ইতিহাসের ঐতিহ্যময় এক বাণিজ্য পথ সিল্ক রোডের গল্প

640
0
(Silk Road)

সিল্ক রোড বা সিল্ক রুট। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এই পথটি খৃষ্টপূর্ব ১৩০ সাল থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ব্যবহৃত নির্ভরযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে প্রচলিত ছিল। এটি মূলত চীনের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল। ২০১৪ সালে এই সড়কটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। আর কেনই বা করবে না বলুন? এই সিল্ক রুটের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে কত ইতিহাস, কত গল্প লেখা আছে এই পথের ধুলোয়।  

মজার ব্যাপার হলো এই জনপ্রিয় সিল্ক রোড কেবল একটি সড়কই নয়; বরং এখানে বেশ কয়েকটি রাস্তা রয়েছে যেগুলো চীন, জাপান, ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে মধ্য এশিয়া, আবার মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ এবং অনেকগুলো শহরকে একসাথে যুক্ত করেছে। এটি সিল্ক রুট কিংবা রেশম পথ এবং সিল্ক রোড নামেই বেশি পরিচিত। 

নামকরণ

এ পথের বিশালতাও নেহাতই কম নয়। প্রায় চার হাজার মাইল দীর্ঘ এই পথের নামকরণের পিছনে রয়েছে ছোট্ট একটি ইতিহাস। যখন থেকে এই পথে মানুষের পদ ধুলি পড়তে শুরু করেছে, চীনে সেই সময় রেশমের ব্যবসা বেশ লাভজনক ছিল এবং এই ব্যবসার খাতিরেই এটি তৈরি করা হয়। 

আর তাই এটিকে সিল্ক রুট বা রেশম পথ বলা হয়। ১৮৭৭ সালে ফার্ডিন্যান্ড ভন এই নামটি প্রথমে ব্যবহার করেন। এই পথের রহস্য উদ্ধারে তিনি ১৮৬৮  থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত চীনে মোট সাতবার অভিযান করেন। ১৪৫৩ সালে চীনে অটোমান সম্রাজ্যের শাসনের দৌরাত্ম্যে এই পথের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। 

সিল্ক রুটের কথা 

বিশাল মাল সামানা নিয়ে একজন ব্যবসায়ীকে বাণিজ্যের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো। তবুও শেষ পর্যন্ত তার হাতে আসতো বিশাল অঙ্কের টাকা, যেটা সত্যি ভালো লাগার ছিল। তবে মুখে হাসি ফোটাতে একদিকে যেমন অনেক কষ্ট করতে হতো, তেমন অনেক ভয়ানক শত্রুর মোকাবেলাও করতে হতো। মরুর বুকের অনুকুল প্রতিকুল পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে ছিল ডাকাতের ভয়।  

১৩০ খ্রিস্টপূর্বে চীনের হান রাজবংশের হাত ধরে পশ্চিমের দেশগুলোতে বাণিজ্য শুরু হয়। সেই সময়ই এই বাণিজ্য পথের সৃষ্টি হয়। প্রায় ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পথ বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু এর পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্য যখন এই রাজ্য দখল করে নেয় তখন পশ্চিমের সাথে সব ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেনও বন্ধ হয়ে যায়। আর সাথে বন্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ সময়ের ব্যবহৃত সিল্ক রোড। হারিয়ে যায় ইতিহাস, হারিয়ে যায় বাণিজ্যিক সব সম্পর্ক।  

(Silk Road)
সিল্ক রোডের মানচিত্র। Image Source: wikimedia.commons

এই বড় পথের সবচেয়ে ভয়ংকর স্থান ছিল গোবি মরুভূমি। এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই মরুভূমি মঙ্গোলিয়া থেকে  চীন জুড়ে বিস্তৃত। ভৌগোলিক পরিবেশের ভিন্নতাও রয়েছে এই অঞ্চলে। কঠিন, রুক্ষ পাথরের হওয়া সত্বেও এই মরুভুমি রাস্তাই ছিল সব থেকে বেশি ব্যবহৃত। এর কারণ যাত্রা করার রাস্তা ছিল তুলনামূলক সহজ, এছাড়া রাস্তা খুঁজে বের করাও সহজ ছিল। 

তবে মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। সবচাইতে আরামের পথে সবচেয়ে বেশি বিপদ। এত দীর্ঘ মরুভূমিতে ছিল না কোন সুপেয় পানির ব্যবস্থা কিংবা খাবারের ব্যবস্থা। মানুষ কিংবা মাল বহনকারী উটের জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর পানি। কিন্তু এই গোবি মরুভূমিতে পানির দেখা মিলত না, মরীচিকা আর ধূ ধূ প্রান্তর ছিল কেবল। এর সাথে ছিল ডাকাতের ভয়।

তবে একটা সময় এই মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন সরাইখানা যেখানে যাত্রীরা বিশ্রাম নিতে পারতেন, আহার করতে পারতেন। শুধু মানুষ না তাদের উটেরও প্রয়োজন ছিল বিশ্রামের। আর তাই এই বিশ্রামাগার থেকে নিজের ও উটের জন্য খাদ্য পানীয় সংগ্রহ করতে পারতেন। খাবার-পানিসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে বাকি রাস্তার জন্য সওদাগরেরা আবার নেমে পড়তেন পথে। এই সরাইখানা একসময় বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠত, পণ্যের আদান প্রদান চলত দেদারসে। এই সরাইখানাগুলো এমন ভাবে নির্মিত হতো যে, পরবর্তী বিশ্রামকেন্দ্রে যেতে ২৪ ঘন্টার মত লাগতো।

(Silk Road)
গোবি মরুভূমি বুক চিরে বয়ে চলা সিল্ক রোড। Image Source: wikimedia.commons

গোবি মরুভূমি পার হয়ে যাত্রীরা যেতেন ইরানে, সেখান থেকে তুর্কি এবং সেখান থেকে গন্তব্যে। তাদের যাত্রাতে গিয়ে মরুভূমি পার হওয়ার পরেও কিন্তু এত সহজ ছিল না। বাকী পথের নিরাপত্তা নির্ভর করতো নানা পরিস্থিতির ওপর। প্রাকৃতিক আবহাওয়া, দস্যু, রাজনৈতিক আবহাওয়া সবকিছুকে মোকাবেলা করেই তারা পৌঁছাতেন তাদের গন্তব্যে। বাণিজ্য আর বিনিময় করে হাসতেন বিজয়ের হাসি। 

মজার ব্যাপার হলো সিল্ক রোড শুধু যে স্থলভাগেই ছিল এমন নয়; ছিল একটি সমুদ্র পথও। এই সমুদ্রপথে ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভারত এবং এরাবিয়ান উপদ্বীপ এর সংযোগস্থল। ‌চীনকে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করেছিল এই জল পথ। বিপদ এখানেও পিছু ছাড়েনি, স্থলপথে যেমন ছিল ধূলিঝড়, ডাকাতসহ নানা ধরনের বিপত্তি তেমনি সমুদ্রপথে ছিল জলদস্যু, আর ছিল নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। 

দুই পথ জুড়েই ছিল নানা ধরনের প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট বিপদ। তবে এই সবকিছু মোকাবেলা করেই একদল বনিক তাদের পণ্য ইউরোপে পৌঁছাতে আসতেন এবং ফিরে আসতেন বিপুল অর্থ নিয়ে। পণ্য নিয়ে যাওয়া এবং পণ্য বিক্রি করে ফিরে আসা দুই পথই ছিল বন্ধুর। 

কী কী পণ্য পরিবহণ করা হতো

মূলত রেশম পরিবহনের জন্যই সিল্ক রোডের জন্ম হয়। যা পৃথিবীর পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম প্রান্তে সরবরাহ করা হতো। তবে রেশম সরবরাহ করা যাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই অন্যান্য পণ্যও সহজেই বহন করা যাবে এই চিন্তা থেকেই নানা রকমের ফলমূল-শাকসবজি, সোনা-দানা, মণিমাণিক্য, কাপড়-উল, গবাদি পশুর চামড়া, শুকনো খাদ্য দ্রব্যসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এই পথে আনানেয়া করা হতো। বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আনা-নেয়া করা হলেও যেটা সবার অজান্তে আনা-নেয়া করা হতো সেটা হলো দুপাশের মানুষের ভাষা-ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সংস্কৃতির দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান নানা ধরনের তথ্য আবিষ্কার এবং সৃষ্টি হয়েছিল বন্ধুত্বের। 

কিছু কিছু স্কলারদের মতে, বুবনিক প্লেগ এশিয়া থেকে ইউরোপে গিয়েছিল এই পথে ধরেই। যার ফলে ১৪ শতাব্দীতে সেই ভয়ানক ব্ল্যাক ডেথ নামে প্যানডেমিক এর সৃষ্টি হয়। যেমনভাবে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল করোনা কিছুদিন আগেই। প্লেনে করেই করোনা যেমন এক দেশ থেকে আরেক দেশে ট্রাভেল করেছিল ঠিক তেমনি উটের পিঠে ট্রাভেল করেছিল এই প্লেগ। 

এই পথ নতুন করে আবার বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। কিছুদিন আগে ১৯৯০ থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে সিল্ক রোডে নির্মিত হয়েছে রেল পথ। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড,’ ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড,’  বরফের তৈরী সিল্ক রোডসহ আরো বেশ কিছু পথ যুক্ত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক কাজের জন্য। চীনের সাথে সমগ্র পৃথিবীর সংযোগ তৈরি করা এই পথ বাণিজ্যের সাথে আর কি কি আদান প্রদানে আমাদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

 

Feature Image: wikimedia.commons
References:

01. https://www.worldhistory.org/Silk_Road/
02. সিল্ক রোড: প্রাচীন, দীর্ঘতম ও বিপজ্জনক বাণিজ্যিক রুট
03. Silk Road.