১৯৫৭ সালের এক শীতের সকাল। সবে সূর্য উঠেছে এবং আমাদের ছোট রান্নাঘর থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। আমাদের এক ভাই লেনি মেঝেতে বসে বসে টোস্ট খাচ্ছিলো এবং আমি, মুর্যে আর ডেভিড বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম মা কখন এসে আমাদের টোস্টে সবজির জেলি মেখে দিবে আর তা খেয়ে আমরা স্কুলে যাবো। আমাদের বাসার প্রাত্যহিক রুটিন ছিল এটা।
এমন সময় কেউ একজন ঠকঠক করে দরজায় নক করলো। মা কোনো জবাব দিলেন না। রাস্তা দিয়ে কেউ আসার শব্দও পাইনি আমরা। দরজার ঠকঠক শব্দ আরও তীব্র হলো, বাধ্য হয়ে মা, বাবার অনুপস্থিতিতেই দরজা খুলে তিনজন আগন্তুকের সাথে বাক্য বিনিময় করলেন। তাদের মধ্যে কী কথা হচ্ছে, সেটা আমরা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলাম। এরপর ওই তিন আগন্তুক ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো।
স্যুটকেস পড়া এক লোক মায়ের দিকে তাকিয়ে আমাকে আর লেনিকে তাদের হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দিলো। আমার মা আর্তনাদ করে উঠলেন। তা আকুতি না মেনে এক পুলিশ এসে আমাকে আর লেনিকে গাড়িতে তুলে নিলেন। আমার মা দৌড়ে রাস্তায় চলে আসছিলেন, আর হাঁটু মুচড়ে পড়ে গিয়েছিলেন। আর দুই হাতে রাস্তার বিটুমিন আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখছিলাম আমাদের মা হাঁটু মুড়ে, দুই হাতে রাস্তা আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন।
গল্পকথকের নাম বিল সিমন। যে একজন স্টোলেন জেনারেশনের সন্তান। দশ বছর বয়সে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। যখন সিমনের বয়স ৩০, তখন সে আবার তার মায়ের কাছে ফিরে যায়। কিন্তু তার মা তাকে আর গ্রহণ করেনি।
কারণ সে আবারও বিয়ে করেছিল এবং বাচ্চাও ছিল তার। এটা শুধু সিমনের নয়, সত্তরের দশকের পূর্বে প্রতিটা অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী পরিবারের শিশুর গল্প এটা। এদেরকেই বলা হতো স্টোলেন জেনারেশন। বাংলায় বললে দাঁড়ায়, হারানো প্রজন্মের সন্তানেরা।
স্টোলেন জেনারেশন হচ্ছে, এমন এক জেনারেশন, যারা শৈশবেই জোরপূর্বক সরকার ও সমাজ দ্বারা নিজ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে শ্বেতাঙ্গদের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত হতো। ১৯০৫ সালের অস্ট্রেলিয়ায় অদ্ভুত এক আইন প্রবর্তিত হয়, যা অনুযায়ী, যেকোনো আদিবাসীর সন্তান জন্ম হলে তা জোরপূর্বক সরিয়ে নেয়া হতো তাদের জন্মদাতা আদিবাসী বাবা-মায়ের কাছ থেকে।
পাঠিয়ে দেয়া হতো কোনো শ্বেতাঙ্গ পরিবারে। এর ফলে শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছ হতে দূরে সরে যেতো, এবং পিতৃ-মাতৃ স্নেহবঞ্চিত হতো। এই আইনের ফলে যে শিশুরা তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়, তাদেরকে পরবর্তীতে নাম দেয়া হয় ‘স্টোলেন জেনারেশন’।
কেন এমন আইন?
অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ও দ্বীপবাসী শিশুদেরকে তাদের পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন করার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। তৎকালীন সময়ে অস্ট্রেলিয়ার নীতিনির্ধারকরা চাইতো অস্ট্রেলিয়ানরা ইউরোপীয় সংস্কৃতি মোতাবেক চলুক। কিন্তু তারা তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ও তাদের সংস্কৃতি চর্চাকে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করতো।
অস্ট্রেলিয়ান অ-আদিবাসীরা স্থানীয় আদিবাসীদের সবসময় নিকৃষ্টের চোখে দেখতো। তাদের সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠানকে নিচ মনে করতো। তাদের লক্ষ্য ছিল আদিবাসীদেরকে তাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে মূলধারার ইউরোপীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া। তারা ভাবতো যে, যদি আদিবাসীদের সন্তানদেরকে তাদের থেকে ও তাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে কয়েক প্রজন্ম পর তারা সবাই মূলধারার ইউরোপীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করবে।
তাদের সন্তানদেরকে বর্বর, নিচ থেকে সভ্য মানুষ বানাবে। আদিবাসী সন্তানদেরকে নিজ পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতি মন্ডিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পশ্চিমা শিক্ষা ও ধর্মীয় নির্দেশনা দিয়ে তাদের ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও আনুষ্ঠানিকতা ভুলিয়ে দেবে। পশ্চিমা মূল্যবোধে দীক্ষিত করবে।
এভাবে তারা অনেক বছর ধরে প্রচুর আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবার থেকে দূরে সরিয়েছে। পরিবার থেকে আলাদা করে দেওয়া শিশুর প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও আসল সংখ্যাটা অনেক বেশি হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে খুব কম সংখ্যক পরিবারই আছে, যারা এই আইনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
ফলে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও পরিবারের মধ্যকার বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্টোলেন জেনারেশনরা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়েছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যার ভার এখনো তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
Bringing them home এবং জাতীয় সরি দিবস
১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল এর মধ্যে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ইকুয়াল অপরচুনিটি কমিশন’ ভুক্তভোগী আদিবাসী পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা ৫০০ আদিবাসী পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়। এরপর ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে উক্ত কমিশন ‘Bringing them home report’ প্রকাশ করে।
এই রিপোর্টটি স্টোলেন জেনারেশন বিষয়ক আইন, পলিসি ও প্রভাব বর্ণনা করে। রিপোর্টটি এটাও ব্যাখ্যা করে যে, অ-আদিবাসীরা তাদের নিজের স্বার্থের জন্যই আদিবাসী শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করে নিজেদের কাজে লাগাতো। এই রিপোর্টটি আদিবাসী ও স্ট্রেইট আইল্যান্ডবাসীদের সাথে হওয়া অনাচার এর প্রতিকার হিসেবে ৫৪টি প্রস্তাবনা পেশ করে।
সব প্রস্তাবনার মূল প্রস্তাবনা হচ্ছে, যাদেরকে নিজ পরিবার থেকে আলাদা করা হয়েছিল, তাদেরকে নিজের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, জোরপূর্বক পরিবার থেকে অপসারণের জন্য তাদের ও তাদের পরিবারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। ১৯৯৮ সালের ২৬ মে, হাজারো অস্ট্রেলিয়ানের অংশগ্রহণে ‘দ্য সরি বুক’ ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়। যা পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল সরি ডে হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই মুভমেন্টটা পরবর্তীতে ‘দ্য পিপলস অ্যাপোলজি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে।
১৯৯৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সব স্টেট ও পার্লামেন্ট অফিসিয়ালি স্টোলেন জেনারেশন এর কাছে ক্ষমা চায়। ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকার পার্লামেন্টে ‘Motion of reconciliation’ এর প্রস্তাব দেয়, যা স্টোলেন জেনারেশনদের প্রতি গভীরভাবে সমবেদনা ও ক্ষমা জ্ঞাপন করে। এরপর তারা প্রায় ১০ বছর ক্ষমা চাওয়ার কোনো সাজেশন গ্রহণ করেনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের মে মাসে, স্টোলেন জেনারেশনদের পুণর্মিলনীকে সমর্থন ও ক্ষমা চাওয়ার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের উদাসীনতার প্রতিবাদে ২ লক্ষ ৫০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান সিডনির হার্বার ব্রিজের দিকে পদযাত্রা করে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমাপ্রার্থনা
২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড আদিবাসীদের ওপর জরিপ শুরু করেন যে, কোন ধরণের অ্যাপোলজির উদ্যোগ তাদের জন্য উপকারি হবে। ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি স্টোলেন জেনারেশন ও তাদের পরিবারের নিকট ক্ষমা চায়।
সেদিন সারা অস্ট্রেলিয়ায় লাখো মানুষ বিগস্ক্রিনে তাদের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া দেখেছে। অ্যাপোলজি শো শেষ হতেই সারা অস্ট্রেলিয়ায় কান্না, স্বস্তি এবং করতালির ঢেউ বয়ে যায়।
Bringing them home প্রস্তাবনার একাল-সেকাল
Bringing them home প্রতিবেদনের ৫৪টি প্রস্তাবের অনেক প্রস্তাব এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। রিপোর্টটির ২০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে Healing Foundation একটি অ্যাকশন প্ল্যান প্রকাশ করে। এটায় মূলত স্টোলেন জেনারেশন এর ইতিহাস, তাদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা, এবং তাদের জন্য এখনো কী কী করা উচিত তা নিয়ে বিশদভাবে লেখা আছে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য সরকারের অধীনে এখনো অনেক আদিবাসী শিশু বেড়ে উঠছে এবং সেটা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অতীতের কোনো ঘটনা না। বর্তমানে যদিও স্টোলেন জেনারেশনের উদ্দেশ্য আর আজকের দিনের সরকারি ডে কেয়ারের আদিবাসী শিশুদের বেড়ে উঠার ব্যাপারটা আলাদা। তবে দুইটার প্রভাবই একইরকম। জাতিগত, সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানো এবং ইন্টারজেনারেশনাল ট্রমা বৃদ্ধি।
Feature Image: webflow.com Content Sources: 01. Stolen Generations Stories. 02. National Apology. 03. Aboriginals Protection and Restriction of the Sale of Opium Act 1897. 04. Stolen Generation. 05. The Stolen Generations. 06. National Sorry Day.