মাথার খুলিতে এক টুকরো মস্তিষ্ক থাকা তখনই স্বার্থক হয়ে ওঠে যখন কোনো মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে আসলে এই মগজের কাজটা কি! অন্যান্য প্রাণী থেকে মানবজাতির মস্তিষ্কের গঠন এবং ধরনের পার্থক্য মোটা দাগে আলাদা করা যায় মগজের চিন্তা করার অপরিসীম ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করলে। অবাক করা হলেও সত্যি যে, এই মস্তিষ্কেরই রয়েছে বিস্ময়কর সব ভাবনা ভাবার ক্ষমতা। মানুষভেদে এই চিন্তা, চেতনা, কল্পনার প্রভেদ থাকলেও বিশেষ একটা চিন্তা যেন সবার এক ও অভিন্ন।
এই চিন্তার সূত্র ধরেই গবেষণা করা হয় বিস্ময়কর যেকোনো বিষয় থেকে একেবারে সাধারণ সবকিছুকে নিয়ে। আবিষ্কার হয় নতুন কিছু। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সব গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হয় বিভিন্ন পুরষ্কার। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং আকাঙ্ক্ষিত হলো ‘নোবেল প্রাইজ’।
আর নোবেল প্রাইজ ঘোষণার মৌসুমগুলোতে যেন সারাবিশ্ব উদগ্রীব হয়ে থাকে কে পাচ্ছে এবারের নোবেল পুরষ্কার? ২০২২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান-এ নোবেল পুরষ্কার জিতে নেন সোয়ান্তে প্যাবো, তার অতি চমকপ্রদ গবেষণার জন্য।
বহু বছর আগের, প্রায় ৭০ বছর পূর্বের নিয়ান্ডারথালদের সাথে হোমো স্যাপিয়েন্স-এর সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা এবং একটি সফল ফলাফল দাঁড় করানোর জন্য তাকে নোবেল প্রাইজের মতো সম্মানিত পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।
সোয়ান্তে প্যাবো জন্মগতভাবে একজন সুইডিশ। সুইডেনের উপসলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে থেকে পোস্ট-ডক্টরাল সম্পন্ন করেন।
এরপর জার্মানিতে ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর এভল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি (Max Planck Institute for Evolutionary Anthropology) এবং একইসাথে জাপানের বিখ্যাত ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (Okinawa Institute of Science and Technology)তে বেশ কিছুকাল অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন। উল্লেখ্য, প্যাবোর বাবাও একজন নোবেল লরিয়েট ছিলেন।
আমরা এলাম কোথা থেকে?
প্রাচীনকাল থেকেই এই প্রশ্নটা ছিল, আমরা এলাম কোথা থেকে? আর মানবজাতির এই বিবর্তনের ইতিহাস খুঁজে বের করতে জীবাশ্ম বিদ্যা এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এসকল বিষয়গুলো নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স আনুমানিক ৩ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল।
অন্যদিকে আমাদের নিকটতম স্বজাতি, নিয়ান্ডারথালরা আফ্রিকার বাইরে বিকশিত হয়েছিল। যা প্রায় ৪ লক্ষ বছর থেকে ৩০ হাজার বছর আগেকার। তারা মূলত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বংশ বিস্তার করেছিল।
প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে, হোমো স্যাপিয়েন্সের একটা দল আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখান থেকে তারা বাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা এইভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ইউরেশিয়ার বিশাল অংশে সহাবস্থান করেছিল। কিন্তু বিলুপ্ত নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কি? সেই সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি?
আর এই তথ্য একমাত্র পাওয়া সম্ভব জিনোমিক তথ্য থেকে। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে প্রায় সমগ্র মানব জাতির জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়। অবশ্যই এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। যার মাধ্যমে বিভিন্ন মানব জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেনেটিক সম্পর্কের পরবর্তী গবেষণার দরজা খুলে যায়!
প্যাবোর গবেষণা
আধুনিক মানুষ কীভাবে এই গ্রহ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং শিল্প ও প্রযুক্তির সাহায্যে জটিল সংস্কৃতি উদ্ভাবন করেছে তার গল্প লেখা আছে আমাদের জিনোমে। আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সদের ডিএনএ-এর বেশিরভাগই অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ন। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিনোম ক্রমগুলি নিয়ান্ডারথাল এবং অন্যান্য পূর্ববর্তী হোমিনিনদের সাথে বেশ মিল আছে। তাই আমরা কি সেটা বুঝতে আমাদের সাথে নিয়ান্ডারথালদের জেনেটিক পার্থক্য বুঝতে পারা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু জেনেটিক উপাদানগুলো ভঙ্গুর হওয়ার কারণে প্রাচীন হাড়ের মধ্যে আবিষ্কৃত বেশিরভাগ ডিএনএ ক্ষয়প্রাপ্ত, রাসায়নিক পরিবর্তন এবং বিভিন্ন দূষনের কারণে পরিবর্তন হয়েছে।
বহু বছরের অবিরাম প্রচেষ্টার মাধ্যমে, প্যাবো নতুন করে একটি জিনোম সিকোয়েন্সের সিরিজ তৈরি করতে পেরেছে। যা মূল জিনোম পুনর্গঠনের জন্য ভাঙ্গা ডিএনএ জোড়া লাগানো এবং তার অর্থ বের করতে সক্ষম। আর এই কাজের জন্য প্যাবো ব্যবহার করেছেন, অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি এবং যন্ত্রপাতি।
আর তার এই যুগান্তকারী গবেষণার হাত ধরেই তিনি বিজ্ঞানের নতুন একটি শাখা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। যা ‘পেলিওজেনেটিকসে’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্যাবো এবং তার সহকর্মীরা প্রথম মানব জিনোম প্রকাশের এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে সমগ্র নিয়ান্ডারথাল জিনোমের সিকোয়েন্সিং প্রকাশ করেন। এবং তার পরপরই আবিষ্কার করেন অন্য একটি নতুন ধরণের প্রাচীন মানব, ‘ডেনিসোভান’। যারা নিয়ান্ডারথালদেরই স্বজাতি ছিল।
তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, আধুনিক মানুষের জিনোমের সাথে নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানদের একটি উল্লেখযোগ্য মিল আছে। এবং নিয়ান্ডারথালদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমানকালের মানুষের মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। আর একারণেই গবেষকদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কেন কিছু লোক নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অন্যদের চেয়ে বেশি সক্ষম এবং কেন কেউ কেউ অধিক উচ্চতায় বসবাসের ক্ষেত্রেও নিজেদের সুন্দরভাবে মানিয়ে নিতে পারছে।
তবে প্যাবোর এই গবেষণা এবং প্রাপ্তি হিসেবে ‘নোবেল প্রাইজ’ জেতা কিন্তু একদিনের বা কিছুদিনের কাজের মূল্যায়ন নয়। মূল বীজ বোনা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। একই বছর সর্বপ্রথম নিয়ান্ডারথালদের জিনোমের একটা রূপ দিতে সক্ষম হোন প্যাবো।
পরবর্তীতে ২০০৪ সালে আরো বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ান্ডারথালদের জিনোম সিকোয়েন্স-এর গবেষণা তুলে ধরেন যেখানে প্রকাশ পায় কিভাবে বর্তমানের মানব জাতির ডিএনএ-তে তাদের বৈশিষ্ট্য বর্তমান।
২০০৮ সালে, নিয়ান্ডারথালদের এমটিডিএনএ (mtDNA) সিকোয়েন্স পুনরায় দাঁড় করান তিনি।
২০১০ সালে, প্যাবো পুরো গবেষণাটির একটি খসড়া রূপ প্রকাশ করেন। এবং কিভাবে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ-র সাথে আধুনিক যুগের মানুষের ডিএনএ-র মিল আছে সেটা দেখাতে সক্ষম হোন।
২০১২ সাল থেকে পরবর্তী দশকে বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রমান হয় যে নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান এবং আধুনিক মানুষের বেশ কিছু মিল রয়েছে।
২০২২ সালে, সোয়ান্তে প্যাবো নোবেল প্রাইজ জিতে নেন তার গবেষণা ‘জেনোমিক স্টাডিজ অব এক্সটিংথ হিউম্যানস’ (Genomic Studies of Extinct Humans)-এর জন্য!
এই গবেষণা সম্পর্কে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-
আমরা যখন নমুনাগুলি বিশ্লেষণ করেছি তখন লক্ষ্য করেছি যে প্রায়ই আমরা এমন হাড়ের টুকরোগুলিতে বেশি সাফল্য পেয়েছি যেগুলিতে কাটা দাগ ছিল কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে যে হাড়গুলিকে ভাঙা হয়েছিল।
প্যাবোকে তার এই গবেষনার জন্য লক্ষ-লক্ষ জিনোম সিকোয়েন্স ভাঙ্গতে এবং বিশ্লেষণ করার মতোন প্রায় অসম্ভব কাজটি করতে হয়েছিল। শুধুমাত্র নিয়ান্ডারথাল না, বরং আধুনিক মানুষের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটাও তিনি এর ফলে প্রমাণ করতে সফল হোন।
হোমো স্যাপিয়েন্স সবার থেকে আলাদা কি কারণে?
মানবজাতি সবসময় একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছে যে তারা কোথা থেকে এলো! পূর্বে হাজার বছর আগে যারা এসেছিল তাদের সাথে বর্তমানের মানব প্রজাতির কোনো মিল আছে কিনা। আর থাকলেও সেগুলো কি কি? আর কোন কোন বৈশিষ্ট্য-ই বা তাদের হোমো স্যাপিয়েন্স হিসেবে সবার থেকে আলাদা করেছে।
বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি লালন, নতুন কিছু উদ্ভাবন, শিল্প এসকল কিছুর মিশেল একমাত্র হোমো স্যাপিয়েন্স-এ আছে। শুধু পৃথিবী না বরং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপি ছড়িয়ে পরার ক্ষমতাও একমাত্র হোমো স্যাপিয়েন্স-এর দখলে এখন পর্যন্ত। অন্যদিকে, নিয়ান্ডারথালরাও দলবদ্ধভাবে বাস করতো এবং বড় মস্তিষ্কের অধিকারী ছিল। তারা সরঞ্জামও ব্যবহার করতো। কিন্তু শত সহস্র বছরে এগুলো খুব কমই বিকশিত হয়েছিল।
হোমো স্যাপিয়েন্স এবং আমাদের নিকটতম বিলুপ্ত আত্মীয়দের মধ্যে জেনেটিক পার্থক্যগুলি অজানা ছিল যতক্ষণ না তাদের প্যাবোর সেমিনাল কাজের মাধ্যমে সনাক্ত করা হয়। তীব্র উত্তেজনা পূর্ন চলমান এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই ছিল এটা জানা যে, কি বৈশিষ্ট্য নিয়ান্ডারথালদের থেকে আমাদের আলাদা করেছে। এবং ২০২২ সালে এসে আমরা জানতে পারি এখনও আমরা প্রাচীন নিয়ান্ডারথালদের জিনোম বৈশিষ্ট্য ধারণ করছি!
Image Source: nobelprize.org References: 01. Nobel Prize Medicine 2022. 02. Nobel Prize Physiology Medicine Svante Paabo. 03. Extinct Human Genomes Studies Win Nobel Prize for Medicine.