জনপ্রিয় হচ্ছে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান

209
0
টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান Image source: Photo by 3blmedia/seagoingreen

টিকে গেলেন নয়তো হেরে গেলেন

এই যখন বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের আগ্রাসী মনোভাব, ঠিক তখনই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে তাদের ব্যবসাকে সাজাচ্ছে নতুনভাবে। ই- কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন হচ্ছে তাদের ব্যবসাকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে। কেননা ক্রেতারা আজ পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পণ্য গ্রহণে বেশি আগ্রহী। পণ্যের প্যাকেজিং থেকে শুরু করে ব্যবসার মডেল, সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করছে তাদের এই পরিবেশবান্ধব মনোভাব। 

পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা তো বটেই, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এরূপ পরিবর্তনের পথে হাঁটছে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে। ক্রেতা এবং ভোক্তা উভয় শ্রেণিই আজ পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে দারুণ সচেতন। দৈনন্দিন জীবনের সেবা বা পণ্য ভোগের  পাশাপাশি তারা পরিবেশবান্ধব সেবা এবং পণ্য উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক উন্নতি করেছে। সেই সাথে পরিবেশের উপর পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব। প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন কার্ডবোর্ড বক্স, প্লাস্টিক, শোলা ইত্যাদি প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলা হয়। তবে আশার কথা হলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যাপারে প্রতিনিয়তই সচেতন হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই তারা তাদের পণ্যগুলোকে পরিবেশ বান্ধব প্যাকেজিং এর আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। 

সম্প্রতি বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যগুলো উন্নত করার মাধ্যমে গ্রিন বিজনেসে প্রবেশ করেছে। তাদের পণ্যগুলো তৈরি করতে কাগজ, কার্ডবোর্ড, শোলা প্রভৃতি উপকরণ ব্যবহার করছে। ইতিমধ্যে তারা পণ্যগুলো পরিবেশ বান্ধব করে তোলার মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব ই-কমার্স এর ধারায় প্রবেশ করেছে। 

গ্রিন বিজনেস। Image Source: startupguys.net

‘প্যাকহেল্প’ এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়ীদের পরিবেশ বান্ধব প্যকেজিং এর প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উপকরণের ব্যবহার করছে। অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এরূপ সেবা গ্রহনে আগ্রহী হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান প্যাকহেল্প এর সাথে মিলে বনায়ন এর প্রকল্প গ্রহন করছে। 

যার মাধ্যমে প্যাকেজিংয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব দ্রব্যাদি যেমন- ইকো-ব্যাজ ব্যবহৃত হচ্ছে। টিওএমএস, মেমোলাইফ, মেহর গ্রুন, ৪বেটার ডেইজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পণ্য বিক্রয় করে আসছে। 

বর্তমানে ক্রেতা অনলাইন শপিং এর সময় পরিবেশবান্ধব ডেলিভারী, শিপিং ব্যাবস্থার প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। ৮৬% জার্মানী আজ গতানুগতিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার চেয়ে পরিবেশবান্ধব শিপিং বা ডেলিভারী সেবা নিতে আগ্রহী। যদিও উল্লেখ্যোগ্য পরিমান ক্রেতার নিকট পরিবেশবান্ধব ডেলিভারীর চেয়ে বাড়তি ডেলিভারী চার্জ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

তারা পরিবেশবান্ধব পণ্য সরবরাহ সেবা গ্রহনের জন্য অতিরিক্ত চার্জ গুণতে নারাজ। তবে প্রায় পাঁচ জন জার্মানীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক জার্মানী পরিবেশবান্ধব পণ্য ডেলিভারী সেবা গ্রহনে আগ্রহী। ডিএইচএল গো গ্রিন, ডিপিডি টোটাল জিরো, জিএলএস থিংকগ্রিন-এর মতো প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পরিবেশবান্ধব ডেলিভারী এবং শিপিং ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে। 

ডিএইচএলের গো গ্রিন ক্যাম্পেইন। Image source: dhlestonia/ twitter

পণ্য প্রস্তুতিতে এবং প্যাকেজিংয়ে পরিবেশবান্ধব হওয়া ছাড়াও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগূলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। পণ্য প্রস্তুতিতে তারা পুনঃব্যবহারযোগ্য উপকরণ এবং প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত উপকরণ হ্রাসকরণে কাজ করছে। 

‘রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল’ শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কেবল পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে নয় বরং বর্তমান সময়ে ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবসায় এই তিনটি শব্দের বাস্তব প্রতিফলন করা খুবই জরুরি। 

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগূলো তাদের ওয়েবসাইটের পরিচিতি অংশে তাদের পরিবেশবান্ধব সার্ভিসের কথা উল্লেখ করতে পারে। এছাড়াও, তারা তাদের প্যাকেজিং ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করতে পারে। এতে করে ক্রেতারা তাদের পণ্য বা সেবা গ্রহনে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

গবেষণায় দেখা গেছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ায় ৬০০০ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রাহক টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব সেবা গ্রহনে আগ্রহী। সুতরাং, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে তাদের পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই সেবা প্রদানের কথা ফলপ্রসূ হতে পারে। 

ওর্ণ ওয়ার প্যাটাগনিয়া। Image Source: circularx.eu

বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে যারা তাদের পণ্য এবং সেবায় পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য যোগ করছে। যেমন, Worn Wear-Patagonia নামক একটি প্রতিষ্ঠান Patagonia কর্তৃক ব্যবহৃত পোশাক বেচা-কেনা করে থাকে।

প্যাটাগনিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে কাস্টমারেরা এসব পোশাকের ব্যবহারকাল বৃদ্ধি করে থাকে। এসব পণ্যের বেশিরভাগই কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর সাহায্যে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। এতে শক্তি এবং পানির অপচয় কম হয়।

৪ ওশানের প্লাস্টিক অপসারণ কার্যক্রম। Image source: amazon.com

4ocean নামক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সমুদ্রে অপসারণ করা প্লাস্টিক নিরসনে বদ্ধপরিকর। এদের প্রত্যেকটি পণ্যের বিক্রয়ের সাথে তারা সাগরের বিশাল জলরাশি থেকে এক পাউন্ড প্লাস্টিক নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। তাছাড়াও কীভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো যায় সেই বিষয়ে তারা জনসচেতনতা গড়ে তুলছে।  

Shades of Green একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান যা আপনার জন্য পরিবেশবান্ধব বসবাসের স্থান প্রস্তুত করে দেয় এবং এই গৃহসজ্জার প্রত্যেকটি উপকরণ নন-টক্সিক এবং পরিবেশবান্ধব। 

শেডস অব গ্রিনের ওয়েবসাইট। Image Source: givz.com

তাদের পণ্যগুলোকে পরিবেশবান্ধব এর ভিত্তিতে ১-৫ এর মধ্যে স্কোর দেওয়া হয়। পণ্যগুলোর বিবরণীতে ব্যবহার উপোযোগীতা এবং অন্যান্য ক্রেতার রিভিউ যুক্ত করা থাকে। 

Pela বায়োডিগ্রেডেবল আইফোন এবং আইপ্যাড কেস, স্মার্ট ঘড়ির ব্যান্ড, সানগ্লাস ইত্যাদি তৈরি করে থাকে। এসব পণ্য প্রস্তুতে তারা পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয় এমন উপকরণ ব্যবহার করে থাকে। 

পেলার তৈরি আইফোনের কাভার। Image source: Pelacase.com

Thrive Market একটি অনলাইন ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা। তারা টেকসই পণ্য বিক্রয়, কার্বনবিহীন শিপিং ব্যবস্থা, জিরো ওয়েস্ট ওয়্যার হাউজ এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য ও কম্পোস্টেবল প্যাকেজিং নিশ্চিত করে থাকে। 

এশিয়া প্যসিফিক অঞ্চলে ক্রমশই ই-কমার্স জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সেই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এবং স্থায়িত্ব নিয়েও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে ভোক্তার মাঝে। 

থ্রাইভ মার্কেট। Image source: carolinecandace.com

এই অঞ্চলে ই-কমার্সের বার্ষিক বৃদ্ধি প্রায় ১৪.৩%। আর ২০২০-২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫২.৬৮ ট্রিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, এই সময়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তার আচরণ এবং চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের ব্যবসার মডেল, ব্যবসার মূল্যবোধ, নীতি প্রভৃতি পরিবর্তন করছে। তারা নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই নীতি অবলম্বন করছে। 

এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বর্তমানে ফ্যাশন, গৃহ, প্যাকেজিং, বিটুবি মার্কেটে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ওম্ব, ইয়োর সাসটেইনেবল স্টোর, সাসটেইনেবল, সোর্স গ্রিন প্যাকেজিং, ব্লু স্পিনাচ, পপচিল, ইকোওয়্যার হাইজ ইত্যাদি। 

ভোক্তার আচরণ এবং চাহিদা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝা যায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন কেন পরিবেশবান্ধব সেবার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার চাহিদার ব্যাপারে সচেতন বলেই অন্যান্য ব্যবসার চেয়ে তারা বেশি সফল। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব সেবা প্রদানের নামে ক্রেতার সাথে প্রতারণা করছে। তারা পণ্য এবং সেবা সম্পর্কে ভুল তথ্য দিচ্ছে। 

ব্যবসায় মুনাফা অর্জনের জন্য তো বটেই, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরিবেশ বাঁচানোর জন্য।Image source: Tofros.com/pexels

ব্যবসায় মুনাফা অর্জনের জন্য তো বটেই, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরিবেশ বাঁচানোর জন্য, পৃথিবীর প্রানিকূলকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরির জন্য। ব্যবসায় অধিক মুনাফা অর্জন কখোনই এর একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারেনা।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই উপরে উল্লিখিত বিষয়ের প্রতি সচেতন হতে হবে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে করে ব্যবসায়ে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি তা পরিবেশবান্ধব হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সফল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা থেকে ধারনা নিয়ে কাজ করা যায়।

 

 

 

Feature Image: seagoinggreen.org
References: 

01. Rise of Sustainable E-commerce. 
02. Sustainable E-commerce. 
03. Examples of Sustainable E-commerce. 
04. Sustainable E-commerce Platforms. 
05. 10 Sustainable E-commerce.