland. 02. Switzerland. 03. Switzerland Facts.