সুয়েজ খাল: মানবসৃষ্ট এক বিস্ময়ের নাম

907
0

বর্তমানের এই মানবসভ্যতা একদিনে আজকের অবস্থানে আসেনি। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে – Rome Was not built in a day. অর্থাৎ – রোম শহরের গোড়াপত্তন একদিনে হয়নি। বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, উদ্ভাবন-ধ্বংসের পথ পাড়ি দিয়ে তারপর এই অবস্থানে এসেছে বর্তমান মানবসভ্যতা। ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে, সেদিন আজকের সময়টাও ইতিহাসে পাঠের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবে। 

মানবসমাজে রাজনীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রাজনীতির প্রভাব যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। যেমন সূদুর অতীতে সুয়েজ খাল রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্ব ইতিহাসের একটি পট পরিবর্তনকারী ও অতি প্রয়োজনীয় পথ হলো সুয়েজ খাল। সুয়েজ খাল খননের মধ্যে দিয়ে প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন সহজ হয় তেমনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথও অনেক-খানি সুপ্রসারিত হয়। আর আজকের আলোচনায় থাকছে সুয়েজ খাল নিয়ে বিস্তারিত। 

খাল খননের ইতিহাস

কিংবদন্তি আছে যে, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে সুয়েজ খাল খননের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তিন হাজার বছর আগে, সুয়েজ খালের জল পথে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো তার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে খালটি বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ৫১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ফারাও রাজা নেকো এক লক্ষ বিশ হাজার ক্রীতদাস নিয়োগ করে পুনরায় খালটি খননের ব্যবস্থা করেন। 

হঠাৎ মিশরের এক মন্দিরে ভবিষ্যৎবানী হয় যে, এই জল পথে মিশরের বুকের উপর বিদেশি বর্বর অত্যাচারীর দল হামলা করতে আসবে। ফলে নেকো সুয়েজ খাল খননের কাজ বাদ দেন। মিশর যখন টলেমির শাসনামলে ছিল তখনও সুয়েজ খাল খনন করা হয়েছিল এবং আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু টলেমিও পুরোপুরিভাবে কাজ শেষ করতে পারিনি।  

ফারাও সম্রাট দ্বিতীয় নেকো। Image Source: alchetron.com

ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন মিশর আক্রমণ করেন ১৭৯৮ সালে। এই সময় তিনি সুয়েজ খাল খননের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। নেপোলিয়ন সুয়েজ খাল খননের জন্য বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নেপোলিয়ন ট্রাফালগার স্কয়ারে ব্রিটেনের নিকট পরাজিত হলে তিনি অর্থনৈতিক দিক থেকে দূর্বল হয়ে পড়েন। তিনি মুহাম্মদ আলী পাশাকে সুয়েজ খাল খননের প্রস্তাব দিলে মুহাম্মদ আলী পাশা তাতে অস্বীকৃতি জানান। 

পরর্বতীতে উনবিংশ শতকে মিশরের শাসনকর্তা খেদিভ সাঈদ পাশা তার রাজত্বকালে পুনরায় আবার সুয়েজ খাল খননের কাজ শুরু করেন। ফার্দিনান্দ-দ্য-লেসেপস খেদিভ সাঈদ পাশার কাছ থেকে ১৮৫৪ সালে অনুমতি নিয়ে খননের পরিকল্পনা শুরু করেন। এতে কোম্পানি ইউনিভার্সাল নামক ফরাসি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি নিরানব্বই বছরের জন্য সুয়েজ খাল খননের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

কোম্পানি ইউনিভার্সাল মিশরের সহায়তায় ১৮৫৯ সালের এপ্রিল মাসে সুয়েজ খাল খননের কাজ শুরু করেন এবং ১৮৬৯ সালের দিকে খননের কাজ শেষ হয়। সুয়েজ খাল খননের সময় প্রচুর অর্থ ও জীবন নষ্ট হয়। খনন কার্যে প্রায় ৪৩৭০ লক্ষ ফরাসি মুদ্রা ব্যয় হয়। সুয়েজ খাল কৃত্রিমভাবে খননকৃত একটি খাল। যা মিশরের ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত। যার ফলে এর গভীরতা মাত্র ২৫-৩০ ফুট। এর দৈর্ঘ্য ১০০ মাইল ও প্রস্থ ১০০ গজ। খালটি খননের সময় অনেক সংকীর্ণ ও সরু ছিল। যার কারণে এর মধ্য দিয়ে পাশাপাশি দুটি জাহাজ চলাচল করতে পারতো না। 

খেদিভ সাঈদ পাশা Image Source-pinterest.com

সুয়েজ খালের গুরুত্ব

সুয়েজ খাল খননের মধ্যে দিয়ে প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের যোগাযোগ যেমন সহজ হয়েছে তেমনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথও অনেক খানি সুপ্রাসারিত হয়। সমগ্র বিশ্বে ব্যবসায় বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রসার ঘটে।সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণ লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এর আগে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে হতো। 

সুয়েজ খালের একপাশে পোর্ট সৈয়দ ও অন্যপাশে সুয়েজ বন্দর অবস্থিত হওয়ার কারণে এই খালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকখানি। সুয়েজ খাল খননের ফলে অতি অল্প সময়েও কম খরচে আরব ও ইউরোপীয়রা ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে। সুয়েজ খাল খননের ফলে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যায়। 

বিশ্ব রাজনীতিতে সুয়েজ খাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই খালের রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এর দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে আছে। সাম্রাজবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলো এর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মধ্যপ্রাচ্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য সর্বদা চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মিশরকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুয়েজ খাল আরব বিশ্বের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে।

তাছাড়া, সুয়েজ খালের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন মহাদেশের জাহাজ চালিত হয়। যার ফলে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক কার্য সম্পাদিত হয়। এক দেশের সংস্কৃতি দ্বারা অন্য দেশে প্রভাবিত হয়। প্রাচ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রবেশ আবার পাশ্চাত্যে প্রাচ্যের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ দেখা যায়। এসব কিছুর জন্য সুয়েজ খাল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। 

সুয়েজ খালের মানচিত্র image source-MBangla.in

সুয়েজ সংকট সৃষ্টি হওয়ার কারণ

সুয়েজ খাল অতি অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে একটি প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে মধ্যেপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি হয় যা সুয়েজ সংকট নামে পরিচিত। জাতীয়করণ করার ফলে নাসের এর জনপ্রিয়তা নিজ দেশে অনেক গুণ বেড়ে যায়।

আবদেল নাসের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মিশরের মরুগ্রাসী অনাবাদি ভূমিকে আবাদি ভূমিতে পরিণত করার জন্য আসওয়ানে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এই প্রকল্পের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্ত নাসের ইসরাইল সংকট মোকাবিলার জন্য রাশিয়ার সাথে অস্ত্র আমদানিসহ মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলে। যার ফলে বিশ্ব ব্যাংক আসওয়ান বাধ প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়।

ফলে নাসের রুষ্ট হয়ে ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন। সংকট নিরসনে জাতিসংঘ চেষ্টা করে কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি। যার ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইসরাইল ত্রিশক্তি মিশরের বিরুদ্ধে গোপন আঁতাত গড়ে তোলে। 

সুয়েজ সংকটের সময় Image Source- britannica.com

১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর ইসরাইল আকস্মিকভাবে মিশরের উপর আক্রমণ করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিশর ও ইসরাইলকে সুয়েজ খালের ১০ মাইল দূরে অবস্থানের নির্দেশ দেয়। কিন্তু এতে ইসরাইল রাজি হলেও মিশর রাজি হয়নি। ফলে ত্রিশক্তি মিশরে আক্রমণ করে। আক্রমণের প্রতিশোধস্বরূপ নাসের সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেয় এবং জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

পরর্বতীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক ১৯৫৭ সালে সুয়েজ সংকটের সমাধান করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধ এবং ১৯৭৩ সালের ইয়ম কাপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মূলত সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে। আবার মিশর সরকার সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেয়। এই সময় গ্রেট বিটার লেকের কাছে ১৫টি আন্তজার্তিক জাহাজ আটকে ছিল। তবে ১৯৭৫ সালে জাহাজগুলি খাল ত্যাগের অনুমতি পেয়েছিল। 

ইয়ম কাপুর যুদ্ধের বর্বরতা। Image Source: worldjewishcongrees.org

আধুনিক বিশ্বে সুয়েজ খালের গুরুত্ব

প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আধুনিকালেও আমরা দেখতে পাই যে, ব্যবস্যা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায়। সেই হিসেবে বিশ্বের প্রায় ৯০ ভাগ বাণিজ্য সমুদ্রপথেই হয়ে থাকে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সহজে বাণিজ্যের একমাত্র দ্বার হলো সুয়েজ খাল। সুয়েজ খাল না থাকলে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় বাণিজ্য করতে আসলে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসা লাগতো। 

২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যান অনুসারে, বছরে প্রায় ১৯ হাজার জাহাজে ১২৫ কোটির বেশি পণ্য পরিবহন করা হয় সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে, যা প্রায় বিশ্ব বাণ্যিজের আট ভাগের এক ভাগ। তাছাড়া, এশিয়া মহাদেশের অনেক পরাশক্তি দেশগুলো সুয়েজ খাল ব্যবহার করে পণ্য ইউরোপে পাঠায়। যার ফলে দুই মহাদেশের মধ্যে সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। 

মধ্যপ্রাচ্যের যত তেলবাহী জাহাজ আছে সব সুয়েজ খাল ব্যবহার করে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশে যায়।  বর্তমানে জাহাজগুলোর অপেক্ষার সময় ১৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টায় নেমে এসেছে। মিশরের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রায় ১৩০০ কোটি মার্কিন ডলার যোগ হয় এই সুয়েজ খালের মাধ্যমে। তাই দিন যতই যাচ্ছে ততই সুয়েজ খালের গুরুত্ব বেড়ে চলছে। 

 

Feature Image: goodfreephotos.com
তথ্যসূত্র:

  1. The Suez-canal.
  2. A-brief-history-of-the-Suez-canal.
  3. Suez-canal-Egypt-history-trade.
  4. The Suez-Crisis.